নেত্রকোনায় রাসেলের অভিনব পাঠাগার
খুঁটির উপর ছোট্ট একটি বাক্স। দুইপাশে বেশ কয়েকটি প্লাস্টিকের চেয়ার। উপরে কয়েক পাতা টিনের একটি চালা। এটি বইবন্ধু পাঠাগার। ১৫ হাজারেরও বেশি টাকার বই আছে এখানে। অথচ নেই কোনো তালা-চাবি। যে কেউ যেকোনো সময় চাইলেই বাক্সের দরজা খুলে পছন্দের বইটি বেঞ্চে বসে পড়ছেন। এ এক অভিনব পাঠাগার।
নেত্রকোনা জেলা সদরের মৌগাতি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আনুমানিক ১০০০ ফুট উত্তরে এগোলেই চোখে পড়বে এ পাঠাগার। নগুয়া কুশলগাঁও গ্রামের ঢুপিখালী নদী ও ঘন সবুজ বনের উপকূলে অবস্থিত পাঠাগারটিকে ‘বইবন্ধু পাঠাগার’ নাম দিয়েছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ।
পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা ১৬ বছর বয়সী কবি মো. রাসেল হাসান। এর আগে তিনি বিস্ময়কর সব প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তিনি ‘জ্যোৎস্নাধোয়া রাত’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। অভিনয় করেছেন সিনেমাতেও। বহুমুখী প্রতিভাধর এ কিশোরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্প ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য।
রাসেল একদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। পাশেই একটি ঘরে সভা হচ্ছে দেখে তিনি একজনের কাছে জিজ্ঞেস করলেন ভিতরে কী হচ্ছে। কোনো পাঠাগার প্রতিষ্ঠার আলোচনা সভার কথা জেনে তিনিও সভায় শরিক হওয়ার লোভ সামলাতে পারছিলেন না। কিন্তু বয়স ছিল অন্তরায়। কেবল ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া বালক পিতৃতুল্য মানুষের কাছে যেতে সাহস পাননি। এরপর একদিন ওই পাঠাগার প্রতিষ্ঠাতার কাছ থেকে জানতে পারলেন- এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে যারা অবসরে আছেন তারাই কেবল পাঠাগার থেকে বই পড়তে পারবেন।
তখন রাসেল নিজেই পাঠাগার প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করলেন। কিন্তু নিজের সামর্থ্যের দিকে তাকিয়ে দমে যান তিনি, তবে দমে যায়নি তার চিন্তা। অবশেষে দশম শ্রেণিতে এসে সেই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করেন। একদিন তিনি পরিকল্পনা করলেন ছোট্ট একটি বাক্স বানিয়ে একটি খুঁটিতে রাস্তায় পুঁতে রাখবেন।
বাক্সটি বইয়ে ভরপুর থাকবে। মানুষ এখান থেকে নিয়ে বই পড়বে। তখন তার হাতে ছিল ৬০০-৭০০ টাকা। বাজারে গিয়ে জানতে পারেন এ টাকায় বাক্স তৈরি হবে না। এরপর অনেকের কাছে সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হন। ফেসবুকে পোস্ট দিলে কেউ কেউ এগিয়ে আসেন সহযোগিতায়। বানান বাক্স। প্রয়োজন দেখা দেয় লোহার খুঁটি তৈরির। আবার হাতে টাকা নেই, করেন ঋণ। বাক্স ও খুঁটি বানানো হলো।
দেখা গেল উপরে টিন না দিলে হবে না। অনেক কষ্ট করে সে অর্থ জোগাড় করে পাঁচ পাতা টিন কিনে এনে তার কাকাকে নিয়ে চালাটি তৈরি করেন। কিছু বইও কিনে রাখেন পাঠাগারে। তার অভিনব পাঠাগারে পাঠকের আনাগোনা দেখে আনন্দ অশ্রুতে ভরে ওঠে চোখ। রাসেল কবি নির্মলেন্দু গুণের কাছে পাঠাগারটির নাম চাইলে তিনি পাঠাগারটির নাম দেন ‘বইবন্ধু পাঠাগার’।
কবি রাসেলের এ পাঠাগারে তার লেখা ৪৩টি বই ও পাঁচটি চেয়ার উপহার দেন এবং আরও বই দেবেন বলে জানান। রাসেলের চোখ এখন উদ্ভাসিত। চারদিক থেকে পাঠক আসতে শুরু করেছে এরই মধ্যে। জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকেও আসছেন অনেকেই।
পাঠাগারের পাঠক ঝুমা আক্তার বলেন, বইবন্ধু পাঠাগার আমাদের জ্ঞানের ক্ষুধা মিটাচ্ছে।
বিদ্যুৎ তালুকদার আরিফ বলেন, আমরা পাঠাগারের অভাব অনুভবন করতাম। পাঠাগারটি হওয়ায় ভীষণ ভালো লাগছে। সময় পেলেই চলে আসি বই পড়তে।
কবি তানভীর জাহান চৌধুরী বলেন, যে পাঠাগারে কবি নির্মলেন্দু গুণ দৃষ্টি দিয়েছেন সে পাঠাগার দৃষ্টি নন্দিত হবে। একদিন বইবন্ধু পাঠাগার হবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো।
কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক অধ্যাপক ননী গোপাল সরকার বলেন, বইবন্ধু পাঠাগার পরিদর্শন করে চমৎকৃত হয়েছি। ঢুপিখালীর তীরে গাছ গাছালির শ্যামল ছায়ায় ভিন্নধর্মী এ পাঠাগার নিরবে নিভৃতে জ্ঞানের আলো বিলিয়ে দিচ্ছে।
রাসেল হাসান বলেন, মানুষ এখন অনেক সভ্য, অনেক বিশুদ্ধ। কিন্তু অনেকের দৃষ্টিভঙ্গিই খারাপ। আমাদের চিন্তা ইতিবাচক করা উচিত। আমাকে অনেকে বলছিল বই চুরি হয়ে যাবে। আসলে তা না। কে চুরি করবে? যে বই পড়ে সে কখনো চুরি করবে না। আর যে চুরি করে সে তো পড়বে না। সুতরাং চুরি হবে কেন। বই পাঠাগার থেকে কেউ চুরি করেনি, করবেও না আশাকরি।
তিনি আরও বলেন, সামনে বর্ষা মৌসুম আসছে। ঝড়-বাদলে বই তো ভিজেই যাবে। পাঠাগারটির ক্ষয়ক্ষতিও হবে। এখন প্রশাসন যদি ছোট করে হলেও একটি ঘর নির্মাণ করে দেয় তবে বইবন্ধু পাঠাগার অনেক উপকৃত হবে।
এসএন