ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২৬
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
মেঘালয় রাজ্যের মহেশখোলা গ্রামের শরণার্থী শিবিরে বাবা-মা-ভাইবোনকে নিয়ে চলে এসেছে মোস্তফা। গারো পাহাড় এলাকার গ্রামটি নিজেদের নেত্রকোণা সীমান্ত থেকে অনেকদিন দেখেছে। তাকিয়ে দেখা মাত্র। ঢুকতে পারেনি কোনোদিন। এবার মুক্তিযুদ্ধ সময়ের শরণার্থী হয়ে ঢোকা একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা। এত সবুজ, সুন্দর পাহাড়ি এলাকার চারদিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে যায়। বাবাকে বলে, এলাকাটি তোমার পছন্দ হয়েছে?
-পরের দেশে ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছি, নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য। এখানে শরণার্থী হয়ে থাকব না। যুদ্ধ করার জন্য ট্রেনিং নিব। তোকেও সঙ্গে থাকতে হবে।
-যুদ্ধ আমি করব আব্বা। আপনাকে করতে হবে না।
-আমিও করব। বসে বসে ভাত গিলব না।
গোলাম রসুল রূঢ়ভাবে কথা বলে। পাশে বসে থাকা তিন ছেলেমেয়ে বলে, আমরাও করব। আমরাও যুদ্ধ করব আব্বা।
-হ্যাঁ করবি। করতে হবে।
ওদের মা আমিনা খাতুনও বলে, আমিও যুদ্ধের কাজ করব। কি করতে হবে তুমি আমাকে তার হুকুম দিও।
-আমাদের যোদ্ধারা আহত হলে তুমি তাদের দেখাশোনা করবে।
-আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি পারব করতে।
শরণার্থীদের যারা দেখাশোনা করছে তারা মোস্তফাকে ডেকে বলে, আপনারা এই ঘরে থাকবেন। এটা রাখেন। এটা আপনাদের শরণার্থী কার্ড। এই কার্ড দেখিয়ে খাবার সংগ্রহ করবেন।
ওরা চলে গেলে সবাই মিলে ঘরের সানে এসে দাঁড়ায়। নলখাগড়ার বেড়ার ঘর। আর ঘরের ছাউনি ছিল খড়ের। সবাই মিলে ঘরে ঢোকে। মাটিতে ঘুমাতে হবে। তবে ঘরের চারদিক বেশ বড়। সবাই মিলে মাটির উপর বসে পড়ে। মোস্তফা মাকে বলে, আপনার কি মন খারাপ হয়েছে মা?
-না, মন খারাপ হবে কেন। কতদিন কাটবে এখানে কে জানে? পাকিস্তানিরা যে অত্যাচার শুরু করেছে তার থেকে রেহাই পেতে না এসে উপায় ছিলনা। সবইতো জানিস তুই।
-থাক, এসব কথা আর বলতে হবে না।
গোলাম রসুল সবাইকে থামিয়ে দেয়। বলে, আমি তো তোমাদেরকে বলেছি আমরা ওখানে গিয়ে ট্রেনিং নিব। তারপর অস্ত্র নিয়ে দেশে ঢুকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। আমাদের কাজ আমাদেরকে করতে হবে। ফাঁকি দিলে হবে না। আমি ঠিক করেছি আমাদের ঘরের চারপাশের সবাইকে নিয়ে একটি ইয়ুথ ক্যাম্প বানাবো। ওখানে ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
-তাহলে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে নিন। তাদের ছাড়াতো আমরা এখানে ইয়ুথ ক্যাম্প করতে পারবনা।
-হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। প্রশিক্ষণতো তাদের সহযোগিতা ছাড়া হবে না। তাদের অনুমতি লাগবে। আমি একটু পরে গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলব।
-আজকালের মধ্যে বলেন। বেশি দেরি যেন না হয়। অস্ত্র পেলে আমরা যুদ্ধ করব।
-হ্যাঁ, আমি কালকেই যোগাযোগ করব। অস্ত্র পেলে প্রশিক্ষণ শুরু করব। এখন চল দেখি চাল জোগাড়ের ব্যবস্থা করি।
-শুধু চাল।
-বেশি কথা বলবিনা। যা পাবি তা নিয়ে খুশি থাকবি। আমরাতো ইন্ডিয়ানদের উপর বোঝা হয়েছি। ভুলে যাস কেন?
