একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মকথন
সবাই আমাকে পা কাটা রাসু নামে চেনে। হাটেবাজারে গেলে দূর থেকে শুনতে পাই কেউ কেউ বলে, ওই দেহ ঠ্যাং কাটা রাসু আইতাছে। তাতে আমি রাগ করি না। যারা প্রকৃত ঘটনা জানে তারা আমারে সালাম দেয়। সম্মান করে চা খাওয়ায়। গর্বে বুকে জড়িয়ে ধরে। বারবার পা কাটা ইতিহাস শুনতে চায়। আর যারা জানে না তাঁরা নানান রকম মন্তব্য করে। কেউ কেউ বলে, আগে মনে হয় চুরি ডাকাতি করতো। মানুষ ধইরা পা ভাইঙ্গা দিছে। ভাঙা পাও জোড়া লয় নাই, তাই কাইট্টা ফালাইছে। তাতেও আমি রাগ করি না।
আমার পা কাটার ইতিহাস যারা জানতো তারা অনেকেই বেঁচে নেই। তাছাড়া আমি আমার গ্রামে থাকি না। আমি সর্বশান্ত একজন মানুষ। আমারও বাড়ি ছিল, ছিল হালের বলদ। আর ছিল অল্পকিছু আবাদ করার মত ফসলি জমি। তাতে চাষাবাদে ফসল যা হতো তাতে মা- বাবাকে নিয়ে আমাদের ছোট্ট সংসার ভালোই চলতো। যুদ্ধের মাঝমাঝি বাপজানকে হারালাম। বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান আমিও রাতের আঁধারে নিরুদ্দেশ হলাম।
যুদ্ধ শেষে গ্রামে ফিরে এলাম গুলিবিদ্ধ ক্ষত পা নিয়ে। কিছু পোড়া কাঠ ছাড়া বাড়ি ঘরের কোনো চিহ্ন খুঁজে পেলাম না। কিছু মরচে ধরা ভাঙ্গা টিন মাটিতে মিশে আছে। গর্ভধারিনী মা'কে ও কোথাও খুঁজে পেলাম না। লোকজন মুখে শোনলাম, কোনো এক গভীর রাতে হানাদারের সাথে রাজাকার আর আলবদররা মিলে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। জোয়ানমর্দরা কেউ কেউ পালাতে পারলেও আমার মা পালাতে পারেনি। কারণ আমার মা ছিলেন রাতকানা রোগী। ঘরের দোর খুঁজে বের করতে গিয়ে আগুনে পোড়ে হয়তো ছাই হয়ে গেছেন। আমি শোকে পাথর হয়ে গেলাম।
বাপদাদার ছোট্ট একখন্ড জন্ম ভিটা তাও বেদখল হয়ে গেল। আমি নতুন করে ঘর তুলতে গেলে গ্রামের মোড়ল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধের সময় মা নাকি সুদে টাকা নিয়ে ছিলেন। কত টাকা তার কোনো দলিল নেই। শুধু সাদা কগজে মায়ের নাম লেখা। নামের নিচে কাজলমাখানো একটা টিপ সই। কি আর করা। রাজাকার মোড়লদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পেরে গ্রাম ছেড়ে চলে এলাম জেলা শহরে। ভালো চিকিৎসার অভাবে পায়ের ক্ষতে পচন ধরলো। পা থেকে দুর্গন্ধ বের হতে লাগলো। আমার নিজের নাকে সেই গন্ধ বিচ্ছিরি লাগে। আগে লাঠি ভর করে হাঁটতে পারতাম। এখন তাও পারি না। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশে ভালো ডাক্তারেরও কমতি ছিল। দু'একজন নামী ডাক্তার থাকলেও টাকা কড়ির অভাবে তাদের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এক সরকারি হাসপাতালে মুক্তিযুদ্ধার পরিচয়ে ভর্তি হলাম। কর্মরত ডাক্তাররা পচন ধরা ক্ষত পা কেটে ফেলে আমাকে বাঁচালেন। আমি বেঁচে গেলাম। ক্র্যাচে ভর করে পথ চলি। হাত পাতি মানুষের কাছে। যার দয়া হয় সে সাহায্য করে। যার দয়া হয় না, সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নানান মন্তব্য করে।
হাত পাতা মানে ভিক্ষাবৃত্তি। কজটা লজ্জাজনক। বিবেক বাঁধা দিল। মানুষের কাছে হাতপাতা ছেড়ে দিলাম। যৎসামান্য লেখাপড়া জানি। এক আড়ৎদার আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা জেনে কাজ দিলন। ভারী কোনো কাজ না। সারাদিনে বেচাকেনার হিসাব খাতায় তুলে রাখা। কাজের ফাঁকে মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য দৌঁড়ঝাপ করি।
আজ হবে কাল হবে আশায় থাকি। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু মুজিব খুন হয়। মুজিবও মরলো কপাল ও পুড়লো।
স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে ক্ষমতা চলে গেলো। আমার কপালে আর মুক্তিযোদ্ধার সনদ জুটলো না।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে কত রাজা বদল হলো। ভেবেছিলাম বঙ্গবন্ধুর দল আবার ক্ষমতায় এলে আমার মত সকল পা কাটা রাসুদের সনদ মিলবে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা কেউ প্রনয়ন করবে। মাস গেলে অন্য মুক্তিযোদ্ধার মত আমিও ভাতা পাব। কিন্তু তা আর পেলাম না। ক্ষমতা আর দুর্নীতির বাজারে মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা যে ভাবে গ্যাজেটভোক্ত হয় তা আমি চাই না। আমি দুর্নীতিকে ঘৃণা করি। হাত বদলের খেলায় সঠিক মুক্তিযোদ্ধার তালিকা কোনদিন হবে না। কারণ স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি এখন বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তনে রাষ্টীয় ক্ষমতা ভাগাভাগি করে দেশ শাসন করছে। আর তারা কখনো মাঠপর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেবে না। শুনেছি মুক্তিযোদ্ধার সনদ এখন বেঁচাকেনা হয়। মোটা অংকের টাকা দিতে পারলে সরকারি গ্যাজেটে নাম লিপিবদ্ধ হয়। আমার তো ঠিকমত তিনবেলা ভাতই জুটে না, টাকা পাব কোথায়? আমি যে একজন মুক্তিযোদ্ধা কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই বা করুক, উপরে যে একজন আছেন তিনি তো জানেন। দেশ স্বাধীনের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। তাতে কোন স্বার্থ ছিল না। দেশ স্বাধীন হয়েছে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তী আর কি হতে পারে। আমার একটা পা নষ্ট হয়েছে কিন্তু অন্যদের মত মরে তো যাইনি। বেঁচে থেকে স্বাধীনতার বিজয় দেখেছি। এখনো দেশের ভালোমন্দ দেখছি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে টাকা দিয়ে সনদ কিনতে পারি না। আমরা কিছু মুক্তিযোদ্ধা না হয় পা কাটা রাসু নামেই বেঁচে থাকব যতদিন হায়াত থাকে।
ডিএসএস/