ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৯
বিষাদ বসুধা
মোহিনী সারারাত ঘুমাতে পারেননি। একটা দুঃস্বপ্ন তাকে সারারাত তাড়া করেছে। তিনি ঘুমের ঘোরে দেখেন, আরেফিন তার কাছে এসেছে ক্ষমা চাইতে। তিনি চিরদিনের জন্য মোহিনীকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবেন। আর কোনোদিন মোহিনীর সঙ্গে দেখা হবে না। কথা হবে না। এটাই তাদের শেষ দেখা। শেষ কথা।
আরেফিনকে হঠাৎ নিজের কক্ষে দেখে ঘুমের ঘোরেই আতকে ওঠেন মোহিনী। এসব তিনি কি দেখছেন! আরেফিন দেশে নেই। দেশে আসার কোনো সুযোগও নেই। কারণ, বিমান চলাচল বন্ধ। বিমান চালু না হলে উহান থেকে তার খুব সহসা দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই। অথচ আরেফিন তার কক্ষে! ঘুমের ঘোরেই তিনি আরেফিনকে ডাকেন। আরেফিন! আরেফিন!
আরেফিন আবেগপ্রবণ কণ্ঠে মোহিনীকে বলেন, আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। বিয়ের পর এতোটুকু সুখও দেইনি। সেই মর্মবেদনায় আমি কেবল পুড়ছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও মোহিনী। তা নাহলে আমার ভেতরের মর্মযাতনা কমবে না। প্লিজ মোহিনী!
আরেফিন আর কথা বলতে পারেননি। কথা বলার এক পর্যায়ে হো হো করে কেঁদে ওঠেন তিনি। তখনই মোহিনীর ঘুম ভেঙে যায়। সেই থেকে আর ঘুমাতে পারেননি। ঘুরেফিরে ওই একটি স্বপ্নই তাকে তাড়া করে ফেরে। দুই চোখের পাতা বন্ধ হলেই যেন আরেফিন তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভয়ঙ্কর একটা অবস্থার মধ্যদিয়ে তার রাত কাটে।
সকালের দিকে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে মোহিনীর দুই চোখে। ঠিক সেই সময়ই মোহিনীর মোবাইল বেজে ওঠে। ফোনের রিংটোনটা বড়ই বিরক্তিকর লাগছিল তার কাছে। হাতের কাছে পেলে হয়তো ছুড়ে ফেলতো। আবার এও ভাবে, এই অসময়ে কে ফোন করল? না। ফোন ধরতে মন চাইছে না। কিন্তু বেয়াড়া ফোনটা বেজেই চলছে। ফোন ধরতে হলে তাকে বিছানা থেকে উঠতে হবে। শরীরটাও যেন নেতিয়ে পড়েছে। মোটেই সায় দিচ্ছে না।
মোহিনী ভীষণ বিরক্ত। তিনি মনে মনে ভাবেন, মানুষ এতো বেকুব কেন? সময় বুঝে ফোন দেবে না! তা ছাড়া দেখছে যে আমি ফোনটা ধরছি না। তারপরও বার বার কেন ফোন করতে হবে!
মোহিনী বিরক্ত নিয়েই বিছানা থেকে ওঠেন। টেবিলের ওপরে রাখা মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে খাটের ওপর বসেন। কিছুতেই তিনি বসে থাকতে পারছিলেন না। খাটের পাশে বালিশ টেনে তাতে মাথা ঠেকান। তারপর ফোন কানে তোলেন। হ্যালো বলতেই টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসে। আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জুনায়েদ বলছি। অসময়ে ফোন করার জন্য দুঃখিত। আপনি কি মিসেস আরেফিন?
মোহিনী খুবই নিচু স্বরে জবাব দেন। জি।
আপনার হাজবেন্ড; মানে মি. আরেফিন কি চীনের উহানে গিয়েছিলেন?
এবারও মোহিনী নিচু স্বরে বলেন, জি।
আমি আবারও দুঃখিত। এই অসময়ে আপনাকে একটা দুঃসংবাদ দিতে হচ্ছে।
জি! বলেই লাফিয়ে ওঠেন মোহিনী। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে তিনি বললেন, কি বললেন? দুঃসংবাদ?
