ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব: ১০
অঘ্রানের অন্ধকারে
চার বছর পর তুরির সঙ্গে শাবিনের দেখা হলো কাকতালীয়ভাবে কিংবা নিয়তি তাদের আবার মিলিয়ে দিয়েছে। তাদের দেখা হলো অফিসে। শাবিন অ্যাডভার্টাজিং ফার্মে চাকরি করে। তুরি সেখানে চাকরি করতে এসেছে। সে জানত না শাবিন এখানে আছে। এসে জেনেছে। দেখা হওয়া মাত্র তুরি বলে উঠল, আরে শাবিন ভাই, আপনি এখানে?
তুমি এখানে কেন?
চাকরিতে জয়েন করেছি।
এই অফিসে? কোন সেকশনে?
ক্রিয়েটিভ।
তুরির ভেতর কোনো আড়ষ্টতা দেখা গেল না। যেন সবকিছু স্বাভাবিক ছিল এখনো তেমনি আছে। তার উচ্ছলতা দেখে শাবিনের আগের কথা জিগ্যেস করতে ইচ্ছে হলো না। এতদিন কোথায় ছিল, সেই কথা জানতে গিয়ে তুরি যদি আবার হারিয়ে যায়!
আচমকা দেখা গেল শাবিন দুদিন অফিসে আসেনি। তার ফোন বন্ধ। কেউ শাবিনের কোনো খোঁজ দিতে পারল না। তুরির ভেতর অস্থিরতা দেখা দিলো। মনে হলো শাবিন প্রতিশোধ নিচ্ছে তারওপর।
শাবিনের সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতরে সিলিং ফ্যানটা ঘটাং ঘটাং করে পাক খাচ্ছে। মোনালিসার ছবি কে এঁকেছে মনে আসছে না কিছুতেই। পাবলো পিকাসো, মিকেলেঞ্জেলো, না লুই কান? নাহ্, লুই কান তো সংসদ ভবনের নকশা এঁকেছেন। ‘মোনালিসা’ পাবলো পিকাসো এঁকেছে শুনে তুরি রেগেমেগে উঠে চলে গেছে। এখন নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে শাবিনের।
কেন সে তুরিকে বলতে গেল, বাহ্! অদ্ভুত।
তুরিও তখন জানতে চাইল, কী?
শাবিন আগ্রহ নিয়ে বলল, হাসিটা। মোনালিসার মতো লাগছে।
জ্বর মনে হয় আরও বেড়েছে। মা বাড়িতে নেই। নানার বাড়িতে গেছে দুদিন হলো। সেখানে মামাতো দুই ভাই-ভাবি আর তাদের ছেলেমেয়েরা থাকে। মায়ের ফিরতে দেরি হতে পারে। জমি বিক্রির কথা হচ্ছে। নানার রেখে যাওয়া জমি আছে সামান্য। মামাতো দুইভাই দখল করে রেখেছে। সেই জমি নিয়ে নানান তালবাহানা করছে। মা জমি বেচতে চায়। তারা জমি বেচতে দেয় না।
মাথায় পানি দিতে পারলে ভালো লাগত। দুটো প্যারাসিটামল খাওয়ার পর হড়হড় করে বমি হয়ে গেল। শাবিনের মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে।
কুয়াশার ভেতরে শাবিন দেখল নদীতে নৌকা ভাসছে। নৌকাটা দুলছে। তুরি বসে আছে নৌকার গলুইয়ে। ছোট্ট নৌকা। তাতে পাল তোলা। বাতাসে নৌকার পাল ফুলে আছে।
তুরির পরনে সাদা শাড়ি। তার ভেতরে সাদা সুতোর কাজ। চওড়া সবুজ পাড়। কপালে সবুজ টিপ। তুরির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে শাবিন। চোখের পাতা দুটো ভীষণ ভারী লাগছে। আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে আসছে চোখের পাতা। নৌকা ঢেউয়ে দুলছে। শাবিন চোখ বন্ধ করেই বলল, দুই ধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। তোমাকে কাশফুলের মতো লাগছে।
ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো তখন। চোখেমুখে বৃষ্টির ছাট্ ভালো লাগছে শাবিনের। বৃষ্টির পানিতে মাথা ভিজে যাচ্ছে। মাথার ভেতর ঠান্ডা হয়ে আসছে।
শাবিন আলতোভাবে চোখ মেলে তাকাল। তুরি তার মাথায় পানি ঢালছে। গলার ভেতরটা শুকনো। খুসখুস করছে। শাবিন ঠোঁট নাড়াল। পানি খাবে। তুরি ঝুঁকে এলো শাবিনের মুখের কাছে। শাবিন বিড়বিড় করে বলল, মোনালিসার ছবি এঁকেছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। আমার যখন অনেক টাকা হবে তখন ল্যুভ্র মিউজিয়ামে যাব। প্যারিসে।
ল্যুভ্র মিউজিয়াম যে প্যারিসে সেটা জানি।
আমরা কি এখন ঝগড়া করব?
