যেসব কারণে বাড়ছে স্বর্ণের দাম, যা বলছেন বিশ্লেষকেরা
ছবি সংগৃহিত
বিশ্ববাজারে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে বিলাসী ধাতু সোনার দাম। ভূরাজনৈতিক কারণে ডলারের দরের হেরফের, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নিরাপদ রিজার্ভ হিসেবে সোনা কেনায় তৎপরতা ও এশিয়ার বাজারে সোনার চাহিদা বাড়ায় রেকর্ড মূল্যে সোনার দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
মাঝে বছর দুয়েক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে স্বর্ণের দামে সেভাবে না বাড়লেও যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার হ্রাস করবে- বাজারে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম দ্রুত বাড়ছে।
এছাড়াও বিভিন্ন ঘটনায় বাজারে স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে। হিন্দুস্তান টাইমসের এক সংবাদে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতের বাজারেও স্বর্ণের দাম রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। খাদহীন ১০ গ্রাম স্বর্ণের দাম দেশটির বাজারে ৬৫ হাজার ২৯৮ রুপি পর্যন্ত উঠেছে। কেবল চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে প্রতি ১০ গ্রাম স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৭০০ রুপি করে বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে স্বর্ণে বিক্রিতে ভাটা পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এশিয়ার বাজারে সোনার চাহিদা বেশি এবং এখন তা আরও বাড়ছে। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিরাপদ রিজার্ভ হিসেবে সোনা কিনছে। গত আট মাসে তারা যত সোনা বিক্রি করেছে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণে কিনেছে। গতকাল মঙ্গলবার সোনার স্পট মূল্য শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ১৪১ ডলারে উঠে যায়; এরপর তা আবার ২ হাজার ১৩০ ডলারে নেমে আসে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে সোনার দাম এযাবৎকালের সর্বোচ্চ আউন্সপ্রতি ২ হাজার ১৫০ ডলারে উঠেছিল।
হঠাৎ করে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম তরতর করে বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে ডলার সূচকের মান পড়ে যাওয়া। বিশ্বের ছয়টি প্রধান মুদ্রার সাপেক্ষে ডলারের মান কত, তা নির্ধারণ করতে যে ডলার ইনডেক্স বা সূচক তৈরি করা হয়েছে, সেই সূচকের মান গত মাসে কমেছে। এ মাসে ডলার সূচকের মান ১০৪-এর নিচে নেমে এসেছে, এখন তার মান ১০৩ দশমিক ৮০।
ডলারের বিনিময় হার বাড়লে স্বর্ণের দাম কমে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে স্বর্ণের দাম পড়েছে, যার অন্যতম কারণ ছিল ইনডেক্স সাপেক্ষে ডলার শক্তিশালী হওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১০ বছরের বন্ডের সুদহার ১৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ওপরে উঠে যাওয়া।
শুধুমাত্র গহনা তৈরিতে নয়, বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণ গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকের সুদহার বাড়লে বা শেয়ারবাজার শক্তিশালী হলে বিনিয়োগকারীরা এসবের মধ্যে বিকল্প বিনিয়োগের মাধ্যম খুঁজে পান। তখন স্বর্ণের চাহিদা কমে। সে কারণে ২০২২ ও ২০২৩ সালে বিনিয়োগকারীরা ডলারভিত্তিক বন্ডে বিনিয়োগ করেছেন। এখন ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার হ্রাস করলে বন্ডের সুদহারও কমে যাবে, সে জন্য বিনিয়োগকারীরা আগেভাগে স্বর্ণে বিনিয়োগ করছেন।
তবে গত মাসে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম কমেছে। প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ফেব্রুয়ারি মাসে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ কমে ২ হাজার ৩২ ডলারে নেমে আসে। ভারতের বাজারেও গত মাসে স্বর্ণের দাম শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া কয়েক বছর ধরে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণ কেনা বাড়ছে, যদিও ২০২৩ সালে আগের বছরের চেয়ে কিছুটা কম স্বর্ণ কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। গত বছর তারা সব মিলিয়ে ১ হাজার ৩৭ টন স্বর্ণ কিনেছে।
স্বর্ণের দাম বাড়ার সঙ্গে মূল্যস্ফীতির বিশেষ সম্পর্ক নেই বলেই গবেষকেরা মনে করেন। স্বর্ণের দাম বাড়ার মূল কারণ হলো ভয় ও আতঙ্ক। সেই ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় থেকেই দেখা যাচ্ছে, সংকট এলেই স্বর্ণের দাম বাড়তে থাকে। গোল্ড প্রাইজ ডটকমের তথ্যানুসারে, ১৯৭০ সালের সংকটের সময় স্বর্ণের দর আউন্সপ্রতি ৩৫ ডলার বেড়ে ৫২৫ ডলার হয়েছিল; ১৯৮০ সালে সেই দর হয় ৬১৫ ডলার। ১৯৯০ সালে সেটি অনেক কমে ৩৮৩ ডলারে নেমেছিল।
কিন্তু ২০০৮ সালে আবার অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেওয়ার পর ২০১১ সালে স্বর্ণের দাম অনেকটা বেড়ে যায়; তখন দাম ওঠে ১ হাজার ৯০০ ডলারে। মাঝে অবশ্য ২০১৫ সালের দিকে স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৪৯ ডলারে নেমে এলেও বেশি দিন সেই দামে থাকেনি। এর পর থেকে দাম কেবল বেড়েছেই।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, মহামারির পর চলতি বছর সবচেয়ে কম হারে প্রবৃদ্ধি হবে। সেই সঙ্গে ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার কমাবে- মূলত এ দুই কারণেই এখন হঠাৎ স্বর্ণর দাম বাড়ছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।