ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল, পর্যটন শিল্পে ধস মালদ্বীপের
ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি মালদ্বীপের তিন উপমন্ত্রীর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে করা অবমাননাকর মন্তব্যের জেরে দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের মালদ্বীপ বর্জনের ডাকে মুখ থুবড়ে পড়ছে দেশটির পর্যটন শিল্প। এমন পরিস্থিতিতে চীনের শরণাপন্ন হয়েছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট।
আজ বৃহস্পতিবার এই তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লাক্ষাদ্বীপ সফরকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে।
দক্ষিণ ভারতের কেরালার উপকূলের কাছাকাছি এই দ্বীপে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজের কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করেন। সেখানে তাকে সমুদ্রতটের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে ও সাগরে ডুব দিতে দেখা যায়।
মোদি তার পোস্টে মালদ্বীপের কথা উল্লেখ না করলেও অনেকেই ধরে নেন, তিনি ভারতের নাগরিকদের মালদ্বীপে না গিয়ে লাক্ষাদ্বীপে ছুটি কাটাতে যেতে উদ্বুদ্ধ করছেন।
আর এতে মালদ্বীপের তিন উপমন্ত্রী মোদির পোস্টে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে মোদিকে 'ভাঁড়', 'জঙ্গি' ও 'ইসরায়েলের খেলার পুতুল' হিসেবে অভিহিত করেন।
যুব উন্নয়ন, তথ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের এই তিন উপমন্ত্রীর এসব 'অসম্মানজনক' মন্তব্য থেকে মালদ্বীপ সরকার দ্রুত নিজেকে আলাদা করে নেয়। সরকারের পক্ষে বলা হয়, এটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের নিজস্ব অভিমত। মালদ্বীপ সরকারের সঙ্গে এর যোগসূত্র নেই। তিন উপমন্ত্রীকে সরকার সাময়িক বরখাস্তও করে। তাদের পোস্টগুলো ইতোমধ্যে মুছে দেওয়া হয়েছে।
তা সত্ত্বেও এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান ভারতীয়রা। অনেকেই মন্ত্রীদের এসব মন্তব্যের স্ক্রিনশট নিয়ে মালদ্বীপকে বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন। 'বয়কট মালদিভস' হ্যাশট্যাগ এক্স মাধ্যমে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সেই সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয়দের 'চালো লাক্ষাদ্বীপ' (চল লাক্ষাদ্বীপে যাই) হ্যাশট্যাগটিও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
বলিউডের তারকা থেকে শুরু করে ক্রিকেট খেলোয়াড় পর্যন্ত অনেকেই ছুটি কাটানোর জন্য মালদ্বীপের পরিবর্তে ভারতের নিজস্ব গন্তব্যগুলোয় যাওয়ার আহ্বান জানান পোন্টে।
এ ঘটনায় বলিউড তারকা অক্ষয় কুমার বলেন, 'মালদ্বীপের কর্মকর্তাদের মন্তব্যগুলো বর্ণবাদী ও ঘৃণা প্রকাশকারী।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছি। তাহলে কেন আমরা বিনা উসকানিতে এ ধরনের অযাচিত ঘৃণার শিকার হব? আমি নিজে অনেকবার মালদ্বীপ গিয়েছি এবং জায়গাটির প্রশংসা করেছি, কিন্তু আগে নিজেদের সম্মান রক্ষা করতে হবে। আসুন আমরা ভারতের দ্বীপগুলোতে যাই এবং আমাদের নিজেদের পর্যটন শিল্পকে সমর্থন জানাই।'
গত সোমবার ভারতের পর্যটন ওয়েবসাইট ইজিমাইট্রিপ জানিয়েছে, তারা মালদ্বীপের ফ্লাইটের বুকিং নিচ্ছে না।
ভারতের বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন 'দ্য কনফেডারেশন অব অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স' মালদ্বীপের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছে।
এক কূটনীতিক সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন আরও জানায়, মালদ্বীপে ভারতের হাইকমিশন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে এ ঘটনার 'কড়া ভাষায়' উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সংগঠনটির মহাসচিব প্রবীণ খান্ডেলওয়াল বলেন, 'মালদ্বীপ ক্ষমা না চাওয়া বা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত ভারতের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় তাদের সঙ্গে ব্যবসা করা থেকে বিরত থাকবে।'
