ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১৯
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
ওরা চলে গেলে ও হাতে ধরা কেক আর শিঙাড়ার পোঁটলা টেবিলের ওপর রেখে কমনরুমের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। কী ভালো লাগছে হাঁটতে। এমন একটি সুন্দর ঘর ও দেখেনি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট পা ফেলে দৌড়ায়। কখনো দু’হাত উপরে তুলে নাচতে নাচতে হাঁটে। কখনো চেয়ারে উঠে ধপ করে লাফ দেয়। সময়ের এমন বৈচিত্র্যময় আবেগ ওর শিশু বয়সকে তাড়িত করে। স্মৃতির সঞ্চয়ে চলে যায় দিনের সবটুকু সময়।
একটু পরে ফিরে আসে অঞ্জন।
–কী করছিস রে কুকড়ি?
–খেলছি।
–কী খেলা?
–এমন সুন্দর ঘরের সঙ্গে খেলা। হেঁটেছি, দৌড় দিয়েছি, নাচ করেছি, লাফ দিয়েছি–
–বাহ, দারুণ মেয়ে।
ও আবার দু’হাত উপরে তুলে লাফাতে থাকে। অঞ্জন ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন একটি শিশুকে কাছ থেকে দেখা ওর হয়নি। ও কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয় ওর যতক্ষণ ইচ্ছা লাফালাফি করুক। এটা ওর আনন্দ। বস্তিতে থেকে খেয়ে-না খেয়ে এই আনন্দ ও পায়নি। তখনই ভাবে ওকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। যতদিন ওর মা হাসপাতালে থাকবে ততদিন নিজের বাড়িতে মেয়েটিকে রেখে দেওয়ার জন্য বাবা-মাকে রাজি করাবে। মনে মনে ভাবে, বাড়িতে তো আর কোনো শিশু নেই। বাবা-মা ঠিকই রাজি হবে। তারাও শিশুর কাছ থেকে পাওয়া আনন্দ উপভোগ করবে। এটা নিয়ে ওর আর দ্বিধা নেই।
কুকড়ি একসময় লাফালাফি থামিয়ে অঞ্জনকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। বলে, ভাইয়া আমি এখন কী করব?
–তোকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব।
–আমি কি তোমার বাড়িতে কয়দিন থাকব?
–হ্যাঁ, তোর মা যতদিন হাসপাতালে থাকবে সেই কয়দিন।
–আমি মায়ের কাছে যেতে চাই। মাকে কেক আর সিঙাড়া দেব। আমার মায়ের জন্য আপুরা আমাকে দিয়েছে। আমি খুশি, খুশি।
– চল যাই, হাসপাতালে।
কুকড়ি একছুটে বাইরে চলে যায়। গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অঞ্জন কাছে গেলে হাত ধরে। দু’জনে হেঁটে চলে আসে হাসপাতালে। ওয়ার্ডে ঢুকে বিছানার কাছে গেলে দেখতে পায় হালিমা খাতুন ঘুমাচ্ছেন। কুকড়ি খাটের ওপর উঠে মায়ের বালিশে মাথা রেখে গলা জড়িয়ে ধরে।
– মা, মা–। ডাকতে থাকে।
চোখ খোলেন না হালিমা খাতুন। অঞ্জন ঘাবড়ে যায়। ভাবে, এমন নিঃসাড় ঘুম তো হওয়ার কথা না। মেয়ের ডাকাডাকিতে চোখ খুলছেন না। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে নেই, অজ্ঞান হয়ে গেছেন নাকি? ও ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে। কুকড়ি আরও কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে। একইভাবে বিছানায় পড়ে থাকেন হালিমা খাতুন।
কুকড়ি কাঁদতে শুরু করে। খাট থেকে নেমে বলে, মায়ের কী হয়েছে ভাইয়া?
– জানি না তো। চল, ওনাদের জিজ্ঞেস করি। অঞ্জন নার্সদের টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। নার্স সবিতা বলে, দেখলাম আপনি পাঁচ নম্বর বেডের কাছ থেকে এসেছেন। মহিলা বেশ কিছুক্ষণ ধরে অজ্ঞান হয়ে আছেন। আমরা ডাক্তারকে খবর দিয়েছি। উনি এখনই এসে যাবেন। আপনারা চলে যান।
কুকড়ি কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি মায়ের জন্য কেক আর সিঙাড়া এনেছি।
– তোমার মা এসব খেতে পারবেন না। তুমি নিয়ে যাও। খেয়ে ফেলো।
– মা কবে ভালো হবে?
– হয়ে যাবেন। এখন বাড়ি যাও।
– আমার তো বাড়ি নাই। আমি বস্তিতে থাকি। ভাইয়া আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবে।
অঞ্জন সবিতাকে বলে, যাই সিস্টার। খোদা হাফেজ।
– মেয়েটিকে কোথায় পেলেন?
– শহীদ মিনারের কাছে। মা অসুস্থ দেখে ভর্তি করে দিলাম।
– মেয়েটিকে কি এতিমখানায় রাখবেন?
– না, বাড়িতে রাখব। বাবা-মাও রাখতে চাইবেন আমি জানি। স্কুলে ভর্তি করে দেব।
– বাব্বা, আপনি তো একজন মানবিক মানুষ। অনেক বড় দায়িত্ব নিচ্ছেন।
– এই দায়িত্ব পালন করার সাধ্য আমার আছে। তাহলে ওকে পথশিশু বানাব কেন? সবাই মিলে এমন দায়িত্ব নিলে পথশিশু থাকবে না রাস্তায়।
– ঠিক বলেছেন।
অঞ্জন আর কথা বাড়ায় না। কপালে হাত ঠেকিয়ে সবিতাকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে আসে।
সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে কুকড়ি জিজ্ঞেস করে, আমার মা কি মরে গেছে?
– বাজে কথা বলছিস কেন?
– তাহলে মা আমার দিকে তাকায়নি যে। আদর করেনি যে।
– মা অজ্ঞান হয়ে আছে।
– অজ্ঞান কী?
– অসুখ। চোখ খুলতে না পারার অসুখ।
– ও আচ্ছা।
কুকড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। গেটের কাছে একজন বৃদ্ধ ভিক্ষুককে দেখে হাতের পোটলাটা এগিয়ে দিয়ে বলে, দাদু এটা খান।
– কী রে এখানে?
– কেক আর সিঙাড়া।
– দে-দে।
বৃদ্ধ হাত বাড়িয়ে খাবারের পোটলাটা নেয়।
– তোকে অনেক দোয়া করি দাদু।
– হ্যাঁ, আমাকে অনেক দোয়া করবেন। আমি যাই।
অঞ্জন মেয়েটির আচরণে বিস্মিত হয়। এইটুকু মেয়ে এতকিছু ভাবতে পারে তাহলে নিঃসন্দেহে ও একটি মেধাবী মেয়ে। পড়ালেখা করালে ভালোভাবে এগোতে পারবে। কুকড়ি এসে ওর হাত ধরে।
– চল যাই।
চলবে....
এসএ/