হ্যাঁ। আরেফিন সাহেব মারা গেছেন। আমরা তার মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করছি। খবরটা জানানোর জন্যই আপনাকে ফোন দিয়েছি। স্যরি। অসময়ে ফোন দিয়েছি বলে কিছু মনে করবেন না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার কথা পুরোটা শুনতে পাননি মোহিনী। শুধু আরেফিনের মারা যাওয়ার খবরটুকু শুনেছেন। তারপর মোহিনীর হাত থেকে মোবাইলটা নিচে পড়ে যায়। মোহিনীর মাথাটা ঘুরে যায়। চারদিকে কেবল অন্ধকার দেখে। এ কী হোলো! কেমন করে হোলো! না না! এ হতে পারে না!
আরেফিন মারা গেছে! এ কথা বিশ্বাসই করতে পারছেন না মোহিনী। তিনি আরেফিনের কথা ভাবেন। একেবারে গভীর ভাবনায় তলিয়ে যান। মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন দানা বাঁধে। এজন্যই কি বার বার তিনি আরেফিনকে স্বপ্নে দেখেছেন? তার মানে আরেফিনের মৃত্যুর খবর তার কাছে আগেই পৌঁছেছে! আরেফিনের প্রেতাত্মা মোহিনীর সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করে গেছে!
গভীর বেদনার সঙ্গে মোহিনী বলেন, হায় খোদা! এ তুমি কী করলে!
মোহিনীর সমস্ত সত্তাজুড়ে আরেফিন। তাদের ভালোবাসার মুহূর্তগুলো মনের আয়নায় ভেসে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নানা স্মৃতি তাকে আচ্ছন্ন করছে। কী গভীরভাবে মোহিনীকে ভালোবাসতেন আরেফিন। নেহায়েত পাগলের মতো ছিল সেই ভালোবাসা। মোহিনীকে ছাড়া তিনি কিছুই বুঝতেন না। মোহিনীই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। আরেফিনের সমস্ত ভালোলাগা অনুভূতিগুলো মোহিনীকে ঘিরে আছে। আর কিছুই ভাবতে পারেন না মোহিনী। আরেফিন আরেফিন বলে তিনি শুধু বিলাপ করেন। আর মনে মনে বলেন, এভাবে তুমি চলে যেতে পারো না আরেফিন! এভাবে চলে যাওয়া যায় না! এতো বড় ফাঁকি তুমি কেন দিলে? যাওয়ার সময়ই তুমি বলে দিতে পারতে, তুমি জীবনের তরে চলে গেছ। আর কখনো ফিরবে না! আমি যে তোমার পথ চেয়ে বসে ছিলাম আরেফিন।
দুঃখ কষ্ট বেদনায় মোহিনীর বুক ফেটে যায়। তিনি তার জন্য চিৎকার দিয়ে কাঁদতে চান। কিন্তু কিছুতেই কাঁদতে পারেন না। কান্না আসছে না। কষ্টের বাষ্প জমছে তার বুকে। ধীরে ধীরে সেই কষ্টগুলো ভারী পাথরের মতো বুকের ওপর চেপে বসে। কথায় বলে না, অল্প সুখে কাতর অধিক শোকে পাথর। অধিক শোকে মোহিনী পাথর হয়ে গেছেন। কাঁদতে পারলে হয়তো কিছুটা হালকা হতে পারতেন তিনি।
মোহিনী এও ভাবেন, কেন সেদিন আরেফিনের ওপর রাগ করে বাসা থেকে চলে এসেছিলাম? এতোটা রাগ না করলেও পারতাম। ও অনেকবার উহান থেকে আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে। সেদিন আমি ফোন ধরিনি। কেন ধরিনি? কি বলতে চেয়েছিল ও? মৃত্যুর আগ মুহূর্তে নিশ্চয়ই ও আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল! আহারে! কী কষ্টই না পেয়েছে সে। হে বিধাতা, তুমি আমায় ক্ষমা করো। আমি ভুল করেছি। অন্যায় করেছি। ক্ষমা করো, ক্ষমা করো।
আরেফিনের পরিবারের কথাও ভাবেন মোহিনী। দরিদ্র পরিবারটি আরেফিনের টাকায় চলতো। এখন কি হবে? কিভাবে চলবে? আমি কি টাকা পাঠাবো? এই পরিবারটির সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় ছিল না। শুধু আরেফিনকে দেখে বিয়ে করেছিলাম। তাও আবার কোর্টে গিয়ে। কারো সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতেরও প্রয়োজন ছিল না। আরেফিনও কোনোদিন বলেনি। চাপ দেয়নি। এখন আমি টাকা পাঠালে তারা বিষয়টিকে কিভাবে নেবে?
