ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব: ১৫
অঘ্রানের অন্ধকারে
নিয়ম মেনে চলতে হয়। সবাইকে ‘ভাই’ আর ‘আপনি’ বলে কথা বলতে হয়। রাতের শিফটে গ্রুপ ভাগ করে পাহারার ব্যবস্থা থাকে। অনেকগুলো গ্রুপ আছে। কিচেন গ্রুপ, তরিতরকারি রেডি করা গ্রুপ, টয়লেট পরিষ্কার করা গ্রুপ। গ্রুপের কাজ প্রতি সপ্তাহে পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। কিচেন গ্রুপকে ভোরবেলা উঠে চুলা জ্বালিয়ে রুটি বানাতে হয়। ঘুরেফিরে সবাই সব কাজ করে।
বেলা এগারোটায় চা-মুড়ি। বারোটায় মাদক গ্রহণের কুফল নিয়ে ক্লাস। ভাত রান্নার চাল বেছে পরিষ্কার করা লাগে। সেই চালে ভাত রান্না হয়। খাওয়ার সময় প্রার্থনা করা লাগে। খাবারের প্রার্থনা। হে সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা, এই সুন্দর সকালে/দুপুরে/রাতে যে খাবার তুমি আমাদের দিয়েছ তার জন্য তোমাকে জানাই ধন্যবাদ...।
ভাত খেয়ে বিশ্রাম। ঘর পরিষ্কার করা, ব্যায়াম সেরে বিকাল তিনটায় গোসল। গোসলের সময় দুই মিনিট। বিকেলে গান-বাজনা করা যায়। রাতে টিভি দেখে প্রার্থনার পর ঘুম। সপ্তাহে একদিন ফুটবল খেলতে দেয়।
সাতদিন পর শাবিন তার অনুভূতি লিখল, এই স্থানে আসা আমার সাত দিন হলো। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগলেও এখন অনেকটা সয়ে গেছে তাই বিভিন্ন ক্লাস, সেশনের পাশাপাশি আনন্দের সাথেই দিন কেটে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড়ো কথা আমি নেশামুক্ত অবস্থায় দিন যাপন করছি। এটা এক বড়ো ব্যাপার। জীবন কতটা নিয়মের মাঝে, সময়ের সাথে সৎ ও সুন্দরভাবে চলতে পারে তা এই সেন্টারে না এলে জানতে ও বুঝতে পারতাম না। এখানে অনেক বিষয়ই পরিপূর্ণভাবে ভালো লাগে না, তবুও নিয়ম অনুযায়ী তা মানতে হয়। আর আমি এখানে নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
দুই সপ্তাহ পর শুক্রবার সকাল দশটায় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার নিয়ম। দুই সপ্তাহ পর শাবিন রাতে তার অনুভূতি লেখা খাতায় লিখল, আজ আমার প্রথম ‘দেখা’ ছিল। মা এসেছিলেন দেখা করতে। মায়ের শরীর অনেক খারাপ হয়ে গেছে। আমি আগে খেয়াল করিনি। চোখের নিচে গাঢ় কালি। মাথার চুলগুলো সব পেকে গেছে। চোখে কেমন দিশেহারা ঘোলাটে ভাব। তুরি আসেনি। মায়ের ফোনে তুরির সঙ্গে কথা বললাম। মনটা ভালো। মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। পনেরো দিন পর মায়ের মুখ দেখলাম। আবার মনটা খারাপ। তুরির কথা শুনতে পাইনি। তুরি ফোন ধরে কাঁদছিল। খুব কাঁদছিল। সে কথা বলতে পারেনি। তুরি কেন কাঁদছিল?
আজ মায়ের সঙ্গে চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যাওয়া হলো না। আমার থাকার মেয়াদ শেষ হতে আরও দুই সপ্তাহ বাকি আছে। তারপর যাওয়া যাবে বাড়িতে। বুঝতে পারছি না, দুই সপ্তাহ থাকব নাকি আগামী সপ্তাহে বাড়ি চলে যাব?
