নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে রাঙ্গুনিয়ার চাকমা রাজবাড়ী
ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ধুঁকে ধুঁকে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে চাকমা রাজার সপ্তদশ শতাব্দীর চাকমা রাজবাড়ীটি। সৃষ্টি আর ধ্বংসের খেলায় কালের অতল গহব্বরে হারিয়ে যাচ্ছে ৩০০ বছরের পুরনো ইতিহাসের শেষ স্মৃতি চিহ্ন।
চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কপথে ৩৫ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক পথে ৪৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ইছামতী নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে প্রত্ন নির্দশনযুক্ত রাজপ্রসাদের ধ্বংসাবশেষ। অযত্নে-অবহেলায় নিশ্চিহ্ন প্রায় রাজপ্রসাদটি। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নে পা রাখলেই ভেসে আসে ৩০০ বছরের পুরনো এই ঐতিহাসিক প্রত্ন নিদর্শনের গন্ধ। আজও প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলছে রাজবাড়ীটির ক্ষয়ে যাওয়া প্রতিটি ইট-পাথর।
রাজ পরিবারের নথি ঘেঁটে জানা যায়, সতেরো শতকের দিকে ভারতবর্ষ যখন মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনাধীন তখন মোগল বংশধর সেরমুর্ত খাঁ ১৭৩৭ সালে সর্বপ্রথম এখানে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত ১৭৩৭ সাল থেকে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় চাকমা রাজত্বের গোড়াপত্তন শুরু হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার মাতামুহুরি নদীর অববাহিকায় আলীকদমে ছিল তার রাজধানী। তার রাজ্যসীমা ছিল উত্তরে ফেনী, দক্ষিণে শঙ্খ নদী, পূর্বে লুসাই পাহাড় এবং পশ্চিমে নিজামপুর রাস্তা। সেই সময় আরাকানিদের অত্যাচারে তিনি মোগল নবাবের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। তখন চট্টগ্রামের নবাব ছিলেন জুলকদর খাঁ। তিনি সেরমুস্ত খাঁকে রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। ১৭৫৭ সালে সেরমুস্ত খাঁ মৃত্যুর পর রাজা হন শুকদেব রায়। তিনি ছিলেন সেরমুস্ত খাঁর পোষ্যপুত্র। রাজা শুকদেব রায় আলীকদম ছেড়ে চাকমা অধ্যুষিত রাঙ্গুনিয়ার পদুয়ায় শিলক নদীর তীরে প্রাসাদ তৈরি করেন। নাম দেন সুখবিলাস। সেখানেই প্রতিষ্ঠা করেন রাজধানী। তার রানীর নাম ছিল ছেলেমা। রাজা শুকদেব রায়ের সন্তান ছিল না। তিনি তার রানীর নামানুসারে রাজপ্রাসাদের পশ্চিম দিকে একটি পুকুরের নামকরণ করেন ছেলেমা পুকুর।
পরে রাজ্য পরিচালনা ও বসাবাসের জন্য শুকদেব রায় দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের রাজাভূবণ গ্রামে নির্মিত করেন দ্বিতল রাজপ্রাসাদ। এটি সময়ের সেরা কারুকাজ ও শৈল্পিকতায় নির্মাণ করা হয়। এই রাজকুঠিরের নির্মাণ শৈলীর প্রতিটি পরতে পরতে রাখতেন ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। প্রসাদটির নিচ তলায় ৬টি ও দ্বিতীয় তলায় ৪টি কক্ষ। ভবনটি তৈরি হয় দেয়াঙ পাহাড়ের মাটির চার কোণাকৃতি ইট, চুন, সুরকি ও লোহাবিহীন।