হঠাৎ আপামনি আপামনি করে রহিমাবিবি ছুটে আসে মোহিনীর কাছে। মোহিনীকে শুয়ে থাকতে দেখে সে বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, আপামনি, আপনার কি হইছে? এখনো শুইয়া আছেন কেন?
মোহিনী কোনো কথা বলেন না। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। সে ওকে কি বলবে? ও কি বুঝবে? ওর কাছে বললে কি মোহিনীর কষ্ট দূর হবে? কিন্তু মোহিনী জানেন, রহিমাবিবি নাছোরবান্দা। না জেনে সে যাবে না। তাই তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলেন, আমার মন ভালো নেই। আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তুই এখন যা।
রহিমাবিবি বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, আপামনি! আপনার মনও খারাপ হয়!
রহিমাবিবির কথাটা মোহিনীর কানে লাগে। রহিমার মুখ থেকে এই কথা শুনবেন ভাবতেও পারেননি তিনি। বিস্ময়ের সঙ্গে মোহিনী বললেন, কেন আমার মন খারাপ হতে পারে না?
আপনার মন খারাপ হইলে দুনিয়ার সব মানুষের মন খারাপ হবে। রহিমাবিবি বলল।
মোহিনী রহিমাবিবির দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তিনি নিজের শরীরে চিমটি কেটে বোঝার চেষ্টা করছেন, তিনি নিজে ঠিক আছেন কী না। তার মনে প্রশ্ন জাগে, ও কি আসলেই রহিমা; নাকি অন্য কেউ! এমন পরিণত কথা বলার মেয়ে কি রহিমা? বিস্ময়কর ব্যাপার তো!
হন্তদন্ত হয়ে মোহিনীর কক্ষে ঢুকলেন আনোয়ারা বেগম। উদ্বেগের সঙ্গে বললেন, কি রে মোহিনী! কি হয়েছে তোর? একদম ঘর থেকেই বের হচ্ছিস না! কোনো সমস্যা হয়েছে?
উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মোহিনী। তিনি কোনো কথা বলেন না। আসলে তিনি কথা বলতে পারেন না। আনোয়ারা বেগম মেয়ের পাশে বসে তাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেন। গভীর মমতায় মেয়েকে আদর করতে করতে বলেন, তুই আমাকে বল তো! কি হয়েছে মা?
আবেগের দৃষ্টিতে আনোয়ারা বেগমের দিকে তাকান মোহিনী। তবু তিনি তার কষ্টের কথা বলেন না। এই মুহূর্তে তিনি যদি কাঁদতে পারতেন তাহলে খুব ভালো হতো। তিনি নিজে কিছুটা হালকা হতে পারতেন। কিন্তু চেষ্টা করেও তিনি কাঁদতে পারছেন না। কান্নাও যে কঠিন সেটা আজ তিনি বুঝতে পারছেন। ইচ্ছা করলেই কাঁদা যায় না।
আনোয়ারা বেগম মেয়ের চিন্তায় অস্থির। হঠাৎ মেয়েটা এমন উদাসীন হয়ে গেল কেন তা নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। কথাটা না জানা পর্যন্ত তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন না। এক পর্যায়ে মোহিনীই মুখ খুললেন। তিনি ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন, মা আরেফিন আর নেই!
আনোয়ারা বেগম এসব কী শুনছেন! তিনি নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, আরেফিন আর নেই মানে কী? কি হয়েছে আরেফিনের?
আরেফিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে!
মোহিনীকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে ধরে থাকেন আনোয়ারা বেগম। এ ছাড়া মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার আর কিছুই খুঁজে পেলেন না।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/