মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে ঘেরা ‘মরুদ্বীপ-৭১ স্বাধীনতা পার্ক’
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কিশোরগঞ্জে গড়ে উঠেছে স্বাধীনতা থিম পার্ক। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ফুটিয়ে তুলতে জেলার কটিয়াদী উপজেলার ছায়া সুনিবিড় নিভৃত গ্রামীণ পরিবেশে গড়ে উঠেছে ‘মরুদ্বীপ-৭১ স্বাধীনতা পার্ক’ নামে একটি বিনোদনকেন্দ্র।
কটিয়াদী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে লোহাজুড়ি ইউনিয়নের উত্তর লোহাজুড়ির কুঁড়েরপাড় গ্রামে অবস্থিত দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিনোদনকেন্দ্র ‘মরুদ্বীপ-৭১ স্বাধীনতা পার্ক’।
এখানে বাংলার গৌরবময় ইতিহাসকে সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের সবকিছুই আগামী প্রজন্মের জন্য তুলে ধরা হয়েছে। বিনোদনের পাশাপাশি দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে কিছু সময় আলিঙ্গন করতে ও সবুজের মাঝে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতেই মনোরম স্থানে এই স্বাধীনতা পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। পার্কের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ভেতরে রয়েছে ২১০ প্রজাতির দেশি-বিদেশি ফলজ, বনজ, ঔষধি ও ফুলের গাছ।
জানা যায়, ২০০৮ সালে কুঁড়েরপাড় গ্রামে গিয়েছিলেন একুশে পদক প্রাপ্ত ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন এবং বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি। তাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় অ্যাড. নুরুজ্জামান ইকবাল ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু করেন স্বাধীনতা পার্কের কাজ। একক প্রচেষ্টায় নিজস্ব ২০ একর জমির উপর তিনি গড়ে তুলেছেন পার্কটি। বর্তমানে ৫০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই পার্ক। সরকারি জমি ও পৈতৃক জমির সমন্বয়ে পার্কটির নান্দনিক চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
স্বাধীনতা পার্কের প্রবেশ পথের শুরুতেই চোখে পড়বে খ্যাতিমান ভাস্কর প্রয়াত মৃণাল হকের তৈরি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। বাংলাদেশের সংগ্রামী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বাস্তব রূপ দেখতে এখানে বিশেষ দিনগুলোতে ভিড় করেন দর্শনার্থীরা। পার্কের ভেতর প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও ক্ষুদিরাম বসুর ভাস্কর্য। পার্কের ভেতরে দেয়ালের একপাশে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের যে ১১টি সেক্টর ছিল সবগুলোর পরিচিতি এলাকাসহ তুলে ধরা হয়েছে। ছবিসহ ৭ বীরশ্রেষ্ঠের পরিচিতিও তুলির রঙে আঁকা রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি, ভাস্কর্য ও জাতীয় চার নেতার প্রতিকৃতি, সাত বীরশ্রেষ্ঠের ম্যুরাল, অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্যসহ রয়েছে শিশু পার্ক। দেয়ালে দেয়ালে ঠাঁই পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন কবিতা ও স্বাধীনতার স্লোগান। স্বাধীনতা সংগ্রামে বীর শহীদদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ। সুবিশাল জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত পার্কটি বাঙালি জাতির মুক্তির নেপথ্যে পরিশ্রমী নেতাদের ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগাঁথাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, রেসকোর্স ময়দানে নিয়াজির আত্মসমর্পণ ইত্যাদিও ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হবে। সেই কাজগুলো এখনো বাকি রয়েছে। ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু হয় এই পার্কের। বিনোদন পার্কটির বাকি কার্যক্রমগুলো এখনো চলছে ধীরগতিতে। পার্কের পরিপূর্ণরূপ পেতে আরও সময়ের প্রয়োজন।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক প্রয়াত আব্দুল গাফফার চৌধুরী পার্কের মূল ফটকের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১০ সালের ৩০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমান খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক প্রয়াত আবু জাফর সিদ্দিকী এ পার্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
পার্কের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান ইকবাল জানিয়েছেন, আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরার উদ্দেশ্যে এই স্বাধীনতা পার্কটি গড়ে তোলা হয়েছে। এ পার্কের মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও সংগ্রামী, বিপ্লবী, বিশেষ ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানতে ও দেখতে পারে সেটাই মূল লক্ষ্য।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিল তিল করে গড়ে উঠা পার্কটির অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ হলে এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করতে চান বলেও জানান নুরুজ্জামান।
এসজি