বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া সুব্যবস্থা পোরশা মোসাফিরখানায়
১৯০৮ সাল। বরেন্দ্র ভূমির এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত পথিক। সামান্য বিশ্রাম পেলে বড়ই প্রশান্তি আসত শরীরে। কিন্তু বনজঙ্গলে ঢাকা এলাকায় কোথায় সেই আশ্রয়। অনেক সময় নানা ভোগান্তির শিকার হতেন পথিক। তাদের এমন দুর্দশার কথা মনে করেই নওগাঁর পোরশা উপজেলায় মরহুম খাদেম শাহ্ ও আব্দুল হাকিম শাহ্ সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পোরশা মোসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তিন দিন বিনামূল্যে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেন এর প্রতিষ্ঠাতারা।
মোসাফিরখানার প্রতিষ্ঠাতা মরহুম খাদেম শাহ্ এর ছেলের নাতি মইনুল হাসান চৌধুরী বলেন, উপমহাদেশে আমার জানামতে কলকাতায় আরেকটি মোসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন ইব্রাহিম শাহ্। ওনার দেখা দেখি এই মফস্বল এলাকায় থাকা, খাওয়ার হোটেল ব্যবস্থা না থাকায় স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোসাফিরখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক তিন দিন বিনামূল্যে থাকা ও খেতে পারেন। এটাই এই মোসাফিরখানার সুব্যবস্থা।
নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমে পোরশা সদরের মিনা বাজারে অবস্থিত এ মোসাফিরখানা। অতিথিদের থাকার জন্য রয়েছে ১৬টি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে দুজন মানুষের জন্য দুটি করে খাট। অতিথি বেশি হলে হলরুমেও আছে থাকার ব্যবস্থা। একসঙ্গে সেখানে ৩০ জন থাকতে পারেন। সব মিলিয়ে এই মোসাফিরখানায় ৬০ জন মানুষ থাকতে পারেন। মোসাফিরখানার উত্তর পাশেই একটা পুকুর। তাতে শানবাঁধানো ঘাট। চাইলে সেখানে গোসল করে সারা দিনের শ্রান্তিও দূর করতে পারবেন ক্লান্ত পথিক। ভবনের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম দিকে খাবারের জন্য একটি জায়গা আছে। মোসাফিরখানার পক্ষ থেকে প্রতি বুধবার দুপুরে সেখানে গরিব ও অসহায় মানুষদের বিনামূল্যে খাওয়ানো হয়। গত ১১৪ বছর ধরে এ অঞ্চলে সুনামের সঙ্গে সেবার উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হচ্ছে এই বিশ্রামাগারটি।
সরজমিনে দেখা যায়, পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা একটি দ্বিতল ভবন। প্রশস্ত বারান্দা, আবাসিক কক্ষ, হলরুম, খাবারের স্থান, পরিচ্ছন্ন শৌচাগার, অজুর স্থানসহ নানা সুবিধা। আবাসিক প্রতিটি কক্ষে গালিচা পাতা। নওগাঁ পোরশা উপজেলায় ১৯০৮ সালে স্থানীয় ব্যক্তি খাদেম মোহাম্মদ শাহ্ তৈরি করেছিলেন একটি মাটির ঘর। ঘরের নাম দিয়েছিলেন মোসাফিরখানা। মানুষের রাত বা দিনে বিশ্রামের জন্যই এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। পাশাপাশি বিনামূল্যে খাবারেরও ব্যবস্থা করেছিলেন খাদেম মোহাম্মদ শাহ। এটি পরিচালনা ও এর সব ধরনের খরচ চালানোর জন্য তিনি মুসাফিরখানায় দান করে দিয়েছিলেন ২০০ বিঘা জমি। সেই ২০০ বিঘা জমিতেই বর্তমানের মুসাফিরখানাটি।
দুই দিন ধরে মোসাফিরখানার একটি কক্ষে আছেন মোতালেব হোসেন। চট্টগ্রামের বদ্দারহাট থেকে এসেছেন। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, 'ভাড়ায় থাকার মতো কোনো আবাসিক হোটেল এই এলাকায় নেই। এমন একটি প্রত্যন্ত স্থানে বিনা খরচে এ রকম থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, ভাবা যায় না। এখানকার সেবা খুব ভালো। লোকজন খুব আন্তরিক।'
১৭ বছর ধরে মোসাফিরখানাটির সেবক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, 'এখানে প্রতি বুধবার মুসল্লিরা খাওয়া-দাওয়া করে। মওলানা একরামরা যদি পোরশায় আসেন, তিন দিন এখানে রেখে খাওয়া-দাওয়া করানো হয়। আর কোনো মেহমান এলে যেহেতু এখানে কোনো আবাসিক বোর্ডিং নেই এখানেই থাকার যায়গা। প্রতি সপ্তাহে ফকির মিসকিনদের খাওয়ানো হয়।'
মোসাফিরখানার প্রতিষ্ঠাতার বংশধর মোহাম্মদ তৌফিক শাহ চৌধুরী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, 'এই মোসাফিরখানা আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রতিষ্ঠা করেন। তার ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও চলছে। আমরা পোরশার এলাকাবাসী সবাই সহযোগিতা করি। এখানে প্রতিদিনই মোসাফিরদের খাওয়ানো হয়। সে ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। আশা করি আগামী দিনেও চলবে। বিশেষ করে এই মোসাফির খানার প্রোপার্টি দেড় থেকে দুইশো বিঘা জমি রয়েছে। এই জমি আমাদের পূর্বপূরুষেরা দান করেছেন। প্রতি বছর মোসাফিরখানার উদ্দেশ্যে এলাকাবাসী সবাই সহযোগিতা করে।'
একটি কমিটির মাধ্যমে মোসাফিরখানাটি পরিচালিত হয়। বর্তমানে মোসাফিরখানা পরিচালনা কমিটির সভাপতি জামিলুর রহমান শাহ্ ও সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম শাহ্। অতিথিদের সার্বিক দেখভালের জন্য একজন ব্যবস্থাপক ও দুজন কর্মচারী আছেন।
প্রায় ২৫ বছর ধরে মুসাফিরখানার ব্যবস্থাপক সিরাজুল ইসলাম। তিনি বললেন, এখন প্রতিদিন গড়ে পাঁচজন অতিথি থাকেন। অন্যান্য সময়ের তুলনায় পবিত্র রমজান মাসে অতিথিদের আগমন বাড়ে। তখন প্রতিদিন ২০-২২ জন রাত যাপন করেন। মোসাফিরখানার জমির টাকা দিয়ে এসব খাওয়া খরচ চলে। স্থানীয় লোকজনও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেন।
এসএন