-ভুলিনা। সবসময় মনে রাখি। মাঝে মাঝে ইন্দিরা গান্ধীকে দেখার খুব ইচ্ছা হয়। তিনি আমাদের মায়ের মতো।
-আমি তাকে মা ডাকি। সবার সামনে না। নিজেদের মধ্যে।
-ঠিকই আছে।
-চলেন যাই। আমারও মনে তিনি আমাদের একজন মা না। তিনি আমাদের সামনে পাঁচশ মা মিলিয়ে একজন। এত তাঁর শক্তি।
-বাব্বা, দারুণ কথা বলেছ। এখন থেকে ইন্দিরা গান্ধী না বলে, ইন্দিরা-মা বলব। আমরা সবার সামনে বলব তিনি শরণার্থীদের মা। সবাই মিলে মা ডাকব।
-হ্যাঁ, ঠিক ঠিক।
শরণার্থীদের হাতে তালি বাজতে থাকে।
-এই তালি আজ আমাদের উৎসব।
-আমরা খেয়ে, না খেয়ে, দিন কাটাব। এই বিষয় মেনে নিয়ে আমাদের এখানে থাকতে হবে।
-চুপ কর। এসব কথা বলবিনা।
-আমরা এখানে দেশের স্বাধীনতার জন্য এসেছি। সবকিছু মেনে নিয়ে স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে একদিন ফিরে যাব।
-সবাইতো ফিরে যেতে পারবেনা।
-অবশ্যই পারবেনা। আমিও না ফিরতে পারি। স্বাধীনতার জন্য মৃত্যু হলে আমি গৌরব বোধ করব। যুদ্ধে মৃত্যু হওয়া স্বাধীনতার স্বপ্ন।
-আমরা সবাই যুদ্ধ করব।
-পাকিস্তানি সেনাদের মেরে ভূত বানাব।
-ভূত বানাবি কেন? ভূততো আর একরকম শয়তানি করবে। ভূত না বানিয়ে মাটির নিচে দাবায়ে রাখ। আর উঠতে পারবেনা। মাটির সঙ্গে গাদিয়ে থাকবে।
-তাইতো, ঠিক বলেছেন। আমরা এক জায়গায় ফেলেও রাখতে পারি। চিল-শকুন এসে খুবলে খাবে।
-না, পাকিস্তানিরা ওদেরকে খুবলে খেতে দেবেনা। নিজেরাই গণকবরে ঢোকাবে।
-ঢোকাক। ওরাই করুক। আমরা ঝামেলা করব কেন?
-আমরা করতেও পারবনা। ওদের দখল করে রাখা মাটিতে আমরা করব কিভাবে?
-থামুন সবাই। এসব কথা বলতে হবে না। ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা শরণার্থী। আমাদের আগে প্রশিক্ষণ হোক। তারপর আমরা যুদ্ধের কথা ভাবব।
-তাতো ঠিকই। এটা আমাদের কথার কথা। আমরা কি চাই সেটাই বলেছি।
-এটা বলতেই হবে। আমাদের স্বপ্ন স্বাধীনতা। যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করতে হবে। শত্রুকে তাড়াতে হবে বাংলার মাটি থেকে। আমাদের সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে। আমরা শুধু শরণার্থী হয়ে থাকবনা। দেশ স্বাধীন না হলে বেঁচে থেকে লাভ কি?
