পর্ব-১৮
বিষাদ বসুধা
আসিফ আহমেদ বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে বৈঠকে বসেছেন। করোনাকালীন সংকট কীভাবে মোকাবিলা করা যায়? লোক ছাঁটাইয়ের মতো বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত এড়িয়ে কীভাবে ব্যয় সংকোচন করা যায়, পত্রিকাটির আয় বাড়ানোর উপায়গুলো কী কী? এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যই জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকের শুরুতেই আসিফ আহমেদ বললেন, আমরা সবাইকে নিয়ে দীর্ঘদিন একসঙ্গে অনেক সংকট মোকাবিলা করেছি।
নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে একটা ভালো অবস্থান তৈরি করেছি। সেই মুহূর্তে বড় আঘাত এসেছে আমাদের ওপর। এ পরিস্থিতিতে আমাদের টিকে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ সবাইকে নিয়ে মোকাবিলা করতে চাই। আমরা কোনো কর্মীকে হারাতে চাই না। ভয়ঙ্কর এই সংকটের মধ্যে কাউকে ঢেলে দিতে চাই না। প্রয়োজনে আমরা কম খাব; কিন্তু সবাই একসঙ্গে থাকব। বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধান এখানে আছে। আমরা সবাই জানি, মার্কেটে আমাদের অনেক টাকা পড়ে আছে। সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকাও আমরা তুলতে পারছি না। কী করলে মার্কেট থেকে টাকা তোলা যাবে সেই সিদ্ধান্ত আজকে নিতে হবে। আমরা যদি পাঁচ ছয় কোটি টাকাও তুলতে পারি তাহলে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। সবার মতামতের ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। আমি শুরুতেই বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধান নূরুজ্জামানকে বলতে বলছি।
নূরুজ্জামান সম্পাদককে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, আমরা শুনেছি কর্তৃপক্ষ লোক ছাঁটাইয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। আমরা কাউকে হারাতে চাই না। আমরা সবাইকে নিয়েই চলতে চাই। আমি বিজ্ঞাপনের লোক। আমি বুঝি, টাকা না হলে কোনো কথাই টিকবে না। মার্কেট থেকে টাকা আনতে না পারলে এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। এখানে কর্তৃপক্ষের কারণে অনেক বাড়তি খরচ হয়। তারা এমন কিছু লোক দিয়ে রেখেছে যার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রেসে লোকবল অনেক বেশি। সেখানকার বেতন দিতে হয় আমাদের। কেন বাড়তি খরচ আমাদের ফান্ড থেকে যাবে? যাহোক, কথা না বাড়িয়ে আমি মার্কেট থেকে টাকা তোলার বিষয়ে কথা বলছি।
বেসরকারি বিজ্ঞাপন বাবদ মার্কেটে প্রায় বিশ কোটি টাকা এবং সরকারি বিজ্ঞাপন বাবদ আঠারো কোটি টাকা পড়ে আছে। আমরা বেসরকারি বিজ্ঞাপনের টাকা এই মুহূর্তে সেভাবে পাব না। পাব যা সেটা খুব বেশি না। সবাই অফিস বন্ধ করে বাসায় অলস সময় কাটাচ্ছে। তারা মনে করছে, এই মুহূর্তে জীবন বাঁচিয়ে রাখা অনেক বেশি জরুরি। আমাদের মতো তারা কেউ বাইরে যাচ্ছে না। সরকারি অফিস-আদালতও প্রায় বন্ধ বলা চলে। একজন আসে তো আরেক জন আসে না। সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকা তুলতে অনেকের সই সাবুত নিতে হয়। একজনের সই হলে আরেক জনেরটা পাওয়া যায় না। আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে আমরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি। সরকার নির্দেশ না দিলে এ মুহূর্তে বিজ্ঞাপনের টাকা পাওয়া কঠিন। তাহলে উপায় কী? টাকা ছাড়া বেতন দিব কীভাবে? আসিফ আহমেদ বললেন।
