ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১২
বিষাদ বসুধা
অফিসের গেটের সামনে মোহিনীকে বহনকারী পাজেরো জিপটি এসে থামে। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে পেছনের দরজা খোলার জন্য এগিয়ে যায়। দরজা খুলে কুর্ণিশের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে সে। এই কাজটি মোহিনীর পছন্দ নয়। অনেকবার ড্রাইভারকে তিনি বলেছেন। ওমন কুর্ণিশের ভঙ্গিতে তুমি দাঁড়াবে না। আমার ভালো লাগে না। তারপরও সে এই কাজটি করে। আসলে এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আগে যেখানে সে চাকরি করত— সেখানে এ রকম নির্দেশনাই ছিল। সেখানে সে টানা দশ বছর চাকরি করেছে। অজ্ঞাত কারণে তার চাকরি চলে যায়। মাস খানেক আগে সে মোহিনীর ড্রাইভার হিসেবে যোগ দিয়েছে। দশ বছরের অভ্যাস হঠাৎ করে বদলাবে কি করে?
মোহিনী হাতে ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। দুএক কদম সামনে এগোতেই মোহিনী কিছুটা হোচট খেলেন। তিনি গেটের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেনও। চারদিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলেন। হঠাৎ তার বুকটা কেমন যেন কাঁপন দিয়ে উঠল। আগে কখনো এমনটি হয়নি। এমন থমথমে পরিবেশও কখনো দেখেননি। হাজারো প্রশ্ন তার মাথায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। পরিবেশটা এমন মনে হচ্ছে কেন? কি হয়েছে? কোনো অঘটন কি ঘটেছে?
মোহিনী মনে মনে ভাবেন, নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে। তা না হলে এমন লাগবে কেন? এমন হবেই বা কেন? আমার নিজের অফিস। অথচ নিজের কাছেই অচেনা মনে হয়। কি ঘটতে পারে? এমনটি ভাবতে ভাবতেই মোহিনীর সিঁড়ির উপর পা রাখলেন। এরমধ্যেই মোহিনীর একান্ত সহকারি শাহনাজ বেগম হুড়মুড় করে তার সামনে দাঁড়াল। কাচুমাচু করে বলল, সরি ম্যাম, একটু দেরি হয়ে গেল!
শাহনাজ, অফিসে কি হয়েছে বলো তো?
জি ম্যাম বলছি। আপনি অফিসে বসার পর বলি!
আচ্ছা ঠিক আছে। অফিসের কি অবস্থা? সবাই এসেছে তো?
জি ম্যাম।
অফিসের কারো কোনো সমস্যা হয়েছে?
জি ম্যাম।
কার সমস্যা? কি সমস্যা? তুমি এমন রাগঢাক কেন করছ? তাড়াতাড়ি বলো।
বলছি ম্যাম। আপনি বসুন।
মোহিনী হাতের ব্যাগ পাশে রেখে নিজের চেয়ারে বসলেন। শাহনাজ বেগম এই সময়টুকুর জন্যই অপেক্ষা করছিল। মোহিনী চেয়ারে বসার পরই বলল, ম্যাম একটা দুঃসংবাদ আছে।
সেটাই তো আমি জানতে চাচ্ছি। দুঃসংবাদটা কি?
শফিকুর রহমান সাহেব করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তার লাশ পরিবারের কাছে দেয়নি। সরকারিভাবে দাফন করা হয়েছে।
তাই নাকি! ওহ! বুঝতে পারছি। ছোঁয়াচে রোগ। অন্যদের মধ্যে যাতে না ছড়াতে পারে সেজন্যই এই ব্যবস্থা। আচ্ছা, তার বাসায় কে কে আছে?