দুদিন হলো জ্বর হয়েছে। মা বাড়িতে নেই। একটা খবর দেওয়া না। ওষুধ না। খাওয়া না।
শাবিন বলল, পানি খাব। মাথায় আর পানি দেওয়ার দরকার নেই। গা ঘামছে।
শাবিনের মাথার নিচ থেকে কুণ্ডলি পাকানো তোয়ালে বের করে আনল তুরি। শাবিনের হাতে দিলো। গা থেকে চাদরটা সরিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বিছানার ওপর উঠে বসেছে শাবিন। সে বিছানায় বসে আছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে।
তুরি টেবিলের ওপর রাখা জগ থেকে পানি ঢেলে পানিভরতি গ্লাস শাবিনের হাতে দিলো। তারপর মাথা ধোয়ানো বালতি টেনে বাথরুমে রেখে এলো। ভেজা পলিথিন বারান্দায় মেলে ছুরি দিয়ে বাতাবি লেবু কাটতে বসল।
তুরি বাতাবি লেবুর খোসা ছাড়িয়ে সুন্দর করে প্লেটে সাজাচ্ছে। কী অপূর্ব সুন্দর। শাবিনের মনে হলো পৃথিবীর জন্ম বুঝি এখান থেকেই। তুরির হাতে গোলাপী আভায় ভরে উঠেছে প্লেট।
শাবিনের মনের ভেতর দুলে উঠেছে। ছলকে উঠেছে নদীর ঢেউয়ের মতো। শান্ত হতে চাইল শাবিন। ডাঙায় নোঙ্গর ছুড়ে দিলো। বিপন্ন মনটাকে শক্ত করে বেঁধে ফেলল।
শাবিন ভাবল, আজ পর্যন্ত কোনো প্রতিজ্ঞা সে শেষ অবধি রাখতে পারেনি। এবার ধনুকভাঙা পণ করছে, লেখালেখিটা সিরিয়াসলি করবে। সে এমনকিছু করবে না যাতে অন্যের কষ্ট হয়। নিজের জন্য না হলেও তুরির জন্য সে ভালো হয়ে থাকবে।
অফিসের কেউ জানে এখানে আসার কথা? মাথার ভেজা চুলে আঙুল চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করল শাবিন।
তুরির সবচেয়ে বিশ্রী লাগে মিথ্যা বলা। এখন তাকে সেই মিথ্যা কথাটাই বলতে হবে অফিসে গিয়ে, ব্যাংকে যা ভিড়। মানুষগুলোও হয়েছে সে রকম। প্রাইভেট ব্যাংকেও যে মানুষ এত ঢিমেতালে কাজ করে জানা ছিল না।
শাবিন চোখ বন্ধ করে আছে। তুরি তাকিয়ে আছে তারদিকে। খানিকবাদে শাবিন চোখ মেলে তাকাল। তুরির চোখে চোখ রেখেছে। ধীরে আস্তে বুকের ভেতর থেকে বাতাস টেনে এনে প্রতিটি শব্দ আলাদাভাবে উচ্চারণ করে স্পষ্ট গলায় বলল,
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়-
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে- খুঁজেছি তোমারে সেইখানে
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রানের অন্ধকারে
তুরি দ্রুত শাবিনের বাসার গলি পার হওয়ার চেষ্টা করছে। এই গলির ভেতরে এলে কেমন জানি অস্বস্তি লাগে। গলিটা একদম ফাঁকা। সামনে-পেছনে কোথাও রিকশা দেখা যাচ্ছে না।
যুক্তি ছাড়া কোনো কাজ করা অপছন্দ তুরির। অথচ সে রকম কাজই সে করছে। শাবিনকে এমনভাবে প্রশ্রয় দেওয়া যে একেবারেই যুক্তিহীন অকাজ, এটা তুরি জানে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাকি জীবন একা থাকবে। নিজের জীবনের সঙ্গে আর কারও জীবন জড়াবে না।
