ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৮
বিষাদ বসুধা
আরেফিন ঘুম থেকে উঠে অভ্যাস বসত খবরের কাগজ খোঁজেন। পত্রিকাটা সাধারণত দরজার নিচ দিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে না পেয়ে তিনি দরজা খুলে বাইরে যান। বাইরেও কোনো পত্রিকা নেই। তার মনে প্রশ্ন জাগে। কি হলো? পত্রিকা আজ দেয়নি?
আরেফিন রুমে এসে রুমকিপারকে ফোন দিয়ে পত্রিকার বিষয়ে জানতে চান। রুমকিপার তাকে জানায়, পত্রিকা আজ বের হয়নি। আগামী কয়েকদিন পত্রিকা বের হবে কি না সন্দেহ।
আরেফিন এর কারণ জানতে চাইলে রুমকিপার সরাসরি এর উত্তর না দিয়ে বলল, টিভি দেখুন না স্যার! টিভিতে খবর দেখুন।
টিভিতে চীনা ভাষার খবর হয় বলে আরেফিন টিভি ছাড়েন না। তিনি মনে মনে বিরক্ত হন। দেশ-দুনিয়ার কোনো খবর জানা যাবে না! এটা কী করে সম্ভব! সকালে পত্রিকা না পড়তে পারলে মনে হয়, কি যেন করা হয়নি। নিজেকে বড় অসম্পূর্ণ লাগে। মন খারাপ করে কিছুক্ষণ সোফায় বসে থাকে। মোহিনীর কথা তার খুব মনে পড়ে। তিনি ফোন হাতে নিয়ে মোহিনীকে ফোন করেন। না। মোহিনীকেও পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর তিনি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে মোহিনীকে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু ম্যাসেঞ্জার খোলা যাচ্ছে না। উইচ্যাট ছাড়া অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কাজ করছে না। হতাশ হয়ে আরেফিন বসে থাকেন। ঘড়ির দিকে তাকান। ঘড়ির কাঁটা তখন নটার ঘরে। সাড়ে নটায় নাস্তার সময় শেষ হয়ে যাবে।
আগে নাশতা করতে যাবে নাকি গোসল করবেন? এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে কিছুটা সময় পার হয়ে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আর মাত্র পনের মিনিট হাতে আছে। এখন গোসল করতে গেলে নাশতা পাওয়া যাবে না। তাই তিনি তাড়াহুড়া করে জামা-প্যান্ট গায়ে দিয়ে নাশতা করতে ছুটে যান। রেস্তোরাঁয় এসে তিনি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকান। পরিবেশটা কেমন যেন অচেনা লাগে। চেনা মানুষগুলোও অচেনার মতো আচরণ করছে। দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। তিনি মনে মনে ভাবেন, হঠাৎ কি হলো? কেউ কাউকে যেন চেনে না। ফাঁকা ফাঁকা করে বসে আছে। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। গল্প করে না। একেকজন দূরে দূরে বসে রোবটের মতো খাবার খাচ্ছে। এ কী অবস্থা!
নাশতা করতে গিয়ে আরেফিন রীতিমতো গোলকধাঁধায় পড়ে। শত শত আইটেমের খাবার সাজানো। কিন্তু কোনটা তিনি নেবেন তা খুঁজে পান না। চীনে এসে তিনি প্রথম টের পেলেন তার জন্য খাবারের সমস্যা কতটা প্রকট।
আরেফিন দেখলেন, নাশতার সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। অনেক চিন্তাভাবনার পর তিনি প্লেটে করে ডিম, রুটি, ফলের রস আর কিছু কাটা ফল নিলেন। অনেকটা নাকেমুখে দেওয়ার মতো অবস্থা। তৃপ্তি সহকারে খেতে পারলেন না।
যদিও সকালবেলাই আরেফিন সারাদিনের খাবার খান। সকালে যে আইটেমগুলো থাকে সেগুলো অন্তত মুখে দেওয়া যায়। দুপুরের এবং রাতের খাবারের কোনো আইটেমই তিনি ঠিকমতো খেতে পারেন না। সব খাবারেই তার সন্দেহ। সাপ, কেচো, বেজি, শুকর অথবা পোকামাকড় খেয়ে ফেলার ভয়। কোনো কিছু খেতে গেলেই শরীরের রোমকূপগুলো খাড়া হয়ে ওঠে। বমি বমি ভাব আসে। আজ সকালে যে নাশতা করেছে তা দিয়ে সারাদিন টেকা দায়। তাই তার মাথায় সারাদিনের চিন্তা।
অনেকটা হতাশা নিয়েই রিসিভশনের দিকে এগিয়ে যান আরেফিন। রিসিভশনে গিয়ে পত্রিকা না পাওয়ার বিষয়টি জানান। রিসিভশনিস্ট মুসকি হেসে বলল, দুঃখিত, আজ পত্রিকা দেয়নি।
বিষয়টা আরেফিনের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে তিনি আবারও বললেন, পত্রিকা দেয়নি! না দেওয়ার কারণ কি জানতে পারি?
