ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৫
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
মার্চ মার্সেই পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আর এই মাসেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ভারতে। ইন্দিরা গান্ধী বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে ভারতে ক্ষমতায় আসেন। পরদিন নির্মল, যাদব, অসীম ওদের শরণার্থী কার্ড দিতে এসে এসব কথা মারুফকে বলে।
অসীম বলে, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনার ওপর আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভালোই নজর রাখছেন। তিনি জেনেছেন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় অসংখ্য শরণার্থী ঢুকেছে। সেজন্য তিনি ২৫ মার্চ আদেশ জারী করেন যে, যেসব সীমান্ত দিয়ে শরণার্থী আসবে তা খোলা রাখার জন্য। সবাই যেন নিরাপদে ভারতে ঢুকতে পারে। ৩০ মার্চ তিনি সংসদের উভয় কক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা নিয়ে
ভারত সরকারের মনোভাব প্রকাশ করেন। ভারত পূর্ব বাংলার পাশে থাকবে। সব ধরণের সহযোগিতা দেবে।
মারুফ দুহাত উপরে তুলে বলে, আল্লাহর রহমত। আমাদের সৌভাগ্য। ভারতের সহযোগিতা পেলে যুদ্ধে জিততে আমাদের সময় লাগবে না। আমিও যুদ্ধ করব। ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে?
- আছে, আমরা তোমাকে সেখানে পৌঁছে দেব।
মারুফ ওদের তিনজনেরই হাত জাড়িয়ে বলে, তোমরা আমার আজীবনের বন্ধু হলে। এই জোয়ান বয়সে যুদ্ধ না করে দেশের জন্য কিছু করবনা, তা আমি ভাবতে পারিনা।
-আমরা আশীর্বাদ করি তুমি একজন বীরযোদ্ধা হও।
-তোমাদের প্রধানমন্ত্রী অন্য দেশের জন্য একজন সাহসী মানুষ। মানবিক বিবেচনায় একজন জ্ঞানী মানুষ। আর আমরা নিজেদের দেশের জন্য সাহসী হতে পারবনা!
-কেন পারবেনা, একশোবার পারবে। তোমার মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাতে হবে। আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে বললে নেতারা তোমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাভুক্ত করবে। এটাই নিয়ম বলে আমরা শুনেছি।
-ঠিক আছে নিয়মমাফিক যা করতে হয় আমি তা করব। তোমরা একটু সহযোগিতা কর।
-আমরা দু’একদিনের মধ্যে খবর নিয়ে তোমার এখানে আসব। তুমি অন্য কোথাও যেওনা।
ওদের কথা শেষ হতেই একজন দ্রুতপায়ে ওদের ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
অসীম বলে, আরে রঘু রাই কোথায় যাচ্ছে?
মারুফ জিজ্ঞেস করে, উনি কে?
- উনি একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার। শরণার্থীদের অনেক ছবি তুলেছেন।
মারুফ বলে, ঐ যে লোকজন আসছে সেজন্যই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন।
- ভালোই হলো আমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাঁর কাজ শেষ হলে আমরা কথা বলব।
দারুণ ছবি তোলে রঘু রাই। যশোর রোডে শরণার্থীদের আসার একটা ছবি তুলেছে। মানুষজন পোটলা মাথায় করে হাঁটছে, ছোট বাচ্চাদের ঘাড়ে নিয়ে হাঁটছে। এক হাতে পোটলা ধরে রেখেছে অন্য হাতে হেঁটে যাওয়া শিশুদের হাত ধরে রেখেছে। নারীদের ঘাড়-মাথায় ছোট-বড় পোটলার বোঝা। চমৎকার ছবিটা। সময়ের নিখুঁত চিত্র। স্বাধীন দেশের মানুষেরা এই ছবি থেকে পাবে শরণার্থীদের বেঁচে থাকার খোঁজ। মৃত্যুকে পেছনে রেখে চলছে তারা, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কোথায় গিয়ে ঠাঁই মিলবে সেই নিশ্চয়তা তাদের বুকের ভেতর নেই। তারপরও যেতে হচ্ছে ভারতে।
মারুফ বলে, আমরাওতো এভাবে ছুটে এলাম। আমাদের ভাগ্য যে আমরা নিশ্চয়তা পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মানবিক বোধের তুলনা হয়না। তিনি সীমান্ত খুলে রাখতে বলেছেন। আমাদের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কোনোদিন যদি আমি সামনে পাই তাঁকে তাহলে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করব।
- বাহ, তোমার কৃতজ্ঞতার কথা শুনে আমরা খুবই খুশি হলাম।
ওরা তিনজন একসঙ্গে ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে চলে যায়। মারুফ ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই রাস্তায় কলকাতা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। দেখা যাক ভবিষ্যতে কি হয়। এমন সময় ও দেখতে পায় রঘু রাই ফিরে আসছে। তাকে দেখে কথা বলার জন্য উৎফুল্ল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মারুফ। রঘু রাই কাছে আসতেই বলে, আমি আপনার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। কি ছবি তুলেছেন?