জ্বর হয়েছে, ডাক্তার দেখাবে, ডেঙ্গু-টাইফয়েড কিছু হয়ে গেলে হাসপাতালে ভর্তি হবে, ব্যস। করোনা টেস্ট করানো দরকার। এ নিয়ে তার মাথাব্যথা হওয়ার কথা নয়। এ শহরে শাবিনের একেবারে কেউ নেই তা তো না। মা গেছে বাবার বাড়িতে। দূরের হোক কাছের হোক আত্মীয় তো কেউ আছেই। পাঁচজন না হোক, দুজন তো আছে। অসুখ-বিসুখ হলে তারা খোঁজ নেবে।
তুরি নিজের আচরণে নিজেই খুব অবাক হচ্ছে। সে কেন শাবিনের খোঁজে এখানে এসে তার মাথায় পানি ঢালবে। আবার বলে কি, হালিম খেতে ইচ্ছে করছে। মামা হালিম।
অদ্ভুত এক মানুষ এই শাবিন। এলভিস প্রিসলি কিংবা বব ডিলানের নামই শোনেনি কখনো। চাকরি করে অ্যাডভার্টাইজিং ফার্মে। এরা গান গায়, না অভিনয় করে সে প্রশ্ন তো শাবিনের কাছে অবান্তর। সান ফ্লাওয়ার আর টাইটানিক ছাড়া জীবনে তৃতীয় কোনো ইংরেজি ছবি দেখেছে বলে মনে হয় না। এখন মনে হয় ওয়েব সিরিজে মানি হেইস্ট দেখেছে। লা কাসা দে পাপেল।
তবে কবিতা লেখার মতো সহজাত গুণ আছে শাবিনের। আকাশে মেঘ করলে লিখে ফেলতে পারে,
মেঘ করেছে মেঘ করেছে
মেঘ করেছে আজ
রোদ হাসেনি সুর ভাসেনি
পাখির ঠোঁটে লাজ।
পনেরো বছর বয়সে বেখেয়ালে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার পর থেকে কড়াকড়ি শাসনে নিয়ম মেনে বড়ো হতে হয়েছে তুরিকে। মায়ের শাসন ছাড়িয়ে একসময় বড়ো বোনের শাসনে এসে পড়তে হয়েছে। শুনতে হয়েছে এটা করা যাবে না, ওটা বলা যাবে না। লেখাপড়ার জন্য ছাড়া বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে তার যাওয়া হয়নি কতদিন। সামনে বসে একজন মানুষ কবিতা লিখছে, এটা দেখে দারুণ ইমপ্রেসড সে। ব্যাপারটা রীতিমতো এক্সাইটিং মনে হয়েছে তার কাছে।
কিছু কথা একান্তে নিজের ভেতর রেখে দিতে ভালো লাগে। শাবিনের যে এমন গুণ আছে সেটা সে সিলভিয়াকে জানাতে চায়নি। এটা শুধু তার একান্তের। সে লালন করবে, পালন করবে। তারপর একসময় ছড়িয়ে দেবে। যখন ছড়িয়ে দেওয়ার মতো পরিপক্ক হবে।
শাবিনের ইচ্ছে হলে লেখে, না হলে নেই। বলে, আমার লেখা হচ্ছে অমূল্য। পয়সা দিয়ে কেনা যায় না। বই মেলায় গিয়ে টাকা বের করলেই শামসুর রাহমান কিংবা টোকন ঠাকুরের লেখা বই পাওয়া যেতে পারে। আমার লেখা টাকা দিলেও কেনা যায় না। বোকা বোকা কথাবার্তা। তাও আবার যা লেখে তা তো দু-একটা বাদে বেশিরভাগই ওই- ‘গাছের পাতা খাচ্ছে টেনে ছাগল/তোমার জন্যে কন্যা আমি পাগল’ টাইপের।
