ব্রয়লার মুরগি দ্রুত বড় করতে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প নিমের নির্যাস
অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগী গবেষক আবু রায়হান । ছবি সংগৃহিত
বর্তমানে দেশে প্রাণিজ আমিষের চাহিদার একটা বড় অংশই পূরণ করে ব্রয়লার মুরগি। কিন্তু মুরগি সুস্থ রাখা ও ওজন বাড়ানোর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই এই অ্যান্টিবায়োটিক মানবদেহেও পৌঁছে যাচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমাদের শরীরে তৈরি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (প্রতিরোধী)। এভাবে চলতে থাকলে একসময় অনেক অ্যান্টিবায়োটিকই শরীরে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হবে। স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে ধীরে ধীরে।
এ সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগী গবেষক আবু রায়হান। অ্যান্টিবায়োটিকের বদলে নিমপাতার নির্যাস প্রয়োগ করে নিরাপদ ও দ্রুত বর্ধনশীল ব্রয়লার উৎপাদনে সফল হয়েছেন তাঁরা। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প খুঁজছিল এই গবেষক দল।
অ্যান্টিবায়োটিক কী ?:
অ্যান্টিবায়োটিক হল এক ধরনের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল পদার্থ, যা ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে বা বৃদ্ধিতে বাঁধা দেয়, মানব ও প্রাণীচিকিত্সা উভয় ক্ষেত্রেই সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধের জন্য অপরিহার্য। অ্যান্টিবায়োটিক (ইংরেজি: antibiotic) কয়েক ধরনের জৈব-রাসায়নিক ঔষধ যা অণুজীবদের (বিশেষ করে) ব্যাক্টেরিয়া নাশ করে বা বৃদ্ধিরোধ করে।
সাধারানতঃ এক এক অ্যান্টিবায়োটিক এক এক ধরনের প্রক্রিয়ায় অন্যান্য অণুজীবের বিরুদ্ধে কাজ করে। বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়া (Bacteria) ও ছত্রাক (Fungi) থেকে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা হয়। "অ্যান্টিবায়োটিক" সাধারণভাবে ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়, ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে না।
যেভাবে পাওয়া গেল সমাধান:
২০০০ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর উচ্চশিক্ষার জন্য একটা দীর্ঘ সময় জাপানে ছিলেন অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম। দেশে ফিরে যখন দেখলেন, ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে ব্যাপক হারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হচ্ছে, নিজের সন্তানদের এই মুরগি খেতে নিরুৎসাহিত করতেন তিনি। কিন্তু ভেবে দেখলেন, এটা তো আদতে সমাধান নয়।
এ সমস্যার সমাধানে প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প খোঁজা শুরু করেন শফিকুল ইসলাম ও আবু রায়হান। শফিকুল বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প উপায়ে নিরাপদ ও দ্রুত বর্ধনশীল ব্রয়লার উৎপাদনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা বিভিন্ন ধরনের প্ল্যান্টের নির্যাস, হারবাল নির্যাস ব্যবহার করে পরীক্ষা চালিয়েছি। তবে সলটেক্স পদ্ধতিতে নিমের নির্যাস ব্যবহারের ফলে সবচেয়ে ভালো ফল পেয়েছি। এতে দেখা যায়, অ্যান্টিবায়োটিকের চেয়েও এই নির্যাস ভালো কাজ করে। ব্রয়লারের ওজন তুলনামূলক বেশি পাওয়া গেছে। রোগবালাই ও মৃত্যুর হারও অনেক কম।’
সহযোগী গবেষক আবু রায়হান যোগ করলেন, ‘নির্যাসটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হলে বাজারে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে যা খরচ হয়, তার চেয়ে কম খরচে মুরগি উৎপাদন করা যাবে। আবার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করার ফলে এই মুরগি যেকোনো সময় বাজারজাত করার উপযোগী থাকে। এর কোনো প্রত্যাহার সময়সীমা নেই।’
রায়হান জানান, স্বাভাবিকভাবে ২৫ দিন বয়সী একটি একটি মুরগির ওজন হয় গড়ে ১ কেজি ২০০ গ্রাম। বাজারে প্রচলিত গ্রোথ প্রোমোটার ব্যবহার করলে একই সময়ে এই মুরগিগুলো ওজন ১ কেজি ৩০০ গ্রামে পৌঁছে যায়। কিন্তু সলটেক্স পদ্ধতিতে নিমের নির্যাস ব্যবহার করে তাঁরা ২৫ দিন বয়সী মুরগির প্রায় ১ কেজি ৪০০ গ্রাম ওজন পেয়েছেন। মুরগির মৃত্যুহারও এ ক্ষেত্রে শূন্যের কাছাকাছি।
সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ:
এ গবেষণা বাংলাদেশের পোলট্রি শিল্পে নতুন বিপ্লব আনতে পারে বলে মনে করেন শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে আশার কথা হলো, বাজারে প্রচলিত গ্রোথ প্রোমোটার ও অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে উৎপাদিত মুরগির চেয়েও আমাদের উৎপাদিত মুরগিগুলো বেশি বর্ধনশীল। ফলে প্রান্তিক খামারিরা এই মুরগি উৎপাদনে বেশি আগ্রহী হবেন।’