নূরুজ্জামান সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। বেতন তো দিতে হবে। বেতন না দিলে সহকর্মীরা চলবে কীভাবে? অনেকেই আমার কাছে বলে, ভাই বেতন কবে হবে? এতে সত্যিই খুব বিব্রত লাগে। কারণ, তাদের প্রশ্নের জবাব কী? টাকা না পেলে কোথা থেকে বেতন দেবেন? তবে আমি একটা প্রস্তাব রাখছি। সেটা হচ্ছে, আর দুই মাস পর তো ঈদ! তখন আমরা বেশ কিছু টাকা তুলে আনতে পারব। হাতে পায়ে ধরে হলেও আনব। আপনি গেল মাসের বেতনটা যদি আনতে পারেন; তাহলে খুব ভালো হয়। আপনি চেয়ারম্যান সাহেবকে বলেন না! উনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। আর খরচ কমানোর বিষয়ে বলব, লোক ছাঁটাই না করে পঞ্চাশ হাজারের ওপরে যাদের বেতন; তাদের দশ শতাংশ বেতন কমানো যেতে পারে।
আসিফ আহমেদ বললেন, আমি চেয়ারম্যান সাহেবকে ইতিমধ্যে দুতিনবার বলেছি। উনি শুধু বলেন, দেখি কী করা যায়। নূরুজ্জামান আবারও বলল, আরেকটা কাজ করা যায়। সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকা যাতে দ্রুত ছাড় করে সেজন্য লেখালেখি করা যায়। তাহলে হয়তো সরকারের টনক নড়বে। সরকার গার্মেন্টস শিল্পকে প্রণোদনা দিচ্ছে। অথচ গণমাধ্যমের লোকরা না খেয়ে মরছে। প্রণোদনা তো সবার আগে দরকার সাংবাদিকদের। গণমাধ্যমের জন্য প্রণোদনা তো নয়ই সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকাও দিচ্ছে না। বোঝাই যাচ্ছে সরকার কী করতে চাচ্ছে। সরকার আসলে গণমাধ্যমকে গলা টিকে মারতে চাচ্ছে। করোনাকে একটা সুযোগ হিসেবে নিয়েছে।
উপসম্পাদক মামুন রশিদ বলল, আমরা কর্তৃপক্ষকে এত বছর সাপোর্ট দিয়েছি। যখন যা বলেছে করেছি। এখন আমাদের বিপদের সময়। এ সময় আমাদেরকে সাপোর্ট দেবে না? এটা কি করে হয়? তাদের স্বার্থে কতভাবে আমাদেরকে ব্যবহার করেছে। এই পত্রিকা দিয়ে তারা কি না করেছে? রীতিমতো ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। এখন যদি তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকে তাহলে হবে? আমরা না হয় এধার ওধার করে চলতে পারি। কিন্তু যারা কম বেতন পায় তারা চলে কীভাবে?
বাণিজ্য সম্পাদক রাশেদ ইকবাল বলল, আমার মনে হয়, নূরুজ্জামান ভাই একটা তালিকা করেন। বেসরকারি বিজ্ঞাপনের টাকা কাদের কাছ থেকে পাওয়া সহজ হবে। প্রয়োজনে সম্পাদক কথা বলবেন। আমরাও কথা বলতে পারি। ধরাধরি না করলে টাকা পাওয়া যাবে না। কাকে ধরলে কাজ হবে সেটা বলেন। আর সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য তথ্যমন্ত্রীকে ভালো করে ধরা যায়। আবার রিপোর্টও করা যায়। তাহলে বিষয়টা প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসবে। তিনি যদি সরাসরি নির্দেশ দেন তাহলে কাজ হবে।
সহকারী সম্পাদক ইলিয়াস আলী বলল, আসিফ ভাই খরচ কমানোর বিষয়ে কথা বলেছেন। আমরা কি সে বিষয়ে আলোচনা করতে পারি? খরচ কমানোর বিষয়ে আমার কিছু প্রস্তাব আছে। উপসম্পাদক রিশিত খান বলল। আসিফ আহমেদ বলল, কী প্রস্তাব বলো না!
রিশিত খান বলল, বাসায় যে সৌজন্য পত্রিকা দেওয়া হয় তা আপাতত বন্ধ রাখা যেতে পারে। ব্যক্তিগত গাড়ি যারা পাচ্ছে তাদের ফুয়েল অফিস থেকে দেওয়া হয়। সেটাও আপাতত বন্ধ রাখা যায়। আর নূরুজ্জামান সাহেব বেতন কমানোর বিষয়ে যেটা বললেন, তাতে আমি একমত। লোক ছাঁটাই না করে বেতন কমানো যেতে পারে। আমরা কম খাব। কিন্তু লোক ছাঁটাই করা যাবে না।
রাকিব নোট করেছ তো? আসিফ আহমেদ বলল।
রাকিব বলল, জি স্যার।
আর কারও কিছু বলার আছে?