ও আসলে বোকাই একটা। এর আগে শাবিন যে অফিসে চাকরি করত সেখানে লাবণী নামে তার এক কলিগ ছিল। হঠাৎ কোনো খবর না দিয়ে লাবণী একবার ১০ দিন অফিস কামাই দিলো। ১০ দিন পরে এসে জানাল সে বিয়ে করেছে, পালিয়ে।
উইদাউট নোটিশে অফিসে না আসার জন্য লাবণীর চাকরি চলে গেল। ম্যানেজমেন্ট ডিসিশান। সবাই যখন ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিল তখন শাবিন কথা বলতে গেল লাবণীর হয়ে।
শেষমেশ শাবিনের চাকরিও গেল অসদাচরণের দায়ে। তখন তখনই কোথাও পছন্দসই চাকরি না পেয়ে সে টেলিভিশনের জন্য নাটক বানাতে শুরু করল। অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর। একদিন ডিরেক্টর হয়ে ফাটাফাটি রকমের ফিল্ম তৈরি করবে। সত্যজিৎ রায়ের ছেলে হবে!
তাও যদি টাকা-পয়সা ঠিকমতো পেত। দিচ্ছি-দেব করে মাস কাবার। দিন-রাত খাটিয়ে বেচারাকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলল। এই সাধারণ হিসাবটুকুও তার মাথায় ঢোকে না।
শাবিনকে দেখে তুরির মনে হয় ওর সরলতা সব সময়ই বোকামির পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। এই বোকা মানুষটার জন্য মাঝেমধ্যেই তাকে অফিসে মিথ্যা বলতে হয়- একটু ব্যাংকে যাব, টাকা তুলতে হবে।
শাবিনও কোন ছল করে অফিস থেকে বের হয়ে আসে। দুজন কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে। কথা বলে।
শাবিন একজন ভালো মানুষ, সৃষ্টিশীল মানুষ- শাবিনকে প্রশ্রয় দেওয়ার এটাই কি একমাত্র যুক্তি! নাকি পুরোটাই অযৌক্তিক, অর্থহীন ছেলেমানুষী? যুক্তিগুলোর গোড়ার মাটি সরে গিয়ে কেমন নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে সব। নাহ্, আর না, এবার শক্ত করে বাঁধতে হবে নিজেকে।
তুই কি ভুলে গেলি নদীর ভাঙন, কালবৈশাখী, সমুদ্রের সেই জলোচ্ছাস! অন্ধকারের ভেতর জ্বলে ওঠা আগুন। গনগনে লাল আকাশে মেঘের গর্জন আর পানির তাণ্ডবে ভেসে যাওয়া সময়। ভুলে গেলি তুই ভয়ঙ্কর সেই নিশ্বাসে বুকের ওঠানামার তীব্র দাহন? নিজের ভেতরে কথা বলে ওঠে তুরি।
কী রকম বোকার মতো না পাওয়ার কথাগুলো বলে শাবিন। খুব ছোটোবেলায় ফুটবল আর তিন চাকার সাইকেলের শখ ছিল। বাবা কোনোদিন কিছু খেয়াল করতেন না। বাবাকে প্রচণ্ড ভয় পেত, তবু আশ্চয্য ব্যাপার হচ্ছে বাবার কাছেই ছিল তার আনন্দ। মায়ের মুখ দেখে বুঝত ভয়ে শিটিয়ে আছে। ওই বয়সেই বুঝেছে যে নিজে ভয়ে শিটিয়ে থাকে তার কাছ থেকে পাওয়ার কিছু নেই।
অন্যের কাছ থেকে চেয়ে আনা পুরোনো বই পড়তে ভালো লাগত না। তুরির সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেও ইচ্ছে হতো বৃষ্টির ভেতর চলন্ত রিকশার হুড ফেলে আইসক্রিম খেতে। কফি শপে বসে ফেনা ওঠা কফির মগ সামনে নিয়ে কারও সাথে গল্প করতে।