আপনি হয়তো জানেন না, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করায় এখানে লকডাউন শুরু হয়েছে। লকডাউন মানে বুঝতে পারছেন তো? সবকিছু বন্ধ। কেউ কোথাও মুভ করতে পারছেন না। সব ধরনের চলাচল বন্ধ।
আরেফিনের চোখেমুখে বিস্ময়। তিনি কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি কিছুক্ষণ হাবাগোবার মতো দাঁড়িয়ে থেকে রুমের দিকে হাঁটা দিলেন। সকাল থেকেই হোটেলের পরিবেশটা কেমন যেন হয়ে গেল। হোটেলের প্রাণবন্ত পরিবেশে মলিনতা ভর করল। লিফটে একজন উঠলে দ্বিতীয়জন লাইনে অপেক্ষা করে। কেউ উঠতে গেলেও আরেকজন বলে, প্লিজ উঠবেন না।
আরেফিন রুমে গিয়ে সেভ করলেন। গোসল সারলেন। কর্মশালায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। আরেফিনের রুম যে ফ্লোরে সেই ফ্লোরেই তাদের কর্মশালা। তিনি পায়ে হেঁটে সেমিনার কক্ষে গেলেন। সেখানে গিয়েও তিনি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তিনি দেখলেন, সেমিনার কক্ষের চেহারা একদিনের মধ্যে পাল্টে গেছে। আরেকদিন আসনগুলো ছিল পাশাপাশি। একজনের খুব কাছাকাছি আরেকজন। আজ নিরাপদ দূরত্বে আসনগুলো সাজানো হয়েছে। একজন ভলান্টিয়ার দূরত্ব বজায় রেখে আরেফিনের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর বিনয়ের সঙ্গে বলল, আপনার আসনে নেমপ্লেট রয়েছে। আপনার নেমপ্লেট যেখানে রয়েছে আপনি সেখানেই বসবেন।
তারপর একে একে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী সবাই এসে উপস্থিত হলেন। প্রশিক্ষকরাও এসে যার যার আসনে বসলেন। শুরুতেই আয়োজকদের একজন কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিষয়ে কথা বললেন। তিনি সবাইকে খুব সাবধানতা অবলম্বনের তাগিদ দিয়ে বললেন, করোনাভাইরাস ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে। একজন আক্রান্ত ব্যক্তি হাজারজনকে সংক্রমিত করতে পারেন। সুতরাং খুব সাবধান! আর এখানে যারা প্রশিক্ষক এবং প্রশিক্ষণার্থী সবাই হোটেলেই অবস্থান করছেন। কাজেই বাইরে থেকে কারো আসার সুযোগ নেই। আপনারা বাইরের কারো সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করবেন না। কারো সঙ্গে করমর্দন করবেন না। দূরত্ব বজায় রেখে চলবেন। করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে সাবধনতা।
আরেফিন দুশ্চিন্তায় পড়েন। তিনি জানতে পারেন, কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তার লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। প্রিয়জনরা দেখতেও পারে না। আরেফিনের ভেতরে ভয় ঢোকে। আক্রান্ত হওয়ার ভয়।
আরেফিন উহান শহর নিয়ে অনলাইনে কিছু পড়াশুনা করেন। এই শহর সম্পর্কে কিছুটা জানার চেষ্টা করেন তিনি। উহান, হুবেই প্রদেশের রাজধানী শহর। এই শহরে প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসবাস। ঢাকা শহরের মতোই ঘনবসতি। কিন্তু নিয়মশৃঙ্খলা মানার ব্যাপারে উহানবাসী খুবই সচেতন। লকডাউন ঘোষণার পর সবাই ঘরে ঢুকে যায়। বিশেষ প্রয়োজনেও কেউ বাড়ির বাইরে বের হচ্ছেন না। যদিও লকডাউনের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন ঘোষণা করল, কেউ বাড়ির বাইরে বের হবেন না। সবাই ঘরে থাকবেন। ব্যাস, সবাই পুলিশের ঘোষণা শতভাগ মেনে নিল।
