বিষন্নানন্দ
হঠাৎ নিরবতায় আশ্চর্য ওরা। কী হয়েছে পিশাচগুলোর? এদেরও থপ থপ হাঁটাহাঁটি থেমে গেছে। ওরা একই সমতলে। জীবন বিষময় হয়ে গেছে পুরোপুরি।প্রথম দিকে কয়েকজন মৃত্যু বরণ করতে পারলেও পরে আর সম্ভব হয় নি। ওদের গায়ে কোনো কাপড় থাকে না এখন।
ফাঁক ফোকড় দিয়ে আলো ঢোকায় কাজলি বুঝতে পারলো এখন দিন। এই সময় ওদের নাস্তা নিয়ে আসে সশস্ত্র রাজাকার দুটো। ইচ্ছের বিরুদ্ধে ক্রমাগত যৌন নির্যাতন চলতে থাকায় খাদ্য না খেয়ে থাকা যেতো না। প্রথমদিকে কয়েকজন খেতে না চাইলে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে।
কাজলি এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজা বাইরের দিকে তালাবদ্ধ। ধাক্কা দেয়ায় দুই কপাটের মাঝখানে খানিকটা ফাঁক হলো। সেই ফাঁক দিয়ে বাহির দেখার চেষ্টা করছে। কেউ কোথাও নেই! রাজাকার বা পাকিস্তানি হানাদারগুলোর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। হায়েনাগুলোর বুটের আওয়াজ যত কাছে আসতো, ততো ওদের বুকের কাঁপুনি যেতো বেড়ে।
আরো ভালো করে সামনের আশপাশটা দেখে ফিরে দেখে সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তের জন।
একজন বললো, কী দেখলা? আইতাছে? অহন কার পালা হইবো?
আরেকজন বিষন্ন কণ্ঠে বললো, আমি আর পারছি না রে!
আরেকজন দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে দিয়ে বললো, আমাকে নিতে মানা কইরো তোমরা। আমার মাসিক হইছে।
কাজলি কিছু না বলায় একজন এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজায় ফাঁক দিয়ে বাইরে কিছু লোককে ছুটাছুটি করতে দেখে আঁতকে উঠে সরে এলো।
নিশ্চয়ই পাক হানাদার আক্রমণ করেছে গ্রামে। আবার কতগুলো অবলা নারীকে এখানে ঢুকানো হবে ইচ্ছেমতো যৌন-অত্যাচার করার জন্য।
কাজলি ওকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি ভয় পেয়ে সরে এলে কেনো সাফিয়া? কী দেখেছো?
সাফিয়া বললো, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ফের গ্রাম আক্রমণ করেছে। গ্রামের লোকজন ছুটাছুটি করছে।
কাজলি পড়ে গেলো দ্বিধায়। ক্যাম্পের হানাদারগুলোই কী গ্রাম আক্রমণে গেছে? রাজাকারগুলোও সাথে করে নিয়ে গেছে? এভাবে ক্যাম্পকে অরক্ষিত রেখে? ব্যাপারটা দেখতে হবে ভালো করে।
কাজলি এগিয়ে গেলো ফের দরজার দিকে। বাইরে তাকিয়ে বাস্তবিকই গ্রামের লোকদের ছুটাছুটি করতে দেখছে। তবে ওরা ভয়ার্ত না-চোখে-মুখে আনন্দ। ব্যাপার কী?
কাজলি সাফিয়াকে বললো, লোকগুলোর চোখেমুখে আনন্দ খেলা করছে। পাক বাহিনী আক্রমণ করলে এমনটা হতো না। আমার মনে হয় পাক হানাদার পালিয়ে গেছে এই ক্যাম্প ছেড়ে। আশেপাশে নিশ্চয়ই মুক্তি বাহিনী আছে।
সাফিয়া একটু উল্লসিত স্বরে বললো, তাহলে আমরা ওদের ডাকি! তালা ভেঙ্গে আমাদের এই বদ্ধ ও অভিশপ্ত ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাক!
আরেকজন দুই কদম এগিয়ে এসে বললো, আমাদের গায়ে কোন কাপড় নাই।
সাফিয়া চমকে বললো, তাই তো!
এতক্ষণ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ওদের কথাবার্তা শুনছিলো সবাই। একজন এগিয়ে এসে বললো, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কী আছে! ওরা এলে বলবো আমাদের আগে পরনের কাপড় দেও। তারপর দরজার তালা খোলো।
সাফিয়া বললো, এই সহজ কথাটা আমাদের কারো মাথায় আসছিলো না কেনো রোকেয়া আপা?
রোকেয়া কিছু না বলে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। বাইরে লোকজনের ছুটাছুটি আছে; কিন্তু কেউ এদিকে তাকাচ্ছে না! রোকেয়া চিৎকার দিয়ে ডাক দিলো ওদের, এই যে ভায়েরা! এদিকে আসেন! আমরা এখানে বন্দি হয়ে আছি!
কেউ ওর চিৎকার শুনেছে বলে মনে হলো না। রোকেয়া কয়েকবার চিৎকার দিয়ে ব্যর্থ হয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, আমার একার চিৎকারে কাজ হচ্ছে না। সবাইকে একসাথে চিৎকার করতে হবে এবং সাথে সাথে দরজায় ধাক্কা দিতে হবে।
তের জন এগিয়ে এলো দরজার কাছে। দরজা ধরে নাড়ানোর সাথে সাথে চিৎকার করতে থাকলো উল্লসিত লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য।এভাবে অনবরত চিৎকার করতে থাকায় একটি বালক এগিয়ে এলো এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে।
বালকটি কাছাকাছি এলে রোকেয়া বললো, তোমরা দৌড়াদৌড়ি করছো কেনো? কী হয়েছে?