-অনেক ছবি তুলেছি। শরণার্থীদের জীবন আমার কাছে একদম অন্যরকম। এমন জীবন আমি দেখিনি।
-আপনার ছবি ইতিহাসের ছবি হবে।
-হ্যাঁ, তা হবে। বাংলাদেশ যেদিন স্বাধীন হবে তারপরতো শরণার্থীরা দেশে ফিরে যাবে।
-অবশ্যই। আমি যুদ্ধ করে দেশে যাব। শুধু শরণার্থী হব না।
-তাই, দাঁড়ান আপনার একটা ছবি তুলি।
মারুফ নিজেরদের তাবুর দিকে পিঠ ঘুরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। রঘু রাই তাবুসহ চারপাশের লোকজন নিয়ে ছবি ওঠায়। পুরো শরণার্থী শিবিরের চমৎকার একটি ছবি ওঠে। দেখে খুশি হয় রঘু রাই। মারুফকে বলে, আজকে আমি যাচ্ছি। এরপরে কখনো-কোথাও দেখা হতে পারে। আমিতো বিভিন্ন জায়গায় ঘুরি। বেশ অনেক শরণার্থী শিবির আমার দেখা হয়েছে। যশোর রোডে আমি আবার আসব। আমার জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাড়িটা ছাড়তে হবে সেজন্য চলে যাচ্ছি। ছবিগুলো বিভিন্ন কাগজে ছাপা হবে।
-আপনাকে সালাম জানাই যে আপনি আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস সজীব রাখছেন।
রঘু রাই হেসে মাথা নাড়ে। মারুফের হাত ধরে বলে, গুড বাই। ভালো থাকুন, বীর যোদ্ধা হন। স্বাধীন দেশের মানুষ হন। যাচ্ছি।
মারুফের হাত ছেড়ে গাড়িতে গিয়ে ওঠে রঘু রাই। গাড়ি ছেড়ে যায়। মারুফ তাকিয়ে থাকে। নিজেকে বলে, ও আমার শরণার্থী জীবনের বড় অভিজ্ঞতা। রঘু রাই তোমাকে আমি ভুলবনা কোনোদিন।
মারুফ নিজের তাঁবুতে এসে ঢোকে। আসমানী ঘাসের ওপর বিছিয়ে দেয়া একটি শাড়ির উপর শুয়ে আছে। মাথার নিচে বালিশ নেই। শুকনো মুখে তাকায় মারুফের দিকে। মারুফ ওর মাথার কাছে গিয়ে বসে কপালে হাত রাখে। পাশে বসে আছে দুলাল।
-মা কৈ রে দুলাল?
-বাইরে গেছে। আমাকে বলেছে আপুর কাছে বসে থাকে। একটু পরে লোক এসে আমাদেরকে খাবার দিয়ে যাবে। সেজন্য বলে গেছে সবাই যেন তাঁবু থেকে বেরিয়ে না যায়।
-তোর খিদে পেয়েছে দুলাল?
-না, পায়নি। মায়ের কাছে যেটুকু ভাত ছিল তাতো আমরা সবাই খেলাম দুলাভাই। আপনার খিদে পেয়েছে?
-হ্যাঁ, আমার খুব খিদে পেয়েছে। আসমানী তোমার খিদে পেয়েছে?
-না, আমার খুব খিদে পায়নি। আমিও মায়ের কাছ থেকে দুই মুঠো ভাত খেয়েছি।
-শরীর ভালো বোধ করছ?
