ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৫
বিষাদ বসুধা
আরেফিন জ্বরে কাতর। তিনি থরথর করে কাঁপছেন। তিনি নিজের কপালে হাত দিয়ে দেখেছেন, শরীরে জ্বরের মাত্রা একশ’ তিন চারের কম হবে না। জ্বরটা মাপতে পারলে ভালো হত। কিন্তু তার কোনো উপায় নেই। শেষ রাতের দিকে কাঁপিয়ে জ্বর আসে তার। তখনই তিনি বিছানা থেকে উঠে দুটি প্যারাসিটামল খেয়েছেন। কিন্তু তাতে পুরোপুরি জ্বর সারেনি। তাপমাত্রা কিছুটা কমেছিল। এখন আবার বেড়েছে।
জ্বরের কাঁপুনিতে তার ঘুম ভেঙে যায়। জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। মাথাটা মনে হচ্ছে ছিড়ে যাচ্ছে। বিছানা থেকে মাথা তুলতে পারছেন না। মাথায় পানি দিতে পারলে হয়ত জ্বরের মাত্রাটা কমতো। সেজন্য তিনি কয়েকবার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু মাথার যন্ত্রণা এমন বেড়েছে যে, বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। তাছাড়া শরীরের কাঁপুনিও অনেক বেড়েছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হয় তার।
আরেফিন লেপ গায়ে দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। তার মাথায় নানা রকম চিন্তা ঢুকেছে। তিনি মনে মনে ভাবেন, এখন জ্বর মানে করোনা। করোনা হলে আপনজনরাই কাছে আসে না। আর হোটেলের লোকজন তো আসবেই না। হোটেল কক্ষেই মরে পড়ে থাকবো! হায় হায়! এ রকম মৃত্যু খোদা-তায়ালা আমার কপালে লিখল! না না! এ রকম মৃত্যু আমি চাই না!
আরেফিন মাকে ডাকছেন। বাবাকে ডাকছেন। মোহিনীর কথাও বার বার মনে পড়ছে। সবাইকে ছেড়ে তিনি চলে যাবেন! পৃথিবী থেকে শেষ বিদায়ের দিনেও প্রিয়জনরা তার মুখ দেখতে পারবেন না! এটা কিছুতেই মানতে পারেন না আরেফিন। বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করেন আরেফিন। উঠতে গিয়েও উঠতে পারেননি তিনি। তার শরীরে এক রতি বলও নেই। তার কাছে মনে হচ্ছে তিনি শূন্যে ভাসছেন। তিনি চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। কিন্তু সেই চিৎকারের শব্দ যেভাবে বের হচ্ছে তা খুবই আজব ধরনের। আর তার শব্দ কক্ষের বাইরে কেউ শুনতেও পাবে না। কাউকে ডাকলে হয়ত আসত। তার ভালোমন্দ খোঁজখবর নিত। জ্বরের কথা জানার পর হয়ত চলে যেত। কিন্তু হোটেলের লোকজনকে তো জানতে হবে, আরেফিন গভীর সংকটে পড়েছেন!
আরেফিনের প্রচণ্ড পানির পিপাসা লেগেছে। তার দুই ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তটা সে দেখতে পাচ্ছে। তার মানে মানুষের জীবনের সবচেয়ে কঠিন মৃত্যুর সময়টা! আর সেই সময়ই কি আরেফিনের সামনে সমাগত! আরেফিনের কাছে তাই মনে হচ্ছে। মৃত্যু চিন্তা তাকে কাতর করে তুলেছে। তার ধারণা, মৃত্যু আসবে বলেই তাকে করোনায় ধরেছে। মৃত্যুদূতের তো একটা অজুহাত লাগবে! তা না হলে জান-কবজ করবে কি করে? এখন তার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। বাঁচার কোনো আশা নেই।
বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন আরেফিন। তিনি যে একদিক থেকে আরেকদিকে ঘুরবেন তাও পারছেন না। শরীর মোটেই সায় দিচ্ছে না। তার মানে কি আজরাইল তার গায়ের উপর চেপে বসেছে? মাথাটা মনে হচ্ছে কেউ লোহার শিক দিয়ে বেঁধে রেখেছে। মোটেই নাড়াতে পারছে না। এটাই কি তার শেষ মুহূর্ত! সে কি মুখে একটু পানিও দিতে পারবে না! বিছানার পাশের টেবিলে পানির বোতল থাকার কথা। পাশ ফিরে না দেখতে পারলে তো বুঝতে পারবে না! অনেক চেষ্টার পর তিনি তার মাথাটা ডানদিকে ঘুরিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এদিকে কোনো পানির বোতাল নেই। কথায় বলে, অভাগা যেদিকে তাকায় সাগর শুকিয়ে যায়। আরেফিনের অবস্থা সে রকমই হয়েছে। এক ফোটা পানির জন্য তার কাতর অবস্থা। অথচ পানি মুখে দেওয়ার মতো অবস্থায় তিনি নেই।
এবার আরেফিন অন্যদিকে মাথা ঘোরাবে বলে মনস্থির করেছেন। কিন্তু এখন তার শরীরের যে অবস্থা; তাতে মনে হচ্ছে, তার ইচ্ছায় এখন আর শরীর চলে না। শরীরের ইচ্ছায় তাকে চলতে হয়। শরীর সায় দিলে সে চলে। সায় না দিলে তিনি মরার মতো পড়ে থাকে। এখন তিনি মাথা ঘোরানোর চেষ্টা করছেন। কতক্ষণে পারবেন তা বুঝতে পারছেন না। গলা লোহার মতো শক্ত হয়ে আছে।
আরেফিন মনে মনে ভাবেন, আজরাইলের কি কোনো মায়াদয়া বলতে কিছু নেই! এতো কষ্ট দেয় মানুষকে! অবশ্য মায়াদয়া থাকলে তো জানকবজই করতে পারত না। তাকে দোষ দিয়ে লাভ কি। সৃষ্টিকর্তা তাকে ওভাবেই তৈরি করেছে। সে শুধু আল্লাহর নির্দেশ পালন করবে। কখন তাতে তুলে নিতে হবে তা নির্ধারিত। তাকে রোধ করার সাধ্য কারো নেই। বিজ্ঞানীরা এতো এতো অস্বাভাবিক এবং বিস্ময়কর জিনিস আবিষ্কার করছে। এক গ্রহ থেকে আরেক গ্রহে যাচ্ছে। অন্য গ্রহে বসাবাসের চিন্তা করছে। অথচ তারা মানুষের মৃত্যু রোধ করতে পারছে না। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ভাইরাস; যা চোখে দেখা যায় না। সেই ভাইরাসের ভয়ে সারাবিশ্বের মানুষ তটস্থ। সে ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে। সন্দেহ করছে। সামাজিকতা, পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠান সব বন্ধ হয়ে গেছে। হোটেল রেস্তোরাঁগুলো খাঁ খাঁ করছে। কোথাও কোনো আড্ডা নেই। গল্প নেই। আলোচনা সমালোচনা নেই। মানুষে মানুষে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ। কী এক আজব সময় পার করছি আমরা!