তার স্ত্রী আর দুই ছেলে মেয়ে।
তার স্ত্রীকে ফোনে ধরো। আমি কথা বলব।
জি ম্যাম।
শাহনাজ বেগম মোহিনীর কক্ষ থেকেই ফোন করে শফিকুর রহমানের বাসায়। শফিকুর রহমানের স্ত্রী সুলেখা ফোন ধরেন। শাহনাজ বেগম ফোনে বলে, আমি শফিক সাহেবের অফিস থেকে বলছি। ম্যাম কথা বলবেন। তারপর সে ফোনের রিসিভারটা মোহিনীর হাতে এগিয়ে দেয়। মোহিনী ফোন ধরতেই টেলিফোনের ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। মোহিনী ফোনের রিসিভার কানে ধরে থাকেন। মোহিনী কারো কান্না সহ্য করতে পারেন না। কান্নার শব্দ তাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তার চোখে পানি আসে। তিনিও কাঁদেন। এক পর্যায়ে সুলেখা বললেন, আমরা বুঝতেই পারলাম না, কিভাবে কী হয়ে গেল! হঠাৎ করেই শফিক অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোমায় চলে যায়। সেখান থেকে আর ফিরল না। আমরা তাকে এক নজর দেখতেও পারলাম না! এখন আমাদের কি হবে? আজ বিকালে আমাদের তিনজনকেই হাসপাতালে নিয়ে যাবে। আমরাও আক্রান্ত কি না তা পরীক্ষা করবে।
মোহিনী বেদনাহত কণ্ঠে বললেন, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না ভাবি। আমরা আছি আপনার পাশে। আমরা থাকবো সব সময়। আমাদের প্রতিষ্ঠানেই আপনি চাকরি করবেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুলেখা শফিক বললেন, ধন্যবাদ আপা। শুনছি আপনি মানুষকে অনেক উপকার করেন। সাধারণ মানুষের পাশে থাকেন। সেই জন্যই কিছুটা ভরসা পাচ্ছি। অন্তত ছেলে মেয়ে নিয়ে পথে বসতে হবে না।
না না। কি বলেন? এ ধরনের নেতিবাচক চিন্তা মনেও আনবেন না। যে কোনো প্রয়োজনে আমাকে ফোন দেবেন। কোনো রকম দ্বিধা রাখবেন না। শফিক সাহেব অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে অনেক দিয়েছেন। আমরা থাকতে তার পরিবার বিপদে হাবুডুবু খাবে তা হতে পারে না। আপনাদেরকে কোন হাসাপাতালে নেবে, কুর্মিটোলায় নাকি মুগদাতে?
সম্ভবত কুর্মিটোলায়। আমি জানাবো। আপনার মোবাইল নম্বরটা যদি দেন…।
মোহিনী মোবাইল নম্বর দিয়ে সুলেখা শফিকের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তারপর শাহনাজ বেগমকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি ওনার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রেখ। যখন যা দরকার হয় তা দিও। তাকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোনো রকম কার্পণ্য করবে না। তুমি বরং এখনই তার বাসায় কাউকে দিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দাও। বুঝতে পারছ?
জি ম্যাম।
দেরি কোরো না। উনি হাসপাতালে যাওয়ার আগেই তার হাতে যেন টাকাটা পৌঁছে।
জি জি।
আর শোন, প্রশাসনের জিএমকে আমার কক্ষে পাঠাও।
জি ম্যাম।
শাহনাজ বেগম বের হয়ে নিজের কক্ষে যায়। ইন্টারকমে প্রশাসনের জিএম আবুল কালামকে ফোন মোহিনীর কক্ষে যাওয়ার জন্য বলে। আবুল কালাম সঙ্গে সঙ্গে মোহিনীর কক্ষে এসে হাজির হয়। মোহিনী তাকে উদ্দেশ করে বলেন, শফিক সাহেবের সঙ্গে যারা কাজ করতেন তাদেরকে হোম কোয়ারিন্টিনে পাঠিয়ে দেন। পুরো অফিসকে আবারও খুব ভালো করে সেনিটাইজ করান। বাইরের লোক আসা-যাওয়া আপাতত বন্ধ রাখুন। আর অফিসের সামনে সেনিটাইজ করার যাবতীয় ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। বুঝতে পারছেন?
জি জি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কোথাও সেনিটাইজার পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু কি সেনিটাইজার! ডেটল, স্যাভলন থেকে শুরু করে জীবানু নিরোধন যা যা আছে সব কিনে নিয়ে গেছে।
বলেন কী!
তাহলে আর বলছি কী ম্যাম! হুজুগে বাঙালি কি খামাখা বলে! মানুষ পাগলের মতো বাজার থেকে সব কিনে নিয়ে গেছে। যে যা পেরেছে। আমরা কারওয়ান বাজারে লোক পাঠিয়েছি। যেখান থেকে ফোন করে জানালো কিচ্ছু নেই! পরে আর কী করা, ডেটল কোম্পানিকে বললাম, আমাদেরকে কিছু সেনিটাইজার দিতে। ওরা বলল, কাল সকালে ব্যবস্থা করবে।
মাই গড! এই অবস্থা! তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে! যার টাকা ছিল সে কিনে নিয়ে গেছে। যার টাকা নেই সে নিশ্চয়ই এগুলো কিনতে পারেনি! তাদের সংখ্যাই তো বেশি। তাদের কি হবে?
তাদের আর কী হবে? তাদের ভরসা আল্লাহ!
দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়েন মোহিনী। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, আরেকটা কথা, আমরা তো অনেককে ছুটি দিয়েছি তাই না?
জি ম্যাম।
তারপরও এতো লোক কেন?
ম্যাম, তারা আমাদের অফিসের গাড়িতেই যাতায়াত করে।
তা করুক। তাদের মুভমেন্ট তো হচ্ছে। ব্যবসা অনেক করেছি। এখন মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। আগে বাঁচতে হবে। বেঁচে থাকলে অনেক ব্যবসা করা যাবে। এরমধ্যেই আমাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ লোককে আমরা হারিয়েছি। আর কাউকে হারাতে চাই না।
জি ম্যাম।
চলবে…