-আগের চেয়ে একটু বেশি ভালোলাগছে। বিশ্বাস পাওয়ার পরে। কিন্তু ছেলে হারানোর কষ্ট আমাকে ছাড়ছে না।
-কিছু করার নেই গো। আমাকেও ছাড়ছে না।
দুলাল কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমাকেও ছাড়ছে না, দুলাভাই। এই ছোট্ট মানুষটি থাকলে এই তাঁবুটা আমার কাছে ফুলের বাগান হয়ে থাকত।
-কাঁদিস না রে ছোট্ট সোনা।
মারুফ নিজেও কাঁদতে কাঁদতে বলে। কাঁদতে শুরু করে আসমানীও। সবাই দুহাতে মুখ ঢেকে রেখেছে। কেউ কারো দিকে তাকায়না।
তখন তাঁবুতে ঢুকে আকাশী। ওদের অবস্থা দেখে বুঝতে পারে কি হয়েছে ওদের। সন্তানের জন্য কাঁদছে মারুফ। আকাশী আসমানীর পায়ের দিকে বসে পড়ে। আসমানী চোখ খুলে বলে, মা, মাগো।
-তোকে সব কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে মা। কষ্ট ধরে রাখলে শরণার্থী শিবিরের কষ্টও বেড়ে যাবে।
আসমানী কথা বলেনা। চুপ করে থাকে। মারুফ দু’হাতে চোখ মুছে শাশুড়ির দিকে তাকায়।
-চারপাশে একটু হেঁটে দেখলাম এখানকার সবার কি অবস্থা।
-আমাদেরকে নাকি ভাত দেয়া হবে?
-হ্যাঁ, বলে গেছে। একটু পরে আসবে।
-আমি ইন্দিরা গান্ধীর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে সালাম করতে চাই বাবা। শুনতে পেলাম অনেকের মুখে যে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢুকছে ভারতে। তিনি তাঁদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। হায় আল্লাহ, এমন একজন মানুষকে চোখে না দেখলে আমার কষ্ট ফুরাবেনা।
কথা শেষ করে আকাশী হাঁটুর উপর মাথা রাখে। অন্যরাও নিশ্চুপ থাকে। শরণার্থী জীবনের এমন একটি সময় গ্রাম ছেড়ে আসা কয়েকজন ভাবে, স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে গেলে প্রাণপ্রিয় ইন্দিরা গান্ধীকে নিজের দেশে নিয়ে অনেক সম্মান দেখাব। বলব, আপনি আমাদের মা। আকাশী নিজের ভাবনায় অন্যদের কথার সঙ্গে নিজেকে এক করে। ভাবনা গেঁথে থাকে মাথায়।
তখন তাঁবুর সামনে এসে দাঁড়ায় একজন। মারুফ উঠে সামনে যায়। লোকটি খাবারের পোটলা দিয়ে বলে, আপনাদের খাবার।
-আপনারা কয়জন আছেন তাঁবুতে?
-পাঁচজন।
-হয়ে যাবে। সবাই পেট ভরে খেতে পারবেন।
-খাবারের পোটলাটি হাতে নিয়ে মারুফ ভাবে, লোকটি সান্ত¡নার কথা বলে গেল। কোনোরকম খাওয়া হবে। পেট ভরানো নয়। কারণ পোটলার ওজন তেমন নয়। যাহোক, তবুতো কিছু খাবার পাওয়া গেছে। লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, আপনার নাম কি দাদা?
-হরিহর। দু’একদিনের মধ্যে আমি আবার আসব। আপনাদেরকে শরণার্থী কার্ড দেয়া হবে। এই কার্ডের প্রমাণে আপনাদের চাল, ডাল, আলু, তেল ইত্যাদি রিলিফ দেয়া হবে। আপনাদের থালা, গ্লাস, হাঁড়ি, বালতি ইত্যাদি দেয়া হবে। নিজেরা রান্না করে খাবেন। আমি যাচ্ছি এখন।
লোকটি চলে যায়। মারুফ তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখে হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত পার হয়ে যশোর রোডে ঢুকছে। ও চারদিকে তাকিয়ে নিজের শ্বশুর রবিউলকে খোঁজে। তিনি কোনদিকে গেছেন এখনো জানতে পারেনি। মারুফ হঠাৎ করে দেখতে পায় তার শ্বশুর আসছে। ও দ্রæত পা চালিয়ে তার কাছে যায়।
- আব্বা আপনি কোথায় ছিলেন?
-খানিকটা দূরে ওই পাশে ছিলাম। আমার এক চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। সেজন্য কিছু সময় কাটালাম ওর সঙ্গে। ওর এখানে আসার অভিজ্ঞতা খারাপ।
-কি হয়েছিল আব্বা?
(চলবে)