হাওড়ের মেয়ে নিকলী

নিকলীর গল্প সবার জানা। কিশোরগঞ্জের হাওড়ের কাহিনীগুলো রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বাড়ি বলে সবাই জানেন। সেখানে ঘুরে এলেন ভ্রমণবিদ মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম। সে গল্পের ছবি তাদের দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ দিলো
রাত প্রায় সাড়ে এগারটা। হুট করেই মাথায় চেপে বসল ঘোরার ইচ্ছে। মেসেঞ্জারে নক করলাম আরেক ভ্রমণবিদ হানিফকে। মজা করছি-এ রকমটাই ভাবল কিন্তু যখন লিখলাম, ‘বাপের বেটা হলে এখনি বাইক নিয়ে চলে আস।’ আর সহ্য করতে পারলো না। ঠিকই চলে এলো ভালোবাসার টানে। এরপর ভাবল, হয়ত আশেপাশে ঘুরব। আমি তাকে সোজা নিকলীর পথে যেতে বললাম। যাচ্ছে। তবুও কল্পনা করতে পারল না। শুধু জানাল, ‘তুমি যেতে পারলে, আমিও পারব।’ “সাব্বাশ-এরকমদেরই তো ‘দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’ খুঁজে।” ঢাকার আশুলিয়া বেড়ীবাঁধ হয়ে আমাদের মটরবাইক চলছে। রাত গভীরেও যানজট। গাজীপুর পৌঁছতেই বাসায় খবর হয়ে গেল। একে, একে পরিবারেরসহ বংশের ছোট-বড় অনেকেই ফোন দিলেন। ফেরাতে চাইলেন। বাসায় কাউকে বলে যায়নি তো। আমিও-এক কাপড়েই বের হয়েছি। এতেই যত বিপত্তি। কারো কোনো ফোনকলই অবশ্য ফেরাতে পারল না। ভ্রমণ ইচ্ছে আজ তুঙ্গে। যদি ফিরে আসি, হানিফকে যা লিখে ঘর থেকে বের করেছি, এখন উল্টোটাই আমাকেই ফিরিয়ে দেবে। না, না-তা হতে পারে না। গুণ, গুণ করে গাইতে, গাইতে-‘আমায় ডেকোনা/ ফেরানো যাবে না/ ফেরারী পাখিরা/ কুলোয় ফিরে না’-গাজীপুর চৌরাস্তা। পার হয়ে খাস্তা পরোটা আর ডিম ভাজা দিয়ে রাতের খাবার সেরে নিলাম। এসব হোটেলগুলো যেন আমাদের মত ভ্রমণপ্রিয়দের জন্যই খোলা রাখে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে বাইক স্টার্ট। রাতের নিরবতা ভেদ করে চলছে। চকচকে পিচের প্রশস্ত ফাঁকা রাস্তা। একপশলা বৃষ্টি এসে রণে ভঙ্গ দেয়ার জন্য আক্রমণ করলো। তবুও থামাতে পারলো না। হার মেনে বৃষ্টিই পালালো। চলতে, চলতে মহাসড়ক ছেড়ে, ডানে মোড় নিয়ে কাপাসিয়ার দিকে যাওয়া সড়কে চলছি। পথটা কেমন যেন ভৌতিক। দুপাশে ঘন শালবন। মাঝে সরু সড়ক। রাত গভীরে গা ছমছম করে, সুনসান নিরিবিলি পথ। অন্যরকম অনুভব। যেতে, যেতে শীতলক্ষা নদীর উপর তৈরি করা ফকির মজনু শাহ্ সেতু পার হয়ে মিয়ার বাজারে ব্রেক কষলাম। রাত প্রায় আড়াইটা। এক দোকানী এই রাত গভীরেও এরকম গ্রাম্য জনপদে, তার চায়ের পসরা নিয়ে বসে আছেন। চা, বিস্কুট খেয়ে পান চিবুতে, চিবুতে আবারও ছুটে চললাম মূল পথে, নিকলীর দিকে।
প্রায় সুবহে সাদিকের সময় কিশোরগঞ্জের বিন্নাটির মোড়ে পৌঁছলাম। রাতজাগা দোকানীদের মুখে নিকলি যাবার সঠিক পথ জেনে নিতে হলো আমাদেরও। তবে এগুতে থাকলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই পুলের ঘাট বাজার। ফ্রিজ আছে। ঠান্ডা পানি, বিস্কুট খেতে, খেতে দোকানিদের সঙ্গে আলাপ জুড়লাম। তারা এরকম সময়ে না যাওয়ার জন্য যেমন বলছেন, নিরাপত্তার কোন সমস্যা নেই, সে অভয়ও দিচ্ছেন। মানে ফিফটি, ফিফটি নিন। কেন? গিয়েই দেখি।