এদিকে প্রথাগতভাবে মালদ্বীপের নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্টরা প্রথম বৈদেশিক সফরের গন্তব্য হিসেবে ভারতকে বেছে নিলেও 'ভারতবিরোধী' মুইজ্জু এই প্রথা ভেঙে সফর করেছেন চীনে।
গত বছরের নভেম্বরে পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেস দলের নেতা হিসেবে মুইজ্জু মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার প্রতিপক্ষ ছিলেন মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টির ভারতপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত ইব্রাহিম মোহম্মদ সোলি।
সোলি সরকার ভারতের ওপর অনেক নির্ভরশীল ছিল। অপরদিকে, মুইজ্জুর প্রধান নির্বাচনী স্লোগান ছিল 'আউট ইন্ডিয়া' বা দেশকে ভারতের প্রভাবমুক্ত করা। ফলে, নির্বাচনে জেতার পর তিনি সে দেশে অবস্থানরত ৭৫ ভারতীয় সেনাকে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেন।
আজ বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মুইজ্জু তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে বেইজিং এসে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সমর্থ হয়েছেন।
গ্রেট হল অব পিপল সম্মেলন কেন্দ্রে বক্তব্য দেওয়ার সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মুইজ্জুকে 'পুরোনো বন্ধু' বলে সম্বোধন করেন। মালদ্বীপের সঙ্গে 'কৌশলগত অংশীদারিত্বের' মাধ্যমে চীন সেখানে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে যাচ্ছে।
'চীন ও মালদ্বীপের সম্পর্ককে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে,' বলেও মন্তব্য করেন শি।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, মালদ্বীপের সরকারি দেনার ২০ শতাংশই চীনের কাছে। এর পরিমাণ ১৩৭ কোটি ডলার। শীর্ষ ঋণদাতার তালিকার পরের দুই দেশ ভারত ও সৌদি আরব।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত থেকে পর্যটক যাওয়ার হার দ্রুত কমে যাওয়ায় চীনের শরণাপন্ন হয়েছেন মুইজ্জু।
প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে মালদ্বীপে আরও পর্যটক পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত মঙ্গলবার বলেন, 'করোনা মহামারি আঘাত হানার আগে মালদ্বীপে চীনের পর্যটক সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আসতেন। আমি চাই, চীন তাদের সে অবস্থান ফিরে পাক। আরও বেশি চীনা পর্যটক মালদ্বীপে আসুক।'
মুইজ্জুর পরবর্তী উদ্যোগ
মালদ্বীপের অর্থনীতি অনেকটাই পর্যটননির্ভর। দেশটির মোট প্রবৃদ্ধির ২৮ শতাংশ আসে পর্যটন থেকে। বৈদেশিক মুদ্রার ৬০ শতাংশ আসে এর বদৌলতে।
মালদ্বীপের জনসংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ। প্রতি বছর এখানে এর চেয়ে বেশি সংখ্যক পর্যটক আসেন। তাদের বড় অংশ ভারতীয়।
মালদ্বীপে ভারতের দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী—২০২২ সালে ভারত থেকে পর্যটক গিয়েছেন দুই লাখ ৪১ হাজার এবং ২০২৩ সালে দুই লাখ।
সম্প্রতি বলিউড ও ক্রিকেট জগতের তারকা, ধনী ও উচ্চবিত্তদের ছুটি কাটানোর পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে মালদ্বীপ।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন হলেও বা সে দেশ থেকে আরও পর্যটক এলেও, ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক না রেখে উপায় নেই মুইজ্জুর।
মালদ্বীপের রাজনৈতিক মহলে মোদিকে নিয়ে মন্ত্রীদের 'অবমাননাকর' মন্তব্যের সমালোচনা হচ্ছে। সে দেশের রাজনীতিকদের বড় অংশ মনে করছেন, সরকারের উচিত ভারতের কাছে ক্ষমা চাওয়া ও দুঃখ প্রকাশ করা।