সতের বছর আগে এই শহরে সার্স ভাইরাসের আক্রমণ হয়েছিল। কিন্তু এবারের আক্রমণটা আরও বেশি ভয়ঙ্কর বলে ধারণা করছেন নগরবাসী। লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সেই তথ্যও জানতে পারলেন তিনি। তার ভেতরে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অজানা ভাইরাস নিয়ে অজানা আতঙ্ক। এমন আতঙ্ক আগে কখনো সে অনুভব করেননি। এখন করছেন। রুমের মধ্যে তার কেবলই মনে হচ্ছে, চারদিক থেকে ভাইরাসগুলো জাতিসাপের মতো ফণা তুলে ধেঁয়ে আসছে।
আরেফিন ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠেন। চিৎকারের এক পর্যায়ে তিনি তার মাকে ডাকেন। মা বাঁচাও! অনেক দিন পর তার মা’র কথা মনে পড়ল। বিপদের সময় তার মা’র কথা খুব মনে পড়ে। আজও তার খুব মনে পড়ছে। মনে মনে তিনি ভাবেন, আমার মা কেমন আছেন গ্রামে? বাবা কি এখনো মাকে মারেন? তার বংশ তুলে গালি দেন? মা’ বাপের বাড়ির জমি বিক্রি করে টাকা আনতে বলে? বাবাটা এতো স্বার্থপর কেন? এই রকম একটা নীচুঘরে আমি কেন জন্ম নিলাম? কেন আমার উচুঘরে জন্ম হলো না? তাহলে আমার জীবনটা অন্য রকম হতে পারত। মোহিনীর সঙ্গে আমার জীবনটাকে অন্যভাবে সাজাতে পারতাম। উচু-নীচুর দ্বন্দে! না হলো সংসার! না হলো ভালোভাবে বেঁচে থাকা।
আরেফিন মোহিনীর কথা ভাবেন। এখন মোহিনী কি করছে? কোথায় আছে সে? সে কি তার বাপের বাসায় চলে গেছে? নাকি নিজের বাসায় আছে? ওই বাসাটিও তো ওর কেনা। কাজেই বাপের বাসা কিংবা নিজের বাসায় যাওয়া আসা কোনো কিছুই ম্যাটার করে না। কিন্তু সে আমার ওপর এতোটা রেগে গেল কেন? আমি তাকে চীনের আসার কথা আগে থেকে বলিনি। এটাই কি আমার অপরাধ? এর চেয়ে বড় অপরাধ তো আগেও করেছি। সেটাতে তো এতোবেশি রিঅ্যাক্ট করেনি! হ্যাঁ, আমি ওর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। ওর হাত ছুঁয়ে বলেছিলাম, আমি ভুল করেছি। ভবিষ্যতে আর ভুল হবে না। সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছি। কাজটা আমার ভুলই হয়েছে। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা অপরাধ। আমার উচিত ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া। কিন্তু আমার ফোন তো সে ধরছে না! কি করে ক্ষমা চাইব? দেখি তো আবার চেষ্টা করে!
আরেফিন মোবাইল ফোনে মোহিনীকে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু মোহিনীকে পান না। একবার নয় দুইবার নয়, পাঁচছয় বার। তারপর তিনি মোবাইলটা বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলেন। দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলেন, দুর্ভাগ্য!
আরেফিন মনের অস্থিরতা দূর করার জন্য টিভি ছাড়েন। টিভিতে সিনেমা দেখবেন বলে রিমোটের বোতাম চাপতে থাকেন। একের পর এক চ্যানেলে যান। কোনোটাই যুৎসই মনে হয় না। তিনি রিমোট ছুড়ে ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। বালিশে মুখ গুজে নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। ওই চেষ্টাই সাড়। মনের ছটফটানি কিছুতেই দূর হচ্ছে না। আরেফিন মনে মনে বলেন, ক্যারিয়ারের স্বার্থে কর্মশালায় এসে আমি কি সবই হারালাম!
চলবে…
আরও পড়ুন