তুরির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তার স্বপ্নগুলো সে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এর আগে একবার লেখালেখির স্বপ্নটাকেও ছুঁয়ে ফেলেছিল প্রায়। অনার্সে ওর সাথে ভর্তি হয়েছিল অমিতাভ। খুব ভালো বন্ধু ওর। ওরা দুই বন্ধুতে মিলে ভার্সিটি হলে দেয়াল পত্রিকা বের করত।
অমিতাভ লিখত চমৎকার। শাবিনকে উৎসাহ দিত লিখতে। শাবিন লিখত। ফর্ম আর কনটেন্ট নিয়ে তর্ক করে দুপুর কাটাত দুই বন্ধু। শিল্প কি অনুকৃতি না বিকৃতি- দিনের পর দিন এই নিয়ে কথা চালিয়ে যেত।
দেড় বছরের মাথায় অমিতাভ চলে গেল সুইডেন, কাকার কাছে। ওখানে পড়বে। একা একা লিখতে আর ভালো লাগত না শাবিনের। অমিতাভের মতো করে তো ওকে আর কেউ বুঝবে না। ওর একমাত্র চাওয়া, ভালোবাসা আর স্বপ্নমাখা লেখালেখির ইতি ঘটল সেখানে।
তুরির ভাবনাটাও খুব সরল। এত না পাওয়ার ভেতর থেকে মানুষটাকে স্বপ্ন ছুঁতে সাহায্য করা। তুরি বেতের সেলফ্ কিনে দিয়েছে শাবিনকে। সেই সেলফের প্রত্যেকটা তাক শাবিন পুরোনো খবরের কাগজ ভাঁজ করে তার ওপরে তুরির দেওয়া লিস্টমতো উপন্যাস, ছোটগল্প আর কবিতার বই দিয়ে ভরে ফেলেছে।
শাবিন এখন নিয়মিত লেখে। লিখে তুরিকে পড়ে শোনায়। তুরি মন দিয়ে শোনে। যুক্তি দিয়ে সেগুলোকে সাজাতে থাকে। শাবিন লেখে আর কাটে। আবার নতুন করে লেখে। তখন আর সেই লেখাটা শাবিনের একার থাকে না। ওদের দুজনার হয়ে যায়।
এর মধ্যে একদিন শাবিন জানাল তার লেখা গান শোনানো হবে রেডিয়োতে, রাত নয়টা পাঁচ মিনিটে।
এখন কেউ রেডিয়ো শোনে এই ধারণাই হারিয়ে গিয়েছিল। মোবাইল ফোনে টেস্ট করে দেখল ঠিকঠাকমতো রেডিয়ো স্টেশন ধরা যাচ্ছে কিনা।
যখন সত্যি সত্যিই শাবিনের লেখা ‘ভিন গাঁয়ের এক উড়াল মেয়ে বলল আমায় এসে, রোদের নাকি বান ডেকেছে দিন উঠেছে হেসে’ গান রেডিয়োতে বেজে উঠল তখন তুরির ইচ্ছে হচ্ছিল এক্ষুণি গিয়ে শাবিনকে বলে, এর খুব দরকার ছিল। একবার জিতে যাওয়া। তুরির মনে হলো তার বেঁচে থাকার সার্থকতা এটা।
অফিসে পৌঁছুতেই মাহফুজ ভাই বললেন, জিএম স্যার আপনাকে খুঁজছেন, অনেকক্ষণ।
তুরি অবাক হলো। জিএম স্যারের এখন তাকে খোঁজ করার কথা নয়। তার কি ভয় লাগছে! লাগছে বোধহয়।
জিএম স্যার মানুষ ভালো। একটু গম্ভীর। তবে ভয় পাওয়ার মতো নন। তুরি ভেতরে ঢুকতেই বললেন, বসো।
যন্ত্রের মতো এক পা এগিয়ে তুরি চেয়ারে বসে পড়ল। জিএম স্যার তুরির দিকে মুখবন্ধ খাম এগিয়ে দিলেন। ওপরে লেখা, কনফিডেন্সিয়াল।
তুরি জিজ্ঞেস করল, স্যার, কী এটা?