চিফ রিপোর্টার জামিল আহমেদ হাত উঁচু করে বলল, আমি কিছু বলতে চাই।
বলো বলো। সম্পাদক বললেন।
জামিল বলল, অফিসের কাগজ সাশ্রয় করার জন্য ইনহাউস প্রিন্টিং বন্ধ রাখা যেতে পারে। রিপোর্টগুলো আমরা প্রিন্ট না দিয়ে সার্ভারে রেখেও কাজটা করতে পারি। তাতে মাসে লক্ষাধিক টাকা সাশ্রয় হবে। তা ছাড়া স্টেশনারি কেনা বাবদ খরচ কেমন হয় তা যাচাই করা যেতে পারে। আমার মনে হয় সেখানে খরচ কমানোর সুযোগ আছে।
আসিফ আহমেদ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, আমরা অনেকগুলো পয়েন্ট পেয়েছি। এগুলো নিয়ে আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।
বৈঠকে শেষ হতে না হতেই তিন-চার জন সংবাদকর্মী সম্পাদকের কক্ষে এলো। তারা বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমাদের বেতন দেরি হচ্ছে বলে সংসারে নানা রকম ঝামেলা হচ্ছে। আমাদের অনেকের ঘরে বাজার নেই। ধারকর্জ করে কত চলা যায়? এখন সবারই তো টানাটানি অবস্থা। আসিফ তাদেরকে ধৈর্য ধরতে বললেন। আর বললেন, মার্কেট থেকে কোনো টাকা পাচ্ছি না। যখনই পাওয়া যাবে, সেই টাকা দিয়ে তোমাদের বেতন আগে দেওয়া হবে। চিন্তা করো না।
আসিফ নিজের পকেট থেকে এক হাজার টাকা করে চারজনকে চার হাজার টাকা দিলেন। আপাতত চলো। এই টাকা আমাকে ফেরত দিতে হবে না। সবাই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো আসিফের দিকে। দুয়েক জন বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, আসিফ ভাই আপনার পকেট থেকে..!
আসিফ আহমেদ বললেন, কোনো অসুবিধা নেই। আপাতত চলো।
সংবাদকর্মীরা আর দাঁড়াল না। এর মধ্যে বৈঠকেও শেষ হয়েছে। বিভাগীয় প্রধানরা চলে যাওয়ার মুহূর্তে আবারও বলল, যা কিছুই করেন, লোক ছাঁটাই কিছুতেই মানা যাবে না। আসিফ আহমেদ মাথা নেড়ে তাদের কথায় সায় দিলেন।
আসিফ আহমেদ খরচ কমানোর কিছু খাত বের করলেন। তাতে দেখা গেল প্রায় চল্লিশ লাখ টাকার মতো খরচ কমে। তিনি মনে মনে খুবই পুলকিত বোধ করলেন। কষ্টের মধ্যেও এক ধরনের সান্ত্বনা খুঁজে পেলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, যাক বিপদের দিনে অন্তত লোক ছাঁটাইয়ের মতো অনাকাঙিক্ষত সিদ্ধান্ত নিতে হবে না। তিনি ছুটে গেলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহবাজ খানের কাছে। তার কাছে লিখিতভাবে বিষয়টি উত্থাপন করলেন। সবকিছু দেখার পর শাহবাজ খান বললেন, এসব করে কিছুই হবে না। লোক ছাঁটাই ছাড়া সামাল দেওয়া যাবে না। এখন কী মাস? মে তো?
আসিফ আহমেদ মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ মে শুরু হলো। ডিসেম্বরের আগে কিছুই ঠিক হবে না। আরও সাত মাস টানা সম্ভব না। একেবারেই সম্ভব না। আপনি ছাঁটাইয়ের তালিকা বানান। খুব দ্রুত তালিকা বানান। ছাঁটাইয়ের তালিকা! না না! লোক ছাঁটাই করা যাবে না! এই মুহূর্তে লোক ছাঁটাই করলে খুব সমালোচনা হবে। মানুষে খারাপ বলবে। আমি অন্যভাবে ছাঁটাই করব। কেউ বুঝতে পারবে না। শোনেন, কে কী বলল ওসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। কাউকে পরোয়াও করি না। পত্রিকা প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। এত লোক দিয়ে আমি কী করব?
করোনার পর লোক দরকার হবে না? হবে। তখনকারটা তখন দেখব। আপনাকে যা বলছি তা করেন। আপনি তালিকা বানান। এখন যান। তালিকা নিয়ে পরশুদিন আসেন। হঠাৎ শাহবাজ খানের বদলে যাওয়া চেহারা দেখে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আসিফ। কিছুক্ষণ পর তিনি নিজের অফিসের দিকে রওয়ানা হন।
চলবে...
আগের পর্ব পড়ুন: