গর্ভাবস্থায় যে খাবার এড়িয়ে চলতে হবে
ছবি : সংগৃহীত
নারীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো গর্ভকালীন অবস্থা। এ সময় অনেক শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয় হবু মায়ের।
ভালো খাদ্য মা ও শিশুকে পুষ্ট করে। তবে সম্ভাব্য ক্ষতিকারক খাদ্য গুরুতর ঝুঁকিরও সৃষ্টি করতে পারে। আপনার গর্ভাবস্থার শুরুতেই কী খাবেন আর কী খাবেন না তা নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভাবস্থায় কী খাওয়া উচিত নয়, জেনে নিন-
১) কাঁচা বা আধা সিদ্ধ সি-ফুড ও মাছ
গর্ভবতী অবস্থায় কাঁচা বা আধা সিদ্ধ সি-ফুড ও মাছ খাওয়া যাবে না। ম্যাকেরেল, হাঙ্গর, তলোয়ার মাছ এবং টাইলফিশের মতো কিছু মাছে পারদ উচ্চ মাত্রায় থাকে। গর্ভাবস্থায় পারদ গ্রহণ করলে আপনার সন্তানের বিকাশ বিলম্বিত হতে পারে ও মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে। এর পরিবর্তে চাঙ্ক লাইট টুনার মতো মাছ খান। এতে পারদ নিম্ন মাত্রায় থাকে।
মাছে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া থাকে। তাই মাছ ভালোভাবে সিদ্ধ বা রান্না করে খেতে হবে। অন্তত ১৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মাছ রান্না করার চেষ্টা করুন।
২) কাঁচা বা আধা সিদ্ধ ডিম
অনেকেই অল্প সিদ্ধ বা কম রান্না করা ডিম খেতে ভালোবাসেন। তবে গর্ভাবস্থায় সেগুলোকে একদম এড়িয়ে যেতে হবে। কারণ সেগুলো সালমেনেলা দ্বারা দূষিত হতে পারে। এটি একটি জীবাণু, যা ডায়রিয়া ও বমিভাব সৃষ্টি করে। কাস্টার্ড এবং মুশেসহ কাঁচা ডিম থেকে তৈরি অন্যান্য খাবার এবং ডেজার্টগুলো এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
গর্ভাবস্থার সময় ডিম খাওয়ার সবচেয়ে ভাল উপায় হলুদ অংশটি শক্ত না হওয়া পর্যন্ত রান্না করা। অন্যথায় ডিমহীন সালাদ, মেয়োনিজ ও অন্যান্য খাবার যেগুলোর ডিমহীন বিকল্প আছে সেগুলো খান।
৩) কাঁচা বা বিরল মাংস
একজন আমিষভোজী মায়ের ডায়েটে মাংস অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি কিছু যত্ন এবং বিধিনিষেধ মেনে করা উচিত। গবেষণায় দেখা যায় যে, কাঁচা মাংসে লিস্টেরিয়া ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। যা গর্ভাবস্থায় এড়ানো উচিত। এটি সন্তানসম্ভবা নারীর বমিভাব, ভ্রূণের ক্ষতি এবং গর্ভপাত ঘটাতে পারে।
যখনই মাংস খাবেন তা ঠিকভাবে রান্না করার বিষয়টি নিশ্চিত করুন। সব ব্যাকটেরিয়ার অপসারণ হওয়া নিশ্চিত করার জন্য লবণ এবং জল দিয়ে সঠিকভাবে মাংস ধুয়ে নিন।
৪) অপাস্তুরিত দুগ্ধজাত পণ্য
আপনার সন্তানের যথাযথ বিকাশের জন্য আপনার দৈনিক দুধ খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা আপনাকে এবং আপনার শিশুকে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি যেমন খনিজ, ক্যালসিয়াম ও প্রোটিন সরবরাহ করে। তবে আপনাকে পাস্তুরিত দুধ খাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। না অপাস্তুরিত দুধে প্যাথোজেন থাকতে পারে, যা গুরুতর খাদ্য বিষাক্ততার কারণ হতে পারে। পরামর্শ দেওয়া হয় যে অপাস্তুরিত সব ধরনের দুগ্ধজাত দ্রব্যগু এড়াতে হবে। আপনি সর্বদা তাজা ফোটানো দুধ খাওয়া নিশ্চিত করুন।
৫) অ্যালার্জি সৃষ্টি করা কাঁচা অঙ্কুর ও বাদাম
কাঁচা অঙ্কুর প্রোটিন এবং খনিজের একটি অন্যতম উৎস। তবে গর্ভাবস্থায় না খাওয়ার তালিকায় এখনও রয়েছে এ খাদ্য। কারণ এর মধ্যে ক্ষতিকারক ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা খাদ্য বিষাক্ততার কারণ হতে পারে। তাই অঙ্কুর খাওয়ার সময় সেগুলো হালকা করে ভেজে নিন। যদি রান্না করে নিতে পারেন তাহলে আরও ভালো হয়।
গর্ভাবস্থায় আপনি বিভিন্ন ধরনের বাদাম উপভোগ করতে পারেন। যেমন- চিনাবাদাম ও কাঠবাদাম। বাদাম ভিটামিন এবং খনিজের একটি সমৃদ্ধ উৎস, যা ভ্রুণের বিকাশের জন্য উপকারী। কিন্তু আপনার শরীরে অ্যালার্জি এবং ফুসকুড়ি তৈরি করতে পারে এমন কিছু বাদাম আছে। এমনকি এগুলোতে প্রাথমিকভাবে অ্যালার্জি না থাকলেও বেশি খেলে সময়ের সঙ্গে অ্যালার্জিগুলো বিকাশ করতে পারে। আপনার ডায়েটের মধ্যে কোন বাদাম অন্তর্ভুক্ত করা উচিত এবং গর্ভাবস্থায় সম্পূর্ণরূপে কোন বাদাম এড়িয়ে চলতে হবে তা নিয়ে আপনার ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
৬) অত্যধিক ক্যাফিন
অনেকেই কফি খেতে খুব পছন্দ করেন। কিন্তু গর্ভাবস্থায় আপনার ডায়েটে ক্যাফিন থাকা ভালো নয়। এটি একটি মূত্রবর্ধক, যার থেকে অত্যধিক প্রস্রাব হতে পারে। এতে আপনি দ্রুত ডিহাইড্রেটেড হবেন। ক্যাফিন অত্যধিক নিলে ভ্রূণের মৃত্যু, প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যু এবং গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
নিশ্চিত করুন যে আপনি দিনে ২০০ মিলি বা ২ কাপের বেশি কফি পান করবেন না।
৭) ভেষজ সম্পূরক ও ভেষজ চা
অনেকেই পরামর্শ দিতে পারেন যে, আপনি গর্ভবতী হওয়ার সময় ভেষজ টনিক এবং চা গ্রহণ করা শুরু করুন। তবে এটি ভালো করার চেয়ে আপনার আরও ক্ষতি করতে পারে। বেশি পরিমাণে নেওয়া হলে কিছু ভেষজ অকাল প্রসবের শ্রম বা গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ওয়ার্মউড, শ পালমেটো এবং সেন্নার মতো ভেষজ এড়িয়ে যান। কারণ তারা অন্যান্য ওষুধের মতো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষিত না, এবং গর্ভাবস্থায় এগুলো খেতে পরামর্শ দেওয়া উচিত কি না, সে বিষয়ে মতামত এখনও বিভক্ত। আপনার যদি শক্তির অভাব বা ক্লান্তি অনুভব হয়, তবে আপনার ডাক্তারকে মাল্টিভিটামিন প্রেস্ক্রাইব করতে বলুন এবং ভেষজ মিশ্রণগুলো নিয়ে পরীক্ষা করার পরিবর্তে আপনার নিয়মিত চা খাওয়া চালিয়ে যান।
৮) অত্যধিক চিনি সমৃদ্ধ খাদ্য