খুলে দেখো।
তুরি সময় নিয়ে খাম খুলল। হাত কাঁপছে। এটাও ওর নতুন অভিজ্ঞতা। তুরি কখনো চট্ করে নার্ভাস হয় না। এখন হচ্ছে। এখন তুরি প্রায়ই কাজে ভুল করে। খুব তুচ্ছ বিষয়েও কষ্ট পায়। অভিমান হয়। চোখে পানি চলে আসে। যা আগে কখনো হতো না। চাঁদনী রাতে খালি পায়ে নরম ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে এখন। ভালো লাগে জোৎ¯œাস্তৃত কাকচক্ষু জলে নৌকায় বেড়াতে।
খামের ভেতর থেকে চিঠি বের করে বিস্ময়ভরা চোখ তুলে জিএম স্যারের দিকে তাকাল তুরি। জিএম স্যার হাসছেন। পরিমিত হাসি। হাসিটুকু ধরে রেখে বললেন, কনগ্র্যাচুলেশান। আ’ম হ্যাপি।
তুরির প্রমোশন হয়েছে।
অফিস ছুটির পর তুরি ঘন্টা চুক্তিতে রিকশা ঠিক করল। তাতে উঠে বসেছে। রিকশাওয়ালা খুব আস্তে রিকশা চালাচ্ছে। পাকা চালক বলেও মনে হচ্ছে না তাকে।
এ রকম হয় প্রায়ই। রিকশায় তুলে রিকশাওয়ালা আর পথ চেনে না। তখন জানতে পারে ঢাকা শহরে আজই প্রথম সে। গতরাতে কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে ঢাকায় এসেছে এবং তুরি তার প্রথম যাত্রী।
এই রিকশাওয়ালার মুখের হাসি দেখে আর কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে তার বাড়ি রংপুর, দিনাজপুরের ওদিকে হবে। ওদিকের মানুষজন বেশ আন্তরিক, সহজ-সরল।
তুরি যাচ্ছে মামা হালিম কিনতে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তার কাছে টাকা নেই। অফিস থেকে সোজা বাসায় চলে যাবে ভেবেছিল। রাস্তায় বেরিয়ে মত বদলিয়েছে। এখন সে হালিমের দোকানে গিয়ে বলবে, আমার খুব হালিম খেতে ইচ্ছে করছে। আমার কাছে পয়সা নেই। আগামীকাল এসে দিয়ে যাব।
দোকানদার নিশ্চয় না করবে না।
তুরি রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, ভাই, আপনার বাড়ি কোথায়?
রিকশাওয়ালা বলল, কুষ্টিয়া।
কুষ্টিয়া কোথায়?
রিকশার মন্থরগতি আরও ধীর হয়ে এলো। রিকশাওয়ালা বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল, ভেড়ামারায়। আপনি গিয়েছেন? রেললাইনের ধারে ষোলোদাগে আমার বাড়ি। জুমারত মাস্টারের বাড়ির পাশে।
আপনার কাছে কি শদুয়েক টাকা হবে?