আরেফিন এক দুঃসহ যন্ত্রণার সময় কাটাচ্ছেন। এ যে মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়েও কঠিন। মৃত্যু চিন্তা যখন মাথায় ঢোকে তখন সব মানুষই হয়ত এমন যন্ত্রণাদায়ক সময় পার করে। তার মাথায় নেতিবাচক চিন্তাগুলো ঢুকতে থাকে। সেগুলো তাকে সারাক্ষণ খোঁচাতে থাকে। তার অঙ্গপ্রতঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে।
আরেফিন অনেক চেষ্টার পর অন্যপাশে ফিরেছেন। তিনি খাটের পাশের ছোট্ট টেবিলে একটি পানির বোতল দেখেছেন। বোতলটা হাতের নাগালের বাইরে। দুইতিন হাত সামনে না আগালে তিনি বোতলটা হাতে পাবেন না। তিনি আস্তে আস্তে সামনের দিকে আগানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তার শরীর ব্যথায় টুকরো হয়ে আছে। হাত-পা নাড়াতে পারছেন না। এক রাতের জ্বরের শরীর এতো দুর্বল হয় কী করে! সে ভাবনাও তার মাথায় ঘুরপাক খায়। তিনি কি সত্যিই মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তটা পার করছেন!
টানা দুদিন মৃত্যুদূতের সঙ্গে যুদ্ধ করেন আরেফিন। তার প্রতিটি মুহূর্ত কাটে আশা আর দূরাশার দোলাচলে; বাঁচা আর মরার সঙ্গে যুদ্ধ করে। সে এক কঠিন যুদ্ধ। এক এক করে জীবনের সব আলো যখন নিভে যায় তখন টানেলের এক টুকরো আলোও তার মনে বাঁচার আশা জাগায়। আরেফিন মনে মনে ভাবেন, পৃথিবীর মায়া যেভাবে আমাকে টানছে তাতে হয়ত মরতে মরতে বেঁচে যাব আমি! ফিরে যাব আমার ভালোবাসার কাছে; আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে। ফিরে যাব মা বাবার কাছে। যারা আমাকে এই সুন্দর পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিলেন। তা না হলে হয়ত দেখাই হত। কিংবা দেখা হত অন্যভাবে। অন্য কোনো পরিবেশে। অন্য কোনো পরিবারে। তাতে পৃথিবীকে উপলব্ধি করার মতো কোনো অনুসঙ্গ খুঁজে পেতাম না। এ যাত্রায় বেঁচে গেলে আমি আমার প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যাব। তারা নিশ্চয়ই অধীর আগ্রহে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে যেতেই হবে। তা নাহলে যে সবার স্বপ্নভঙ্গ হবে। আমার নীরব প্রস্থানের মধ্যদিয়ে সবার স্বপ্ন অঙ্কুরে বিনাশ হবে তা নিশ্চয়ই প্রকৃতি কিংবা বিধাতা কেউই চাইবেন না। যে পৃথিবীকে আমি এতো ভালোবাসি; সেই পৃথিবী আমাকে এভাবে বিদায় দেবে! না না; তা কিছুতেই হতে পারে না।
আরেফিন ঘোরের মধ্যেই তার মা বাবার সঙ্গে কথা বলেন। তাদের কাছে ক্ষমা চান। ভুলত্রুটির ক্ষমা। তাদের জন্য কিছু না করতে পারার ক্ষমা। তাদের কারণে অকারণে কষ্ট দেওয়ার ক্ষমা। তার প্রিয়তমা স্ত্রী মোহিনীর কাছেও তিনি ক্ষমা চান। তিনি বলেন, এই জীবনে তো তোমার সঙ্গে আমার সময়টা ভালো গেল না! পরজনমে যেন তোমায় পাই। তুমি কথা দাও। পরজনমে তুমি আমারই থাকবে। আমি ছাড়া তোমাকে এতোবেশি ভালোবাসা কেউ দেবে না; কেউ না। তুমি দেখ। আমি যে কত ভালোবেসেছি তোমাকে; তা তুমি টের পাবে। নিশ্চয়ই টের পাবে। আমার শারীরিক উপস্থিতি হয়ত তখন থাকবে না। কিন্তু তোমার জীবনের পরতে পরতে আমার উপস্থিতি টের পাবে।
আরেফিন হয়ত শেষ নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তেই বললেন, বিদায় পৃথিবী; বিদায়!
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/