সবাই তালি বাজায়। মুখরিত হয়ে ওঠে শরণার্থী শিবির। চারদিকে বয়ে যায় হাততালির ধ্বণি, যেন বাতাসও গৌরব বোধ করছে স্বাধীনতার স্বপ্নে। পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে দূরে তাকিয়ে থাকে শরণার্থীরা। সবুজ মায়াভরা এলাকা দৃষ্টি জুড়িয়ে দেয়। সবাই দুই হাত তুলে নাড়াতে থাকে। বলে, স্বাগত জানাই এমন চমৎকার পাহাড়ি এলাকাকে। আমাদের স্বাধীনতার পতাকা উড়ছে পাহাড়ের মাথায়।
দুইদিন পর থেকে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। তরুণ ছেলেরা কেউ বাদ পড়তে রাজি হয়না। সবাই কয়েকদিনে প্রশিক্ষণ শেষ করে। ওদের সামনে যুদ্ধের চিত্র ভেসে ওঠে। সবাই প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হয়। অস্ত্র হাতে নিজের শক্তি বাড়ার অনুভব উদ্বুদ্ধ করে ওদের। একসময় প্রশিক্ষণ শেষ হয়। কেউ কেউ বলে, আমরা আমাদের সামনের যে এলাকা পাকসেনাদের হাত থেকে মুক্ত করতে পারব সেখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দেব। আমরা শরণার্থী হিসেবে এসেছি ঠিকই, কিন্তু সবাই মিলে বেশ কয়েকটি স্বাধীন বাংলার পতাকা এনেছি। চারদিকে পতাকা উড়লে লোকে বুঝবে স্বাধীনতার গৌরব অর্জন আমাদের মাথার উপর ঠেকেছে। বেশি সময় লাগবেনা।
অন্যরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলে, ঠিক বলেছিস, ঠিক বলেছিস। এটাই হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শক্তি।
শাজাহান একা চেঁচিয়ে বলে, আমরা সবসময় পতাকা সঙ্গে রাখব। পতাকা উড়বেনা, এটা হবেনা।
-হয়েছে, আর বলতে হবেনা। আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করেছি। চল সবাই তাঁবুর ভেতরে ঢুকি।
-না, তাঁবুর ভেতরে ঢুকবনা। সবাই মিলে যুদ্ধের বিষয়ে আলোচনা করব। চল সামনে গোল হয়ে বসি। তাঁবুর ভেতর ঢুকলে যে যার মতো একা হয়ে যাব।
সবাই শাজাহানের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়। মাঠের মধ্যে বসে পড়ে। কিবরিয়া উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে, আমাদের সামনে সোনালি দিন। স্বাধীন দেশের মাটিতে হেঁটে বেড়াব।
-আমরা কয়জন স্বাধীন দেশে ঢুকতে পারব কে জানে!
-তাতো ঠিকই। স্বাধীনতার জন্য শহীদ হতে হবে আমাদেরকে।
-যুদ্ধ! যুদ্ধ! জোর সাহসে করতে হবে। মরব না বাঁচব এতকিছু ভাবতে হবে না।
-ঠিক-ঠিক। আমাদের লক্ষ্য থাকবে স্বাধীনতা। আমাদের এখন নিজেদেরকে বোঝাতে হবে যে কমান্ডার যা নির্দেশ দেবেন আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে তা পালন করব।
-আয় সবাই মাটিতে হাত রাখ। মাটি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করব।
-এ মাটিতো আমাদের নয়।
-এ মাটি আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এ মাটি আমাদের বিশাল বন্ধুত্বের মাটি।
-ঠিক, ঠিক।
সবাই মিলে ডান হাত চেপে ধরে মাটির ওপর।
-কঠিনভাবে যুদ্ধ করব আমরা। দেশ স্বাধীন হলে তোমার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে চলে যাব আমরা। সোনার মাটি আমাদের ভালোবাসা নাও। সকলেই এই উচ্চারণ জোর বাতাস বয়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে, যেন শরণার্থীর এই উচ্চারণ পৌঁছে যাচ্ছে সব শরণার্থী ক্যাম্পে। সবার বুকের ভেতর প্রতিজ্ঞার আলোড়ন।
সন্ধ্যা হলে যে যার তাঁবুতে চলে যায়। আজ কারো তাঁবুতে রান্না হয়নি। চাল ছিলনা। সময়মতো চাল জোগাড় করা হয়নি। খাবারের কথা চিন্তা না করে যে যার মতো শুয়ে পড়ে। খিদায় পেট চনচন করে। তাই ঘুম আসেনা। মোড়ামুড়ি করে তাঁবুর ভেতরে গড়াগড়ি দিতে দিতে রাত ফুরোয়।
পরদিন পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু হয়। দিনভর আলোচনা হয় কিভাবে কোনপথে আক্রমণ শুরু হবে। সবাই উত্তেজিত হয়ে আলোচনায় অংশ নেয়। যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে দিনভর ঘুরে বেড়ায় চরদিকে। কারণ সিদ্ধান্ত হয় রাত্রে আক্রমণ শুরু হবে।
রাত বারোটার পরে ফায়র ওপেন করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে পাক সেনাদের ক্যাম্প থেকেও গুলি ছোঁড়া শুরু হলো। মিটমিটে আলোয় ওদের ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের টার্গেট ওই ক্যাম্প। ওদের গুলি ছোঁড়ার পরেই পাক সেনারা বেরী লাইট ছুঁড়তে শুরু করল। বেরী লাইট ছুঁড়লে তার আলোতে চারদিকের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। যতক্ষণ উপরে থাকে ততক্ষণ জ্বলে মাটিতে পড়ে গেলে নিভে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা বেরী লাইট জ্বলে উঠলে গাছের আড়ালে মাটিতে শুয়ে পড়ে। আলো নিভে গেলে আবার গুলি চালাতে শুরু করে। পাকসেনারা বেরী লাইট ছুঁড়ে আর গুলি করেনা। কোনদিকে থেকে গুলি আসছে তা আলোতে দেখে নেয়। তারপর অন্ধকার হলেই গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। সেই জায়গা লক্ষ্য করে যে জায়গা আলোতে দেখেছে। এটা ওদের কৌশল। মুক্তিযুদ্ধের সুবেদার হান্নান অন্ধকারে সব পজিশনের খোঁজখবর নিতে থাকেন। সেদিনও তিনি সবাইকে বললেন, দেখেশুনে ভালোভাবে আড়ালে যাও। কারো গায়ে যেন গুলি না লাগে। সবাই সতর্কতার সঙ্গে চারদিকে খেয়াল রাখ। আজ আমরা এখানে আমাদের পতাকা উড়াব। তার আগে শেষ করব সব কয়জন পাকসেনাকে। আমাদের দেশের মাটিতে ওরা দাপট দেখাচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে প্রচুর গুলি ছোড়া শুরু হলো। পাকসেনারা হঠাৎ করে মর্টার ছুঁড়তে আরম্ভ করল। মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারল ওদের মর্টার ছোঁড়ার কোনো লক্ষ্য স্থান নেই। যেভাবে পারছে ছুঁড়েই যাচ্ছে। কোনো কোনো শেল গাছের ডালে বাড়ি খেয়ে সেখানেই ব্লাস্ট হয়ে ডালপালাসহ মাটিতে পড়তে লাগল। বোঝা যায় ওদের গোলাগুলি হয়তো ফুরিয়ে গেছে। কিংবা কম আছে। সেজন্য এমনভাবে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা খুশি যে পাক সেনারা রাইফেল, গ্রেনেড ব্যবহার করল না।
সুবেদার হান্নান সবাইকে বলে, দুই ঘণ্টার বেশি সময় আমরা পাকসেনাদের ঠেকিয়ে রেখেছি।
-রাখবইতো। আমরা যে স্বাধীনতার সৈনিক। আমরা অন্যে দেশ দখল করার চেষ্টায় নাই।
সবাই মিলে চেঁচিয়ে উঠে বলে, আমাদের স্বপ্ন স্বাধীনতা-স্বাধীনতা। জয় বাংলা ‘জয় বাংলা’। চারদিকে ধ্বণিত হয় শব্দের রেশ। সবাই মিলে দেখতে পায় মুক্তিযোদ্ধাদের ছোঁড়া মর্টারগুলো আঘাত করছে পাকসেনাদের ক্যাম্প। ক্যাম্পের টিনের চাল ঝাঁঝরা হয়ে গেছে শেলের আঘাতে। বেরী লাইটের আলোতে দেখা যায় ক্যাম্পের বিধ্বস্ত অবস্থা। আশেপাশে পড়ে আছে লাশ।
সুবেদার হান্নান সবাইকে বলে, পিছিয়ে যাও। এখানে দাঁড়িয়ে আর গুলি করার দরকার নাই। আমরা জিতে গেছি।
সবাই মিলে একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে, হুররে, হুররে, আমরা স্বাধীনতার সৈনিক। আমরা শুধু শরণার্থী না, আমরা হলাম গ্রেনেড, মর্টার, রাইফেল, মাইন এমন সব অস্ত্র-হুররে-হুররে। আমরা অস্ত্র।
সুবেদার হান্নান ওদের কথায় হাসে। ভাবে, এমন উচ্চারণ তারুণ্যের শক্তি।
মনসুর বলে, স্যার আমরা পতাকা উড়াতে যাব না?