একাদশতম দিনে শাবিন তার খাতায় লিখেছে, আজ সেন্টারে আমার একাদশতম দিন। গত ১০টা দিন খুব দ্রুত পার হয়ে গেল। আর তেরো দিন পর আমি বাসায় ফিরে যেতে পারব। আমি নিজে খানিকটা অসুস্থ। এ ছাড়া প্রেশার ও ড্রাগস ফ্রি ওষুধের প্রভাবে আমি ক্লান্ত প্রাণ এক। তুরির কথা মনে পড়ে খুব- বারবার, বারবার। যদিও আমি এখানে আনন্দে আছি তবুও আমার মানসিক অবস্থা খারাপ। এখানে ক্লাস বা অন্যান্য কাজ সবই নিয়মমাফিক ও ভালো তবু আমার চিন্তা-ভাবনা নিম্নমুখী হয়ে যাচ্ছে। সুস্থ থাকা, আত্মবিশ্বাসী হওয়া ও উঁচু মানসিকতার প্রয়োজন এখন আমার। এছাড়াও নিজ সততার ওপর স্থির দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন জরুরি আমার জন্য।
শাবিন তার খাতায় লিখেছে, আমি এখানে আছি কারণ অবশেষে আমি আমার নিজের কাছেই আশ্রয়হীন। যতক্ষণ না আমি মুখোমুখি হই অন্যের অন্তরে ও চোখে। আমি পালাচ্ছি। যতক্ষণ না আমি তাদের ভোগাই, আমার গুপ্তকথা সহভাগিতা করার জন্য। তাদের কাছ থেকে আমার কোনো নিরাপত্তা নেই। পরিচিত হতে ভীত থাকলে কখনো নিজেকে বা অন্য কাউকে চিনতে পারব না। আমি হব একা। আমার এই সাধারণ ভূমি ব্যতিত কোথায় আমি এমন আয়না পাব! এখানে একসাথে নিজের কাছে স্পষ্টভাবে আবির্ভাবিত হতে পারব! আমার স্বপ্নের দানবের মতো নয়, নয় ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় বরং একজন ব্যক্তি হিসেবে একটি সমগ্রের অংশ হয়ে যেখানে আমার অংশের একটি কারণ আছে। এই ভ‚মিতে আমি আমার শেকড় ছড়াতে পারব এবং বেড়ে উঠব। আর একা নয় মৃতের মতো বরং জীবন্ত আমার নিজের কাছে এবং অন্যের কাছে।
এ পর্যন্ত লিখে লম্বা শ্বাসে বুকের ভেতর বাতাস টেনে নিলাম। ভালো লাগছে। প্রশান্তি বোধ করছি।
নিয়ম মেনে চলতে হয়। সবাইকে ‘ভাই’ আর ‘আপনি’ বলে কথা বলতে হয়। রাতের শিফটে গ্রুপ ভাগ করে পাহারার ব্যবস্থা থাকে। অনেকগুলো গ্রুপ আছে। কিচেন গ্রুপ, তরিতরকারি রেডি করা গ্রুপ, টয়লেট পরিষ্কার করা গ্রুপ। গ্রুপের কাজ প্রতি সপ্তাহে পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। কিচেন গ্রুপকে ভোরবেলা উঠে চুলা জ্বালিয়ে রুটি বানাতে হয়। ঘুরেফিরে সবাই সব কাজ করে।
বেলা এগারোটায় চা-মুড়ি। বারোটায় মাদক গ্রহণের কুফল নিয়ে ক্লাস। ভাত রান্নার চাল বেছে পরিষ্কার করা লাগে। সেই চালে ভাত রান্না হয়। খাওয়ার সময় প্রার্থনা করা লাগে। খাবারের প্রার্থনা। হে সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা, এই সুন্দর সকালে/দুপুরে/রাতে যে খাবার তুমি আমাদের দিয়েছ তার জন্য তোমাকে জানাই ধন্যবাদ...।
ভাত খেয়ে বিশ্রাম। ঘর পরিষ্কার করা, ব্যায়াম সেরে বিকাল তিনটায় গোসল। গোসলের সময় দুই মিনিট। বিকেলে গান-বাজনা করা যায়। রাতে টিভি দেখে প্রার্থনার পর ঘুম। সপ্তাহে একদিন ফুটবল খেলতে দেয়।
