‘চোখ গেল’ ‘চোখ গেল’ কেন ডাকিস রে...
চোখ গেল। ছবি: ঢাকাপ্রকাশ
সম্প্রতি নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলায় যাওয়ার জন্য রওনা হই। মোটরসাইকেল যোগে যখন মহাদেবপুর উপজেলার ছাতড়া বিলে পৌঁছাই তখন ঘড়িতে সকাল সাড়ে ৮ টা বাজে। চারিদিকে কুয়াশাচ্ছন্ন তীব্র শীত। এমন সময় বিলের মধ্য দিয়ে সংযোগ সড়কের ব্রিজের পিলারের উপর বসে থাকা একটি পাখি নজরে আসে। দ্রুত মোটরসাইকেলটি রাস্তার পাশে দাঁড় করালাম।
তখন বিলের মাঝে সংযোগ সড়কটি জনমানব শূন্য। দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে না কুয়াশায়। সেদিন তাপমাত্রা পারদ ছিলো ১০ এর নিচে। ধীরে ধীরে পাখিটির কাছে গেলাম, আমাদের দেখে একটুকু ভয় পেল না। তীব্র শীতে পাখিটি উড়তে পারছে না।
সচরাচর এই পাখিটি মাটিতে নামেনা। আবার শীতকালে দেখাও যায় না। বলতে গেলে আমাদের সৌভাগ্য তারপর বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম খু্ব কাছ থেকে তবুও উড়ে গেল না। উড়ে যখন যাচ্ছে না তখন তাকে আর বিরক্ত না করি; এই ভেবে রওনা দিলাম গন্তব্যস্থলে।
পাখিটির বাংলা নাম: ‘চোখ গেল’
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
‘চোখ গেল’ ‘চোখ গেল’ কেন ডাকিস রে–
‘চোখ গেল’ পাখি রে!
তোরও চোখে কাহার চোখ পড়েছে নাকি রে–
‘চোখ গেল’ পাখি রে!
তোর চোখের বালির জ্বালা জানে সবাই রে–
জানে সবাই
চোখে যার চোখ পড়ে তার ওষুধ নাই রে–
তার ওষুধ নাই ;
কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয় কাহার আঁখি রে–
‘চোখ গেল’ পাখি রে॥
তোর চোখের জ্বালা বুঝি নিশিরাতে বুকে লাগে
‘চোখ গেল’ ভুলে রে ‘পিউ কাঁহা’ ‘পিউ কাঁহা’ বলে
তাই ডাকিস অনুরাগে রে।
ওরে বন-পাপিয়া, কাহার গোপন প্রিয়া ছিলি–
আর-জনমে
আজও ভুলতে নারিস আজও ঝুরে হিয়া
ওরে পাপিয়া বল, যে হারায় তাহারে কি
পাওয়া যায় ডাকি রে–
‘চোখ গেল’ পাখি রে।
‘চোখ গেল’ পাখি॥
‘চোখ গেল’, ইংরেজি নাম: “কমন হাক কুক্কু”, (Common Hawk Cuckoo), বৈজ্ঞানিক নাম: “হাইরোকক্সিস ভেরিয়াস”, (Hierococcyx varius), গোত্রের নাম: কুকুলিদি। এরা লম্বায় ৩৩-৩৪ সেন্টিমিটার। ঠোঁট তীক্ষ। ঠোঁটের ডগা কালো বাদবাকি হলদেটে সবুজ। মাথা থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত ধূসর। তবে লেজের ওপর কিছু কালো বলয় রয়েছে। গলার নিচ থেকে বুক পর্যন্ত লালচে বাদামি। বুকের দু’পাশে সরু বাদামি দাগ। চোখের তারা, বলয় হলুদ। পা, আঙুল হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম।
দেশী কালো কোকিলের মত মিষ্টি ডাক কিন্তু অতটা জোড়ালো না। মোটামুটি ১ মিটার দূরে গেলেই মিলিয়ে যায় বাতাসে এমন ক্ষীন স্বরে ডাকে। শীতকালে এরা সাধারনত চোখে পড়ে না। কিন্তু বসন্ত এলেই গাছের উঁচু ডালে ডালে এদের বসে থাকতে দেখা যায়। সাধারণত ঘন সবুজ বনে এদের দেখা যায় আর বাসা বাধে গাছের উঁচু অংশেএ কোটরে বা দুটি ডালের মাঝের খাঁজে। পারতপক্ষে এরা মাটিতে নামে না।
গাছে গাছে কিংবা শূন্যে ওড়াউড়ি করেই সময় কাটায়। পতঙ্গ ভক্ষণের লোভে ঝোপ-জঙ্গলের কাছাকাছি বেশিরভাগ সময় উড়ে বেড়াতে দেখা যায়। দেখা যায় রসালো নরম ছোট ফল গাছের আশপাশেও। এদের খাবার এর তালিকায় রয়েছে কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়, ছোটখাটো সরীসৃপ। ছোট নরম ফল-ফলাদিও খায়। নিজেরা বাসা বাঁধতে জানে না। জ্ঞাতিভাই কোকিলের মতো পরের বাসায় ডিম পেড়ে পালিয়ে যায়। বেশিরভাগ সময় ডিম পাড়ে একটি। ডিম পাড়ে ঘুঘু, ফিঙ্গে, হলদে পাখির বাসায়।
সাধারণত একাকী বিচরণ করে। প্রজনন সময় ঘনিয়ে এলে জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। মার্চ থেকে জুন মাস এদের প্রজনন ঋতু। অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে বলে সঠিক ডিম ফোটার সময় নির্ধারণ করা যায় নি। তবে একটি ডিম ফুটে বাচ্চা হলে সেই বাচ্চাকে হিংসুটে বাচ্চা বলা যেতে পারে। কারণ সে ডিম থেকে বেড় হয়েই নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অন্য সকল ডিম গুলোকে বাসা থেকে বের করে দেয় বা ফেলে দেয়। এ যেনো প্রকৃতির এক নির্মম নিষ্ঠুরতা।