-যাব, কিন্তু আর একটু পরে। দেখে নেই কোথাও কেউ লুকিয়ে আছে কিনা।
আবার স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ ‘জয় বাংলা’
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরে সুবেদার হান্নান বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে এগিয়ে যায়-পেছনে সবাই।
বিধ্বস্ত ক্যাম্পের মাঝে উড়িয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশের পতাকা। গেয়ে ওঠে সবাই -‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’.....। মুখস্ত নেই সেজন্য এক লাইনের বেশি গাওয়া হয় না। আবার স্লোগানে মেতে ওঠে সবাই ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’।
ওরা এই স্লোগান দিতে দিতে ফিরে এলে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয়রা বলে, এই মানুষটির জন্য তোমরা স্বাধীন দেশ পাচ্ছ। ওরাও স্লোগান দেয় ‘জয় বাংলা-জয় বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধারা লাফাতে থাকে ওদের স্লোগান শুনে।
মুরশিদ পেছনে পেছনে আসছিল। হঠাৎ ওর মনে হলো আশেপাশের সবুজ জমিন থেকে কোঁ-কোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওর মনে হয় কেউ বোধহয় আহত হয়ে পড়ে আছে। নইলে এমন শব্দ শোনা যেতনা। লম্বা লম্বা ঘাসের ভেতর পা ঢুকিয়ে ও শব্দের দিকে এগিয়ে যায়। অল্পক্ষণেই দেখতে পায় একজন আহত হয়ে পড়ে আছে। মুরশিদকে দেখেই দু’হাত উপরে তুলে বলে, আমি উঠতে পারছি না। হেঁটে যেতে পারবনা। আমার নাম আলম।
- হ্যাঁ, জানি। আমি তোমাকে চিনতে পারছি। তোমাকে কিভাবে এখান থেকে সরাব তাই ভাবছি।
আলম কঁকিয়ে বলে, আমার পায়ে গুলি লেগেছে।
-ওহ্, বুঝতে পারছি।
মুরশিদ নিজের কোমরের বাঁধা গামছাটা খুলে আলমের দুহাত একত্র করে বাঁধে। জড়ানো দুহাতের মধ্যে নিজের মাথা ঢুকিয়ে আলমকে পিঠের ওপর টেনে নেয়। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকে। ঠিকমতো এগনো যায়না। চাপাশের ঝোপঝাড়, আগাছা ভর্তি এলাকা সুবজ মনোরম, কিন্তু এগোতে গেলে বিভিন্ন জায়গায় পা আটকে যায়, কখনো হাতের রাইফেলের ব্যারেল আটকে যায়। ছাড়িয়ে নিয়ে এগোতে হয় বলে যাওয়ার গতি কমে যায়। আলম মৃদু স্বরে বলে, আমাকে ফেলে দে ভাই?
-বলিস কি? তুই স্বাধীন দেশের জন্য মুক্তিযোদ্ধা তোকে ফেলে দেব কেন?