প্রাসাদের প্রবেশ পথে স্থাপন করা হয় রাজদরবার, সৈন্যশালা ও বন্দিশালা। পাশেই আছে একটি সান বাধাঁনো পুকুর। তার পশ্চিম পাশেই আছে শাক্ষ্যমনি বৌদ্ধ-বিহার। তৎসংলগ্ন কালীন্দিরানী ও তার স্বামী রাজা ধরণ বক্স খাঁ এর ২টি চিতা মন্দির। এখানেই অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম থেরবাদী বৌদ্ধদের প্রথম ভিক্ষু সীমাগার।
পরবর্তীতে দক্ষিণ রাজনগরে প্রজা ও সর্বসাধারণের পানির কষ্ট দূরীকরণে রাজপ্রাসাদের পূর্ব পার্শ্বে খনন করেন কালীন্দিনী রানীর নামে সাগর দীঘি। স্থাপিত করেন রাজারহাট এবং কালীন্দিনী রানীর নামানুসারে রানীরহাট ও রাজাভূবণ মোহন রায়ের নামানুসারে রাজাভূবণ উচ্চ বিদ্যালয়।
১৭৭৬ সালে রাজা শুকদেব রায়ের মৃত্যুর পর তাদের বংশধর শের দৌলত খাঁ রাজ্যভার নিয়ে যখন রাঙামাটির রাজবাড়িতে রাজত্ব স্থানান্তর করেন সেই থেকে দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের রাজাভূবণ গ্রামে অবস্থিত রাজপ্রাসাদ, সৈন্যশালা ও বন্দিশালা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
৫২ একর জায়গাজুড়ে ৩০০ বছরের প্রাচীন এই ঐতিহাসিক রাজপ্রসাদটি বর্তমানে অযত্নে-অবহেলায় ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। তারপরও রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আজও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের বহু উত্থান- পতনের ঘটনা ও কালের সাক্ষী হয়ে। রাজপ্রাসাদটি এখন লতাপাতা দিয়ে আচ্ছাদিত। ইট-সুরকি দিয়ে তৈরি করা এই লোহাবিহীন রাজপ্রাসাদটির দেয়ালগুলোর প্রস্থ ছিল দুই হাতেরও বেশি। দেয়ালগুলো এখন নানা রকম আগাছা, তরুলতা ও ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়ে আছে। কালক্রমে খসে পড়েছে প্রাসাদের ছাদ। রোদের তাপে শুকিয়ে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে প্রাসাদটি একেবারে নড়বড়ে অবস্থা। নড়বড়ে অবকাঠামোর কারণে তেমন একটা পরিস্কার করাও সম্ভব হচ্ছে না। তার পরও যতটুকু সম্ভব ঝোপঝাড় পরিস্কার করে ধ্বংসাবশেষ রাজপ্রাসাদটি টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
এদিকে কালে কালে রাজার বংশধররা রাজপ্রাসাদটি রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা চালালেও সংরক্ষণের অভাবে শেষ রক্ষা হয়নি। ২০১৩ সালে রাজ বংশধর প্রমতোষ দেওয়ান পরলোকগমন করলে তার ছেলে রুমেল দেওয়ান রাজপ্রাসাদটি আঁকড়ে এখনো পড়ে আছেন। এর মধ্যেও প্রায় হারিয়ে গেছে প্রাসাদটির রাজ দরবার, হাতি-ঘোড়ার পিলখানা, বিখ্যাত সাগরদীঘি, পুরাকীর্তি, বৌদ্ধ-বিহারসহ গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। তবে রাজবাড়ির সান বাঁধানো পুকুর, সাগরদীঘির আংশিক অস্তিত্ব এখনো রয়েছে। অথচ কোনো সরকারই এই রাজপ্রাসাদটি প্রত্ন নির্দশন হিসেবে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
২০০৭ সালে বর্তমান রাজা দেবাশীষ রায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর রাঙ্গুনিয়ার মানুষ আশা করেছিল সংস্কারের মধ্যমে রাজপ্রাসাদটি গড়ে উঠবে একটি পর্যটন কেন্দ্রে। সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে ৩০০ বছরের পুরনো রাজকুঠিরের। ২০০৮ সালের মাঝামাঝিতে তিনি (দেবাশীষ রায়) সরকারিভাবে রাজবাড়ি এলাকা পরিদর্শনে এসেছিলেন। সংরক্ষণের কথাও বলেছিলেন। কিন্তু এখনো কোনো সংস্কার করা হয়নি।