হবে। রিকশাওয়ালাকে বেশ খুশি মনে হচ্ছে। বলল, আইজ সাইত ভালো। রোজ একশ ট্যাকার খ্যাপ মারতিই জান বারা যায়। আইজ কম্নে কম্নে দি পাঁচশ ট্যাকা মারা সারা।
তুরি রিকশাওয়ালার কাছ থেকে টাকা নিয়ে মামা হালিম কিনল। এখন যাবে শাবিনের ঘরে।
শাবিন শর্ষের তেল, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে খাচ্ছে। জ্বর আর আসেনি। এখন ভালো লাগছে।
তুরি বলল, চা খেতে ইচ্ছে করছে।
ঠিক তিন মিনিট। চা নিয়ে আসছি, বলে শাবিন লাফ দিয়ে উঠে পড়ল।
দরকার নেই। তুরি থামাল শাবিনকে, গেটের সামনে রিকশা দাঁড়ানো আছে। রিকশাওয়ালার নাম রমজান আলি। উনাকে বললেই উনি চা এনে দেবেন।
গ্রেট। পার্সোনাল এয়ার ক্রাফট। পার্সোনাল ফ্লাইট ক্যাপ্টেন, বেশ জমিদারি ঢঙে বলল শাবিন, দারোয়ান, ড্রাইভারকো বুলাও। উনকো মেরা পাস ভেজ দো।
শাবিনের কথার ভঙ্গিতে তুরি পিঠ বাঁকিয়ে শব্দ করে হেসে উঠল। শাবিন টেবিলের ওপর থেকে কোল্ড ড্রিংকসের খালি কাচের বোতল হাতে তুলে নিয়েছে। ওকে ঠিক তিন মিনিটের মধ্যে রাস্তার ওপাশ থেকে বোতলে দুই কাপ চা ভরতি করে নিয়ে আসতে হবে।
তুরি বলে, চা খাব না। ইচ্ছে করছে না।
কী হচ্ছে এসব তুরি! নিজের ভেতর আবার কথা বলে ওঠে তুরি। এই বললি চা খাব, এই বলছিস, না। কী হয়েছে তোর সত্যি করে বল তো! এত দোলাচল কেন তোর ভেতর?
তুরিকে ডেকে তুরি বলল, কেন হতে পারে না। একজন মানুষ কি খুব স্বাভাবিকভাবেই হুট করে নিজের মত পাল্টাতে পারে না?
তুরি নিজের সাথে নিজের কথোপকথন চলে তখন, কই আগে তো এ রকম ছিলি না!
তুরির কাছ থেকে ওর প্রমোশনের চিঠিটা নিয়ে পড়ল শাবিন। তুরিই পড়তে দিয়েছে। চিঠি পড়ে শাবিন ছোটো শিশুর মতো আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠল।
দুপাশে দুই হাত মেলে ‘ইয়াহু’ বলে একপাক ঘুরে নিল তখুনি। খুশিতে পারলে সে দোতলা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে, শূন্যে ভাসবে বলে। ওর মনে হলো ডিগবাজি দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তুরির সামনে সেটা দেওয়া যাবে না। ও চলে যাওয়ার পর দেবে।
বৃষ্টি হচ্ছে। উথালপাতাল বৃষ্টি। শাবিন দাঁড়িয়ে আছে অফিসের উলটো দিকে ছোট্ট চায়ের দোকানে। বিকেলের এই বৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ঢাকা শহর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। চায়ের দোকানের টিনের চাল থেকে বৃষ্টির পানি শাবিনের মাথার চুল বেয়ে টুপ টুপ করে ওর গা ভিজিয়ে দিচ্ছে।
শাবিন গিয়েছিল টাঙ্গাইলের বাসাইল গ্রামে। টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে। কামরান ভাই ডিরেক্টর। নামমাত্র কামরান ভাই। অবশ্য পরিচালক হিসেবে কামরান ভায়ের নামটাই যাবে। কাজ সব করতে হয়েছে শাবিনকে। শাবিন না করেনি। এটা ওর জন্য একটা সুযোগ পুরোদস্তুর ডিরেক্টর হওয়ার বলে মনে করেছে।
বাসাইলে টানা আট দিন শুটিং শেষে আজ দুপুরে ঢাকা ফিরেছে। অফিসে এসে শোনে তুরি রিজাইন করেছে। নতুন কোথাও জয়েন করেছে কি না তা অফিসের কেউ জানে না।
মেঘ কেটে গেছে। বিকেলের বৃষ্টিভেজা নরম রোদ্দুরে আলো ছড়াচ্ছে। শাবিন সামনে এগিয়ে গিয়ে ফ্যাক্স-ফোনের দোকান থেকে তুরিকে মোবাইলে কল করল। নিজের ফোন থেকে অনেকবার কল করেছে। বলছে ফোন বন্ধ। তার নম্বর কোনো কারণে তুরি বøক করে দিয়েছে কিনা বুঝতে পারছে না। রিং হলো না। ‘টু টু টা- টু টু টা’ করে লাইন কেটে গেল।