-তোর কষ্ট হচ্ছে। আমি মানতে পারছিনা।
-চুপ করে থাক, বেশি কথা বলবিনা। এটা কোনো কষ্ট না। এটা আমাদের সবার স্বাধীনতার স্বপ্ন। কষ্ট শব্দ বলবি না।
-বাবারে বাবা, তুই এতকিছু বুঝতে পারিস।
-বুঝবোনা কেন? তোকেও বুঝতে হবে।
-জয় বাংলা।
ও সোচ্চার কন্ঠে ধ্বণিত করে জয় বাংলা। আমিও ওর সঙ্গে জয় বাংলা বলতে থাকি। দুজনের কন্ঠস্বর আগাছামন্ডিত সবুজভূমিতে তরঙ্গ তোলে। একটু আগে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসার পথে যেসব বাধা পেয়েছিলাম তার অনুভব কেটে যায়। কেটে ফেলা ঝোপের ধারালো শাখার ছোঁয়ায় হাতে এবড়োখেবড়ো দাগ পড়ে গেছে। ব্যথা হচ্ছে হাতে। কখনো জংলি কাঁটার সাথে জড়িয়ে পড়ি। কি যে বিপদজনক পথ, আসলে এটাতো পথ নয়। আমি পথ মনে করছি কেন? এগিয়ে যাচ্ছি হামাগুড়ি দিয়ে। এটাতো সবুজ বনভূমি। অল্প একটু সময় এগোতেই টের পাই জংলি কাঁটার সঙ্গে জেড়িয় পড়েছি। সামনে এগোতে পারছিনা। পিঠে কাঁটা এমনভাবে আটকে আছে যে সামনে এগোতে পারছিনা। চারদিকের আগাছার মধ্যে আটকে যাচ্ছে পিঠে লেগে থাকা কাঁটা। রাইফেলের ব্যারেলও নানা জায়গায় আটকে যাচ্ছে। আহত আলমকে আমি ঘাসের ওপর শুইয়ে দেই। ও চোখ বুঁজে শুয়ে থাকে। মুখে মৃদু স্বরে কোঁ-কোঁ ধ্বনি করে। আমার কানে সেই শব্দ ঢুকে গেলে আমার পুরো শরীর তোলপাড় করতে থাকে।
আমি চারদিকে তাকাই খুঁজতে থাকি অন্য কেউ আছে নাকি কোথাও। না, কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। কাউকে পেলে আলমকে দুজনে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম। এমন সময় পাকিস্তানি সেনাদের দুটো সেল এসে একটু দূরে পড়ে। মনে মনে ভাবলাম, ওরা কি আমাদের দেখতে পাচ্ছে নাকি? এদিকে সেল ছুঁড়লো কেন? হাতে পারে, আমাদের এখান থেকে সরে যাওয়া উচিত। আলমকে আবার আমার পিঠে উঠিয়ে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকি। অনেকখানি পথ এসে আবার আলমকে পিঠ থেকে নামাই। ওকে বললাম, তোমার গায়ের কোথায় গুলি লেগেছে আমাকে দেখাও। ও চুপ করে থাকে, কিন্তু বলেনা। বিষন্ন মুখে তাকিয়ে থাকে অন্য দিকে। বুক ভেঙে বড় বড় নিঃশ্বাস আসছে। আমি ওর জামার ভেতর হাত ঢুকাই। বুকের ওপর হাত বুলাতে থাকি। একসময় আমার আঙুলের মাথা ওর বুকের ডানদিকের ছোট একটি গর্তে ঢুকে গেল। ও কঁকিয়ে উঠল। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাতটা টেনে বের করে ফেলি। বুঝতে পারি গুলি কোথায় লেগেছিল। তারপর ওকে পিঠে নিয়ে আবার যেতে শুরু করি। ঝোপঝাড় পেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাই অনেকে ছুটে আসছে। সবাই মিলে আমাদেরকে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়। হাসতে হাসতে স্যালুট করে। বলে, মুক্তিযোদ্ধাদের হাজার সালাম।
চলবে....