ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৬
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
–ওরা যশোর-সাতক্ষীরা রোড পার হওয়ার সময় পাকসেনাদের গাড়ি দেখতে পায়। ওরা তাড়াতাড়ি গরুর গাড়ি থেকে ওরা যে কয়জন ছিল সবাই বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যায়। রাস্তার পাশের গর্তে নেমে পানির মধ্যে লুকিয়ে থাকে। ধানক্ষেতে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে শুয়ে পড়ে। এরপরে পাক সেনাদের গাড়ি চলে গেলে আমরা হেঁটে সীমান্ত পার হই। আল্লাহর রহমত যে ওরা আমাদের দেখেনি। সেজন্য গুলি ছোঁড়েনি। এখন যতদিন লাগে দেশের স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করব। আর শরণার্থী হয়ে বেঁচে থাকব।
–হ্যাঁ, এমন কথা আমাদের সবার জন্য একই রকম।
–ঠিকই বলেছেন। আপনি কোথায় আছেন?
–আমি এই যশোর রোডেই তাঁবু পেয়েছি।
–তাহলে আপনি তাঁবুতে চলে যান। আমরা ওদেরকে নিয়ে বনগাঁ যাব। আমি অসিত, অধর ও দীপক ও অজয়।
–ঠিক আছে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম। তারপর দেখলাম ওরা একটা ট্রাকে উঠে চলে গেল।
–ভালোই সময় কাটিয়ে এসেছেন আব্বা। আপনার খিদে পেয়েছে।
–অসিত ওদেরকে দুধ-পাউরুটি খাইয়েছে। একই সঙ্গে আমাকেও দিয়েছে। সেজন্য তেমন খিদে পায়নি।
–ঠিক আছে, আমরা তাঁবুতে যাই। আপনার জন্য ভাত রাখা হয়েছে। আপনি খাবেন।
–চলো যাই। মেয়েটার দিকে তাকালে বুক ভেঙে যায়। কষ্টে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনা।
–এসব কথা থাক আব্বা। আমারওতো একই কষ্ট হয়।
–হ্যাঁ, হবেই। তা জানি। চলো এই গাছের নিচে একটু বসে থাকি। তারপর তাঁবুতে যাব। চারদিক থেকে ছুটে আসে মৃদু বাতাস। সামনে দিয়ে বয়ে যায় ছোট নদী বাতাসে তরঙ্গ তুলে। হঠাৎ রবিউল দূরে তাকিয়ে বলে, মারুফ দেখো নদীর ধারে একটি মেয়ে পড়ে আছে।
–তাইতো, তাইতো –বলতে বলতে মারুফ উঠে দাঁড়ায়। পরে বলে, আব্বা চলেন দেখি মেয়েটার কি হয়েছে।
–হ্যাঁ, চলো।
তারা দ্রুতপায়ে হেঁটে মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়ায়। দেখতে পায় মেয়েটি নড়াচনা করে না। তাহলে কি ও অসুস্থ? নাকি মরে গেছে?
মারুফ পাশে বসে কপালে হাত রাখে। একদম ঠান্ডা হয়ে আছে শরীর।
–আব্বা মনে হয় মেয়েটি মরে গেছে।
–বলো কি? ওর সঙ্গে কেউ নেই? বাপ-মা-আত্মীয়স্বজন?
–নিশ্চয়ই আছে। মেয়েটিতো একা সীমান্ত পাড়ি দেবে না।
–চলো, আমরা সরে যাই। ওকে খুঁজতে কেউ এখানে এলে আমাদেরকে দেখে সন্দেহ করবে। কিভাবে মেয়েটি মারা গেল। কে জানে?
রবিউল ও মারুফ আবার সেই গাছতলায় গিয়ে বসে। তখন দেখতে পায় পূর্ণিমা এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছে। একসময় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছুটে যায়। কাছে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে ওর ওপর গড়িয়ে পড়ে। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। চারদিক থেকে নানা লোক এগিয়ে আসে। রবিউল আর মারুফও যায়। সবাই দাঁড়িয়ে থাকে। পূর্ণিমা চিৎকার করে বলে, আমার মেয়েটাকে কে মেরে ফেলল?
কারো মুখে কোনো কথা নেই।
–আপনি ওকে আপনার সঙ্গে রাখেননি কেন?
–রেখেছিলামতো। কেউ একজন ডাকলে ও তার পিছে পিছে যায়। লোকটি বলে, কিছুক্ষণ পরে ওকে আমি দিয়ে যাব।
–ওই লোকের সঙ্গে ওকে যেতে দিলেন কেন?
–ওতো আমাদের সঙ্গেই গ্রাম থেকে এসেছে।
–মেয়ের বাবা কোথায়?
–পথে মরে গেছে। অসুখ ছিল। হাঁটতে পারছিলনা। পূর্ণিমা আবার চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে মেয়ের মাথা কোলে উঠিয়ে নেয়।
–আপনার মেয়ে কি একটাই?
–দুটো ছেলে আছে। মেয়ে একটাই।
–ওরা রাস্তার ধারে বাবাকে মাটির নিচে শুইয়ে দেয়ার জন্য রয়ে গেছে। শেষ করে আসবে। এখানে দাহ করা যাবে না। নাহলে তো বনের জন্তুরা খেয়ে শেষ করবে।
–আপনি কি করছেন?
–আমি রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছি।
–মেয়েকে মাটি চাপা দেয়ার ব্যবস্থা করবেন?
–কেমন করে করব? আমি জানিনা।
–আমরা এখানে একটা গর্ত খুঁড়ে দেব?
–না, দরকার নাই। আমি নদীতে নেমে মেয়েকে ডুবিয়ে দেব। ও নদীর তলে গিয়ে শুয়ে থাকবে। ওকে তো দাহ করা যাবেনা।
–নদীতে আপনার নামতে হবেনা। ওকে নদীতে ভাসিয়ে দিলেই হবে। ডুবে যাবে।
–হায় ভগবান, স্বামী গেল মাটির নিচে। মেয়ে যাবে জলের নিচে। যুদ্ধ, যুদ্ধ। যুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা। দিলাম স্বামীকে, দিলাম মেয়েকে। কারো জন্য শ্মশান নাই।
মারুফ পাশে বসে বলে, আমার ছেলেটিকেও মাটি চাপা দিয়েছি। ওটাকে কবর দেয়া বলেনা। এই সময়ে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবারই একই অবস্থা হবে। বিশেষ করে আমাদের মতো শরণার্থীদের।
–তুমি মেয়েটার পা ধর। আমি মাথা ধরি। চলো নদীতে নামাই। আমার মেয়ের নাম মালতী।
মারুফ ওর পা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে। পূর্ণিমা মাথা জড়িয়ে ধরে নদীতে নেমে যায়। মারুফ ছেড়ে দিলে পূর্ণিমা ওকে জড়িয়ে ধরে। দুজনে ভেসে চলে যায়। একটু পরে আর কাউকে দেখা যায়না। তলিয়ে গেছে নদীতে।
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা দুহাত উপরে তুলে বলে, জয় বাংলা। শরণার্থী শিবির মুখরিত হয় জয় বাংলা ধ্বনিতে।
(চলবে)
এসএ/