সম্প্রতি রাঙ্গুনিয়ার সপ্তদশ শতাব্দীর বিলুপ্ত চাকমা রাষ্ট্রের এ রাজপ্রাসাদটি সংস্কার করে (আধিবাসী ভিলেজ ও রয়েল মিউজিয়াম) জাদুঘরে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নিয়ে সমীক্ষা করছে প্রত্নসম্পদ বিশেষজ্ঞের একটি টিম। খাগড়াছড়ির ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের অর্থায়নে রাঙ্গুনিয়া চাকমা রাজার রাজপ্রাসাদ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সমীক্ষা, মাপ-জোখ, অনুসন্ধান ও উৎখনন শুরু করেন।
গত ২৯ অক্টোবর রাজানগরের রাজপ্রাসাদের প্রাথমিক সমীক্ষা করে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্বতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর মোকাম্মেল হোসেন ভূঁইয়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা, স্থপতি আশিষ চাকমা ও প্রত্নসম্পদ বিশেষজ্ঞ টিমসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি টিম।
এ বিষয়ে সমীক্ষা টিমের সদস্য চবির ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা জানান, এটা হলো ঐতিহাসিক সভ্যতার নগরী। এখানে ঐতিহাসিক যে স্থাপনাগুলো রয়েছে সেগুলোকে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সংস্কার, মেরামত ও সংরক্ষণের প্রয়োজন। আমরা ইতিহাসবিদ, স্থপতি ও প্রত্নতাত্ত্বিকবিদ মিলে বিষয়টি গবেষণা করে এটার ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, স্থাপত্য শৈলীর গুরুত্ব, নৃ-তাত্বিক ও স্থানীয় ইতিহাসের গুরুত্বের সবগুলো দিক বিবেচনা করে আমরা মনে করছি এই রাজপ্রাসাদের সংরক্ষণের উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সেজন্য আমরা একটা সমীক্ষা প্রকল্প হাতে নিয়েছি।
তিনি আরও জানান, খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনস্টিটিউটের অর্থায়নে আমরা এই সমীক্ষা প্রকল্প পরিচালনা করছি। প্রকল্প সমাপনান্তে একটি প্রতিবেদন জমা দেব। ওই প্রতিবেদনের আলোকে তারা একটা বিস্তারিত সংস্কার পরিকল্পনার প্রজেক্ট প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেবেন। সেই সাথে প্রত্ন সম্পদের মালিক বর্তমান রাজা দেবাশীষ রায়ের সম্মতি ও পরামর্শনুযায়ী তার ব্যবস্থাপনায় এবং সরকারের সহযোগিতায় সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পরমর্শ দেব। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রাজাদের এখানকার ইতিহাসের যে ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে সেই সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করতে পারে। শুধু তাই নয়, এখানে জাদুঘর স্থাপনের মধ্য দিয়ে যাতে একটি ঋতু রাজ্যের যাবতীয় কর্মকাণ্ড গুলো নিদর্শনের আলোকে ফুটিয়ে উঠে। সেই ব্যবস্থা যাতে দ্রুত গ্রহণ করা যায় সেই ব্যাপারে আমরা প্রতিবেদনে উল্লেখ করব।
এদিকে স্থানীয়দের দাবি, বৃহত্তর চট্টগ্রামে বিলুপ্ত প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে দক্ষিণ রাজানগরের চাকমা রাজপ্রসাদটি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা জরুরি। প্রাচীন এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে রাজপ্রাসাদটি সংস্কার করলে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে।
এসআইএইচ