শাবিন আবার ফোন করল। আবার সেই ‘টু টু টা- টু টু টা’। আবার আবার। প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত শাবিন বিভিন্ন ফোনের দোকান থেকে চেষ্টা করল। তার মনে হচ্ছিল কোনো একবার তুরি ঠিক কল রিসিভ করবে। তুরি কল রিভিস করল না। সেই একই ‘টু টু টা’ করে টেলিফোন লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। পরদিন সকালে আবার চেষ্টা করল। সেই একই।
কামরান ভাইকে ফোন করে শাবিন জানাল, আজ সে কাজে আসবে না। শরীর খারাপ।
সকালে তুরির বাসায় গেল শাবিন। বড়ো আপা বললেন, তুরির সঙ্গে চাকরি করো, সে তোমাকে বলেনি বাসায় থাকে না? কোনো এক মেয়েদের হোস্টেলে থাকে। কোন হোস্টেলে থাকে জানায়নি।
সিলভিয়ার বাসায় গেল শাবিন। বাসায় সিলভিয়াকে পাওয়া গেছে। তবে সে তুরির কোনো খোঁজ জানে না বলে জানাল। কোথায় কোন মেয়েদের হোস্টেলে তুরি থাকে তা সিলভিয়াও জানে না। আসার আগে সিলভিয়ার ফোন নম্বর নিতে ভুলে গেল।
এবার তুরির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর শাবিন ভাবেইনি এই মানুষটাকে আবার খুঁজতে হতে পারে। এতদিনে একবারও কেন শাবিনের মনে হয়নি তুরি কোথায় থাকে, কী পছন্দ করে, কোথায় যেতে ভালো লাগে ওর! ধরেই নিয়েছিল বড়ো বোনের বাসায় থাকে। কী আশ্চর্য!
শাবিন বুঝতে পারে এতদিন ও নিজের কথাই ভেবেছে শুধু। উদাসীভাবে নিজের ভালোলাগাটুকুই আদায় করে নিয়েছে বরাবর। দিনের পর দিন নিজের কথা বলেছে। তুরিকে বুঝতে চেষ্টা করেনি কখনো।
বানের প্রবল স্রোতের ধাক্কায় হুড়মুড় করে নদীর পাড় ভেঙে পড়ার মতো হাহাকার নিয়ে অপরিচিত দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো শাবিনের বুকের খুব গভীর থেকে টনটনে মোচড় দিয়ে। কী অদ্ভুত! এত কাছাকাছি দুজন মানুষ। অথচ কেমন করে স্বার্থপরের মতো তুরির কাছ থেকে ও নিয়েছেই কেবল।
সারা দিন সম্ভব সব জায়গায় তুরির খোঁজ করল শাবিন। কোথাও নেই তুরি। সারা ঢাকা শহর চষে ফেলল। শহরটাকে এক সময় খুব ছোটো মনে হতো। এখন মনে হচ্ছে এত বড়ো ঢাকা শহরে কোথায় খুঁজে পাবে সে তুরিকে!
সূর্য ডুবে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। গাড়ির হেডলাইট থেকে ঠিকরে আসা আলো আর ল্যাম্পপোস্টের বাতিতে অন্ধকার ছিঁড়েফুঁড়ে আলো ছড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। ক্লান্তিতে নুয়ে আসছে শরীর। শাবিন হাঁটতে হাঁটতে এসে সংসদ ভবনের লেকের সিঁড়িতে বসে পড়ল। দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে থাকল চুপচাপ। কান্না পাচ্ছে ওর। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে হু হু করে কাঁদতে পারলে হতো।
কতক্ষণ বসে ছিল ঠাহর করতে পারেনি। পুলিশের বাঁশির তী² শব্দে পাশ ফিরে দেখে কোথাও কেউ নেই। ও বসে আছে, একা একজন মানুষ। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। চেপে আসছে চারপাশ। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আবার সেই একা একা লড়াই, টিকে থাকা। শুধু শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাখা।
অবসন্ন দেহ তুলে বাসার দিকে রওনা হলো শাবিন।
(চলবে)