সাতদিন পর শাবিন তার অনুভূতি লিখল, এই স্থানে আসা আমার সাত দিন হলো। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগলেও এখন অনেকটা সয়ে গেছে তাই বিভিন্ন ক্লাস, সেশনের পাশাপাশি আনন্দের সাথেই দিন কেটে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড়ো কথা আমি নেশামুক্ত অবস্থায় দিন যাপন করছি। এটা এক বড়ো ব্যাপার। জীবন কতটা নিয়মের মাঝে, সময়ের সাথে সৎ ও সুন্দরভাবে চলতে পারে তা এই সেন্টারে না এলে জানতে ও বুঝতে পারতাম না। এখানে অনেক বিষয়ই পরিপূর্ণভাবে ভালো লাগে না, তবুও নিয়ম অনুযায়ী তা মানতে হয়। আর আমি এখানে নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
দুই সপ্তাহ পর শুক্রবার সকাল দশটায় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার নিয়ম। দুই সপ্তাহ পর শাবিন রাতে তার অনুভূতি লেখা খাতায় লিখল, আজ আমার প্রথম ‘দেখা’ ছিল। মা এসেছিলেন দেখা করতে। মায়ের শরীর অনেক খারাপ হয়ে গেছে। আমি আগে খেয়াল করিনি। চোখের নিচে গাঢ় কালি। মাথার চুলগুলো সব পেকে গেছে। চোখে কেমন দিশেহারা ঘোলাটে ভাব। তুরি আসেনি। মায়ের ফোনে তুরির সঙ্গে কথা বললাম। মনটা ভালো। মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। পনেরো দিন পর মায়ের মুখ দেখলাম। আবার মনটা খারাপ। তুরির কথা শুনতে পাইনি। তুরি ফোন ধরে কাঁদছিল। খুব কাঁদছিল। সে কথা বলতে পারেনি। তুরি কেন কাঁদছিল?
আজ মায়ের সঙ্গে চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যাওয়া হলো না। আমার থাকার মেয়াদ শেষ হতে আরও দুই সপ্তাহ বাকি আছে। তারপর যাওয়া যাবে বাড়িতে। বুঝতে পারছি না, দুই সপ্তাহ থাকব নাকি আগামী সপ্তাহে বাড়ি চলে যাব?
একাদশতম দিনে শাবিন তার খাতায় লিখেছে, আজ সেন্টারে আমার একাদশতম দিন। গত ১০টা দিন খুব দ্রæত পার হয়ে গেল। আর তেরো দিন পর আমি বাসায় ফিরে যেতে পারব। আমি নিজে খানিকটা অসুস্থ। এ ছাড়া প্রেশার ও ড্রাগস ফ্রি ওষুধের প্রভাবে আমি ক্লান্ত প্রাণ এক। তুরির কথা মনে পড়ে খুব- বারবার, বারবার। যদিও আমি এখানে আনন্দে আছি তবুও আমার মানসিক অবস্থা খারাপ। এখানে ক্লাস বা অন্যান্য কাজ সবই নিয়মমাফিক ও ভালো তবু আমার চিন্তা-ভাবনা নিম্নমুখী হয়ে যাচ্ছে। সুস্থ থাকা, আত্মবিশ্বসী হওয়া ও উঁচু মানসিকতার প্রয়োজন এখন আমার। এছাড়াও নিজ সততার ওপর স্থির দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন জরুরি আমার জন্য।
শাবিন তার খাতায় লিখেছে, আমি এখানে আছি কারণ অবশেষে আমি আমার নিজের কাছেই আশ্রয়হীন। যতক্ষণ না আমি মুখোমুখি হই অন্যের অন্তরে ও চোখে। আমি পালাচ্ছি। যতক্ষণ না আমি তাদের ভোগাই, আমার গুপ্তকথা সহভাগিতা করার জন্য। তাদের কাছ থেকে আমার কোনো নিরাপত্তা নেই। পরিচিত হতে ভীত থাকলে আমি কখনো নিজেকে বা অন্য কাউকে চিনতে পারব না। আমি হব একা। আমার এই সাধারণ ভ‚মি ব্যতিত কোথায় আমি এমন আয়না পাব! এখানে একসাথে নিজের কাছে স্পষ্টভাবে আবির্ভাবিত হতে পারব! আমার স্বপ্নের দানবের মতো নয়, নয় ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় বরং একজন ব্যক্তি হিসেবে একটি সমগ্রের অংশ হয়ে যেখানে আমার অংশের একটি কারণ আছে। এই ভ‚মিতে আমি আমার শেকড় ছড়াতে পারব এবং বেড়ে উঠব। আর একা নয় মৃতের মতো বরং জীবন্ত আমার নিজের কাছে এবং অন্যের কাছে।
এ পর্যন্ত লিখে লম্বা শ্বাসে বুকের ভেতর বাতাস টেনে নিলাম। ভালো লাগছে। প্রশান্তি বোধ করছি।
(চলবে)