আপনি আপনার গর্ভাবস্থায় আইসক্রিম এবং চকোলেট অনেকবার খেতে চাইবেন। তবে এগুলোতে থাকা উচ্চ চিনির মাত্রা আপনার রক্তে চিনির মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারে। যা ভ্রূণকে ক্ষতি করতে পারে। প্রতিদিন কত পরিমাণে চিনি খাচ্ছেন তা পরীক্ষা করুন এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিনি এড়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করুন।
৯) অত্যধিক ফ্যাটযুক্ত খাবার
যেহেতু এ সময় আপনার ওজন বাড়ার কথা, তাই অত্যধিক ফ্যাটযুক্ত খাদ্য আপনার রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারে। যা স্থূলতা ও হৃদরোগে ঝুঁকি বাড়াবে। তাই প্রলোভন প্রতিরোধ করুন। সংযমী মাত্রায় ফ্যাটযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করুন।
ওমেগা-৩, ৬, ও ৯ ফ্যাটি অ্যাসিড ধারণকারী খাদ্য গ্রহণ করুন। কারণ এটি আপনার শিশুর বিকাশের জন্য উপকারী। এ রকম কিছু খাবারের মধ্যে রয়েছে- অ্যাভোকাডো, বাদাম, জলপাই এবং কুমড়োর বীজ। যাই হোক, এই খাবারগুলি অনিয়ন্ত্রিত পরিমাণে খাবেন না এবং সবসময় সংযমের সঙ্গে খান।
১০) প্রেস্ক্রাইব না করা ভিটামিন
ভিটামিন অবশ্যই গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পুষ্টির একটি ভালো উৎস। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে তা ক্ষতিকারক হতে পারে। ভ্রূণের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে এবং এটি অকাল শ্রমের কারণ হতে পারে। ভিটামিন নেওয়ার ব্যাপারে আপনার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবেন না। সর্বদা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খান।
১১) যষ্টিমধু
অনেক রান্নাতে যষ্টিমধু ব্যবহার করা হয়, যা সাধারণত একটি ক্ষতিহীন মশলা। কিন্তু গর্ভাবস্থায় যষ্টিমধু জরায়ুর সংকোচনের কারণ হতে থাকে। এর থেকে অকাল প্রসব যন্ত্রণা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় এটি যেকোনো ভাবে এড়িয়ে যান।
১২) অ্যালকোহল
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অ্যালকোহল গ্রহণ করা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। কেবল গর্ভবতী হলে নয়, জীবনের যে কোনো সময় ক্ষতিকর। কিন্তু যদি আপনি মনে করেন যে গর্ভবতী থাকাকালীন মাঝে মাঝে মদ্যপান করা ঠিক আছে, তাহলে আপনি ভীষণ ভুল ভাবছেন।
অ্যালকোহল প্ল্যাসেন্টা দ্বারা ফিল্টার হয় না এবং আপনার শিশুর কাছে আম্বিলিক্যাল কর্ডের মাধ্যমে পৌঁছাতে পারে। এটি শুধু গর্ভপাত এবং প্রসবের সময় শিশুমৃত্যুই ঘটাতে পারে না, সঙ্গে ফেটাম অ্যালকোহল স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এফএএসডি) নামে একটি অবস্থা সৃষ্টি করার মাধ্যমে জীবনভর শারীরিক ও বৌদ্ধিক অক্ষমতাও তৈরি করতে পারে। আপনার গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল ব্যবহারের কোনো নিরাপদ সময় বা নিরাপদ পরিমাণ নেই।
গর্ভাবস্থার জন্য সর্বোত্তম ডায়েট সম্পর্কে একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিলে আপনার একটি সুষম খাবার গ্রহণ করতে সহায়তা হবে। নিরাপদ ডায়েটারি পছন্দগুলোতে সীমিত থাকুন।
টিটি/