ফজরের আযান ও জামাতের আরো অনেক দেরী। ঘরের কাছে এসে কার মনে চায়, অযথাই সড়কের পাশে সময় কাটাতে? হানিফকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আগাবে?’ সোজা উত্তর, ‘তোমার ইচ্ছে।’ ইচ্ছে যখন আমারই, ‘চলো আল্লাহর নাম নিয়ে আগাই।’ যেতে, যেতেই ফজর আযান হলো। পথের পাশের এক মসজিদে নামাজ আদায় করলাম। এরপর রাইড।
শখ জেগেছে, নিকলি গিয়ে সূর্যোদয় দেখব। যেতে, যেতে পথের সৌন্দর্যে বিভোর আমরা। মাঝে, মধ্যেই থমকে যাই। গ্রামবাংলার অসাধারণ নয়নাভিরাম রূপ, নিকলীর পথের গ্রামগুলোর ওপর ভর করেছে। ভোরের আলোয় চেনা-অচেনা পাখির কলতানগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বাইক চলছে মন্থরে। এই পথের প্রেমে পড়ে সূর্যোদায়ের কথা ভুলে গেলাম। নিকলী বেড়িবাঁধে যখন ঢুকলাম-এ যেন অন্য জগত। যে জগতে শুধু প্রকৃতিদেবেরই বিচরণ। আমরা হলাম অনাহুত, আগন্তক।
উপজেলা পরিষদের ভবন পেছনে ফেলে আরো এগিয়ে গেলাম। একেবারে বেড়িবাঁধের শেষঅব্দি। যতদূর চোখ যায়, পানি আর পানি। সে অপরূপ। এই হাওড়ের নাম নিকলী। কিশোরগঞ্জ জেলার অন্যতম বৃহৎ ও নয়নাভিরাম হাওড়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অসাধারণ, ভালোলাগার। নিকলী বেড়িবাঁধ, হাওরের নান্দনীকতা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে জেলেদের মাছধরার মহাকর্মযজ্ঞ। ভ্রমণ পিপাসুরা ইচ্ছে করলে ছৈ তোলা নৌকায় ভেসে বেড়াতে পারেন। যাওয়া যাবে একেবারে অথৈ পানির মাঝে, ছোট্ট দ্বীপের মত জেগে থাকা গ্রামগুলোতে। হাওড়ের সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য, তীর থেকে দেখতে পাওয়া কম বিষয় নয়। হিজল, করচ গাছগুলো টইটুম্বুর পানির বুকে মাথা উঁচু করে জানান দেয় সমসময়-শত প্রতিকুলতার মাঝেও কীভাবে টিকে থাকতে হয়? আসলে ভ্রমণ শুধু বিনোদনই নয়, শিক্ষা লাভেরও অবিশ্বাস্য মাধ্যম। দেখা হলো তাদের সঙ্গে-পাটের আঁশ তোলা শ্রমজীবী মানুষ। তাদের কায়িক পরিশ্রম। তবুও মানুষগুলোর চোখেমুখে সুখের হাসি। সুখী হতে হলে জীবনে প্রাচুর্যতার চাইতে সুন্দর মন ও মানসিকতাই যথেষ্ট। ভ্রমণকালীন আমি প্রকৃতির রূপ-লাবণ্য উপভোগ করার পাশাপাশি স্থানীয়দের যাপিত জীবন সম্পর্কেও জানতে ভালোবাসি।
ঘুরতে, ঘুরতে চোখ আটকাল একটি ঝুপড়ি দোকানে। খেতে ভালোবাসি তো, এগিয়ে গেলাম। যেতেই দেখি, ধোঁয়া তোলা চিতই পিঠা ও নানা ভর্তা। আহ্, না খেয়ে আর পারলাম না। সাতসকালের নাশতার পর্ব সুরমার হাতে বানানো পিঠা দিয়ে সারলাম। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফেরার পালা।
যাবেন : বন্ধুরা আর দেরী কেন? ঘুরে আসুন কিশোরগঞ্জ জেলার মোট ৯৭টি হাওড়ের সম্বৃদ্ধ একটি, তাদের মতো সুন্দর নিকলীতে। আশেপাশেও যেতে পারেন অন্য কোনো হাওরে।
কিভাবে : ঢাকা থেকে সরাসরি বাস ও ট্রেনে কিশোরগঞ্জ। সদর হতে সিএনজিতে নিকলী। জানা ভালো-সকাল, সকাল রওনা দিলে দিনে দিনে ঘুরে আসা যায়।
বাস-ট্রেনের সময় : মহাখালী ও সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে দিনে-রাতেই বিভিন্ন পরিবহনের বাস ছেড়ে যায়। কমলাপুরে সকাল ৬টা ৩০ মিনিট থেকে ১০টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত তিনটি ট্রেন ছেড়ে যায়। দুপুরে ট্রেন আছে। দিনে, দিনে ফেরার জন্য সকালের ট্রেনই ভালো।
ওএস।
