যেমন ছিল রানি এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠানের দিনটি
ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ মারা গেছেন। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি এই রানি ৯৬ বছর বয়সে মারা গেলেন। লন্ডনের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার পর রানির মৃত্যুর ঘোষণা দেয় বাকিংহাম প্যালেস।
সম্প্রতি তার সিংহাসনে বসার ৭০ বছর পূর্তি উদযাপন করে ব্রিটেন। ব্রিটেনের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র রানি যিনি সবচেয়ে বেশি সময় (৭০ বছর) সিংহাসন অলংকৃত করে রেখেছিলেন।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। সেদিন উৎসবে মেতে উঠেছিল গোটা বৃটেন।
১৯৫৩ সালের ২ জুন। সেদিন সবার দৃষ্টি লন্ডনের দিকে। খুশিতে, আনন্দে, উত্তেজনায় মাতোয়ারা এ শহরের মানুষ। শুধু লন্ডন নয়, পুরো কমনওয়েলথ জুড়েই সবার দৃষ্টি এই অনুষ্ঠানের দিকে।
সোনায় মোড়ানো শকটে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অভিষেক অনুষ্ঠানে
জুনের সেই সকালে আবহাওয়া কিছুটা ঠাণ্ডা, তবে সকালে যে বৃষ্টি ছিল তা থেমে গেছে, এবং আকাশে সূর্য দেখা যেতে পারে এমন আশাও দেখা যাচ্ছিল।
অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য রানি বের হবেন তার লন্ডনের ঠিকানা বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে। সেখান থেকে তিনি যাবেন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে, যেখানে মুকুট পরানোর মাধ্যমে তার অভিষেক সম্পন্ন হবে।
সেদিন শহরজুড়ে সব ভবন ঢাকা পড়ে গেছে অভিষেক উৎসবের সাজে, কেবল বাকিংহাম প্রাসাদের পূর্বদিকের সম্মুখভাগটাই যেন বাদ পড়েছিল।
রানি যখন বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে যান, তখন সহচরী হিসেবে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য বাছাই করা হয়েছিল ছয় তরুণীকে।
বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে রানির শোভাযাত্রা চলেছে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবির দিকে
রানি এলিজাবেথের বয়স তখন ২৬। তিনি আবদার করেছিলেন যে, তার অভিষেক অনুষ্ঠানটি যেন সরাসরি টেলিভিশনে দেখানো হয়। রাজপরিবারের এই অনুষ্ঠানটির কিছু কিছু ঐতিহ্য বহু শতকের, ৯০০ বছর আগে থেকে চলছে। কিন্তু এবার এই অনুষ্ঠানটি যত মানুষ দেখার সুযোগ পাবেন, তেমনটি এর আগে কখনো ঘটেনি।
বাকিংহাম প্রাসাদের সামনে থেকে সেদিনের উৎসবমুখর লন্ডনের পরিবেশ বর্ণনা করছিলেন টেলিভিশন ধারাভাষ্যকার। শুধু প্রাসাদের সামনে নয়, যে পথ ধরে রানি যাবেন, তার দুপাশেই ছিল উৎসাহী মানুষের ভিড়। সেই পথের নানা জায়গায় মোতায়েন ছিলেন আরও কয়েকজন ধারাভাষ্যকার। সাত ঘণ্টা ধরে সেদিনের অনুষ্ঠান সরাসরি দেখানো হয়েছিল টেলিভিশনে।
রানির শোভাযাত্রা দেখতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তার দুপাশে লাইনে দাঁড়িয়ে। অনেকে রাতে বৃষ্টির মধ্যে সেখানেই ঘুমিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র আট বছর আগে, যুদ্ধের পর ধুসর লন্ডন নগরী সেই প্রথম যেন কোন উৎসবের জন্য নানা রঙে সেজে উঠেছে।
সোনায় মোড়ানো যে শকটে করে রানি যাবেন, সেটির অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে আছে মানুষ। অ্যাডমিরালটি আর্চের নীচ দিয়ে যখন রানির শকট এগিয়ে এল, হর্ষ-ধ্বনি দিয়ে তাকে স্বাগত জানাল মানুষ।
অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা অনেকে আগের রাত থেকে রাস্তায় অপেক্ষা করেন
রানিকে বহনকারী রাজকীয় শকট এসে পৌঁছাল ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবিতে।
আড়াইশো জনের বিশাল এক শোভাযাত্রা শুরু হলো ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবির দিকে। ভেতরে তখন সারা বিশ্ব থেকে আসা ৮ হাজার অতিথি। রানি শপথ নেওয়ার পর এলো অভিষেক অনুষ্ঠানের সেই মুহূর্তটি, যেটি টেলিভিশন ক্যামেরায় দেখানো নিষেধ। রানিকে এখন পবিত্র তেল মাখিয়ে অভিষিক্ত করা হবে।
রানির পরনের যে পোশাক সেটি এরপর খুলে ফেলা হয়। খুলে নেওয়া হয় সব অলংকার। তাকে পরানো হয় একেবারেই একটি সাদা রঙের সাদামাটা পোশাক।
এরপর ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবির ডিন পবিত্র তেলের একটি পাত্র নিয়ে আসলেন আর্চবিশপের কাছে। এরপর আর্চবিশপ রানিকে তেল মাখিয়ে অভিষিক্ত করার জন্য চলে গেলেন সামিয়ানার নীচে সবার আড়ালে।
রানিকে নিয়ে রাজকীয় বহর এরপর আবার লন্ডনের রাস্তা ধরে ফিরে চলল। যখন তার গাড়ি আবার বাকিংহাম প্রাসাদে ফিরে এল, সেখান থেকেও সরাসরি টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছিল সেই দৃশ্য। এভাবে নানা বর্ণীল আয়োজনে শেষ হয় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠান।
সূত্র: বিবিসি
আরএ/