বালকটি বললো, হুনতাছি দ্যাশ স্বাধীন হয়া গেছে। খুব আনন্দ!
কথাটা শুনে বিড়ম্বিতা নারীগুলোর মুখের বিষন্নতা ছাপিয়ে স্বস্তি ও ভরসার হাসি ফুটে উঠলো-বিষন্নানন্দ। ওরা একে অপরকে কোলাকোলি করতে লাগলো।
রোকেয়া ফের জিজ্ঞেস করলো, এই ক্যাম্পের হায়েনা পাক বাহিনী আর কুত্তা রাজাকারগুলা কই গেলো জানো কিছু?
ছেলেটা বললো, সকালে পালানোর সময় মুক্তিরা ওদের ধইরা ফালাইছে। অহন এদিকে লইয়া আইতাছে।
রোকেয়া স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, তাহলে আর চিন্তার কিছু নাই। তুমি এক দৌড় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বলো আমরা এখানে আটকা পড়ে আছি।
জ্বী আইচ্ছা।
ছেলেটা দৌড়াতে লাগলো। এরা খুশিতে ও মুক্তির আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো।
জয়বাংলা জয়বাংলা শ্লোগান শুনতে পেয়ে সবাই তাকালো দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে।
ওরা আসছে স্কুলের দিকে। সামনে সারিবদ্ধভাবে মাথার উপর দুই হাত তোলা অবস্থায় রাজাকারের পরে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। ওদের পেছনে স্ট্যানগান ও রাইফেল উচিয়ে বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধাগণ। পরনে হাটু অব্দি গুটানো পেন্ট, কারো গায়ে গেঞ্জি, কারো গায়ে শার্ট-দুটোই ময়লা; ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল ও এলোমেলো মুখভর্তি দাড়ি।
মুক্তিযোদ্ধাগণ সামনে এসে শূয়রগুলোর দিকে অস্ত্র তাক করতেই দাঁড়িয়ে গেলো মাঠের মাঝ বরাবর। মোট পনেরো জন মুক্তিযোদ্ধা। চারজন সরাসরি আসছে ঘরটার দিকে। ঘরটার চারিদিকে একবার দেখে দরজার সামনে দাঁড়ালো চার মুক্তিযোদ্ধা।
একজন রাইফেলের বাট দিয়ে তালা ভাংতে চাইলে ভেতর থেকে রোকেয়া বললো, তালা ভাংবে না মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা!
মুক্তিযোদ্ধাটি রাইফেল নামিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, কেনো? আপনারা বের হতে চাচ্ছেন না?
আমাদের গায়ে কোনো কাপড় নেই। এ অবস্থায় বের হওয়া কি ঠিক হবে?
মুক্তিযোদ্ধাটি লজ্জা পেয়ে বললো, সরি! আমি এখনই হানাদারদের ক্যাম্প থেকে কিছু কাপড় নিয়ে আসছি। আপনারা কত জন?
কাজলি দ্রুত বললো, না না! এই হায়েনাদের কাপড় আমরা পরবো না! আপনারা পাশের গ্রাম থেকে শাড়ি ছায়া ব্লাউজ লুঙ্গি যা পারেন নিয়ে আসেন। আমরা তের জন।
চার জনই ছুটে চলে গেলো। ওদের মাঝে আজ বিজয়ের শক্তি ও অপার আনন্দ। গ্রামে ঢুকে কয়েকটা বাড়ি থেকে শাড়ি ছায়া ব্লাউজ লুঙ্গি যে যা দিয়েছে তাই নিয়ে ওরা চলে এলো ক্যাম্পে। দরজার ফাঁক দিয়ে একটা একটা করে কাপড় ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা বললো, এবার আপনারা এগুলো পরে ফেলুন।
কাপড় পরা শেষ হলে আমাদের বললে তালা ভেঙ্গে ফেলবো।
রোকেয়া শান্ত কণ্ঠে বললো, একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে যে মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা।
অপর একজন মুক্তিযোদ্ধা বললো, কী সমস্যা বুবু?
রোকেয়া বললো, মাঠের মাঝে মাথার উপর হাত তোলে দাঁড়িয়ে থাকা হায়েনাগুলো মাসের পর মাস আমাদের উপর যৌন নির্যাতন করেছে। ওদের সামনে আমরা যেতে চাই না।
কী করতে বলেন আমাদের বুবু? আপনাদের কথা আমরা রাখতে চেষ্টা করবো।
এবার রোকেয়া ঘৃণামিশ্রিত স্বরে বললো, ঐ কুত্তাগুলোকে আপনারা মেরে ফেলুন! যদি না মারেন তাহলে এই কাপড় গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করবো! এমনিতেই এ অবস্থায় আমাদের সমাজে ঠাঁই হবে কিনা জানি না!
মুক্তিযোদ্ধাটি বললো, এ বিষয়ে আমাদের কোম্পানি কমান্ডারের সাথে কথা বলতে হবে।
তাই করুন মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা। একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের এখান থেকে জোর করে বের করতে পারবেন না! আমরা ভেতর থেকে দরজার খিল আটকে দিচ্ছি। আমাদের দাবি পূরণ না হলে আমরা সবাই একসাথে ঘরের ধন্নার সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করতে থাকবো!
এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে ভাবেনি এই চার মুক্তিযোদ্ধা। ওরা অস্ত্র উঁচিয়ে দৌড়ে চলে গেলো মাঠের মাঝখানে কোম্পানি কমান্ডারের কাছে। কোম্পানি কমান্ডারকে কথাগুলো বললে মূহুর্ত মাত্র না ভেবে সিদ্ধান্তঃ নিয়ে ফেললেন কোম্পানি কমান্ডার।
ডিএসএস/