সারা জেরীন তাসপিয়া
সেলিনা হোসেনের উপন্যাস: জীবনের অন্যতর আলোর সন্ধান
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের লেখালেখির প্রেরণার মূলে প্রকৃতি ও মানুষ এবং মানুষের লড়াই-সংগ্রাম। উপন্যাসে বিষয় ও চরিত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিচয় মেলে তার ব্যতিক্রম সৃষ্টিভাবনা। তিনি বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের জগৎ ছুঁয়ে আধুনিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গভীরে প্রবেশ করেছেন অবলীলায়। এ ছাড়াও প্রান্তিক মানুষের সুখদু:খ, জীবনের টানাপোড়েন, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ও বাঙালির গৌরবগাথা তিনি মেলে ধরেছেন বহুমাত্রিক নানা রচনায়।
সেলিনা হোসেনের ভিন্নমাত্রিক এক উপন্যাস ‘গাছটির ছায়া নেই’ উপন্যাসটি। এ উপন্যাসের বিষয় একটি দূরারোগ্য অসুখ। সঙ্গে রয়েছে ব্যক্তির প্রেমের টানাপোড়ন এবং প্রেমের পরিণতিতে জীবনের ছোঁয়া। মূলত এইচআইভি এইডস নামক অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে বইটি গড়ে উঠেছে দুই মহাদেশের কতিপয় মানুষের গল্প। লেখক বইটির শুরুতেই পাঠকদের জানিয়েছেন, দেশ এবং বিদেশে এইচআইভি এইডস আক্রান্ত যেসব মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে তাদের নিয়েই এই উপন্যাসের গল্প। এ উপন্যাসের পরতে পরতে রয়েছে জীবনেরই জয়গান এবং যাপিতজীবনে অন্যতর আলোর সন্ধান।
এ উপন্যাসের নায়িকা চরিত্র অনামিকা। সে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করে। এইচআইভি/এইডস তার কাজের ক্ষেত্র। সে তার নারী জীবনের ধূসর কালপর্ব কাটিয়ে দেখতে পায় অন্যতর আলো। সে অন্যান্য অসহায় নারীদের প্রতি তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এ পথেও তাকে অনেক বাঁধা ডিঙ্গোতে হয়। এ নারী চরিত্রটি একটি নারীর একার লড়াইয়ের গল্প কিংবা জয়ের গল্প। ব্যক্তি জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় খুব সুক্ষ্মভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক। আবার নাগরিক জীবনের মনস্তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ করেছেন কাহিনির বিভিন্ন গতিসূত্রে। এ উপন্যাস নারীর-পুরুষের সুন্দর ও স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক স্থাপনে সচেতন হতে শেখাবে। এটি এইডস প্রতিরোধ কিংবা সুস্থ জীবন যাপনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সেলিনা হোসেন তার ‘গাছটির ছায়া নেই’ উপন্যাসের বিভিন্ন অসংগতি কিংবা সামঞ্জস্যহীনতাও তুলে ধরেছেন। শুরুতেই পরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার খামখেয়ালিপনা লক্ষ্য করা যায়। নারীর প্রতি অত্যাচার, কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণে নারীকে দোষারপ করা। যৌন নির্যাতন, কন্যা সন্তানকে অগ্রাহ্য করা, ধর্ষণ কিংবা প্রশাসনের প্রতি অসহায় মানুষদের অনাস্থার বিষয়গুলোও রয়েছে। বর্তমান সমাজের বাস্তব প্রতিচ্ছবিই যেন বইটি।
গ্রামীণ জনজীবনের আনন্দ, বেদনা, বেচে থাকার স্বপ্ন কিংবা লড়াইয়ের গল্প উঠে এসেছে বইটিতে। তিনি এক একটি বাক্যের মধ্য দিয়ে পাঠকদের সমাজ, সংস্কৃতি, দেশ ও দেশের সম্পদ রক্ষায় সচেতন হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। পথের একটি স্বপ্ন বালকের ছোট্ট একটি ইচ্ছে, নোংরা বুড়িগঙ্গা নদীটির সুন্দর একটি নাম ও রূপ দেয়া। আমাদের নদীগুলোর এ খারাপ সময়য়ে বাক্যটি পাঠকদের জন্য দেশের সকল নদী রক্ষায় অনেক বড় একটি বার্তা।
সেলিনা হোসেন তার লেখার মাধ্যমে জীবনের কথাই বলেন; জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়। বর্তমানে স্বপ্ন দেখানোর মানুষের দেখা মেলা ভার, হতাশার বিস্তার চারদিকে। এ সময়ে সেলিনা হোসেনের কথাসাহিত্য মানব জীবনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিজয় হিসেবে ধরা যায়। ‘গাছটির ছায়া নেই’ বইটি তেমনি জীবনের কথা বলেছে। সমাজের যা কিছু মন্দ যা কিছু অন্ধকার তা রুখে দিতে আহ্বান করেছে। নারীকে আরও দৃঢ় ও শক্তিশালী হয়ে ওঠার গল্প এটি।
সেলিনা হোসেন বলে থাকেন, তার শৈশবটি ছিল একটি আশ্চর্য সোনালী শৈশব। মাঠেঘাটে, বনে-জঙ্গল ঘুরে বেড়ানোর এক অবাধ স্বাধীনতা ছিল তার। যে কারণে সাধারণভাবেই বিচিত্র মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক দেখার সুযোগ হয়েছিল। আর এই সুযোগটিই তার লেখালেখিতে আসার প্রেরণা যুগিয়েছে। ‘গাছটির ছায়া নেই’ তার বিচিত্র গল্পভাবনা ও অভিজ্ঞতার নির্যাস পাওয়া যায়।
একজন সাহিত্যিকের জীবনের মৌল বিষয় হচ্ছে মানবতার পক্ষে থাকা, মানুষের অধিকারের পক্ষে থাকা, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তিনি তার সৃষ্টিকর্মে পাঠকদের কাছে মানবতার বার্তাটিই তুলে ধরেছেন। সর্বোপরি, এ উপন্যাসটি নারীকে তার অধিকারের বিষয়ে সচেতন হতে শেখাবে। পাশাপাশি শেখাবে মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস ও শক্তি।
গাছটির ছায়া নেই
লেখক: সেলিনা হোসেন
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশক: ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ
দাম: ৩০০