শিক্ষার্থী নিহতের পর বেরোবির ভিসির বাসভবনে ভাঙচুর, পুলিশের গাড়িতে আগুন
ছবি: সংগৃহীত
রংপুর মহানগরীর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সামনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষে একজন নিহত এবং পুলিশ-সাংবাদিকসহ শতাধিক আহত হয়েছে। শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহতের পর বিক্ষুব্ধ হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বেরোবির ভিসির বাসবভন ও বঙ্গবন্ধু হলে ভাঙচুর চালিয়েছে এবং পুলিশ ও ছাত্রলীগ সভাপতিরসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি-মোটরসাইকেল ভঙচুর, অগ্নিসংযোগ করেছে।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত লালবাগ থেকে মডার্ন মোড় এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছে শিক্ষার্থীরা। পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি।
নিহত শিক্ষার্থীর নাম আবু সাঈদ। তিনি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনকারীদের অন্যতম নেতৃত্ব দানকারী।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
সোমবার (১৬ জুলাই) সকাল থেকেই উত্তাল হয়ে উঠে রংপুর মহানগরী। সকাল ১০টায় মেডিক্যাল ক্যাম্পাসে কয়েক শ’ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করে। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রংপুর ডিসির মোড় থেকে জিলা স্কুল, পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ, লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সরকারি কলেজ, পলিটেকনিক ইন্সটিউটের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ নিয়ে জাহাজ কোম্পানি মোড়ের দিকে যাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন ব্যাকোলোজি মোড়ে তাদের বাধা দেয় পুলিশ।
এ সময় পুলিশের সাথে ব্যাপক বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে তারা। একপর্যায়ে পুলিশের বাধা অতিক্রম তারা সামনের দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় পুলিশ তাদের ওপর হামলা করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এ সময় কয়েকজন পুলিশকে শিশু শিক্ষার্থীদের গলা চেপে ধরতে দেখা গেছে। তারপরেও মিছিলকারারী পুলিশের বাধা ডিঙ্গিয়ে সামনের দিকে রওনা হয়।
শিক্ষার্থীরা পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানি মোড়, জীবন বীমা মোড়, শাপলা চত্বর, চারতলা মোড়, মেয়রের মোড় হয়ে লালবাগে অবস্থান নেয়। সেখানে তাদের সাথে যোগ দেয় কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এরপর মিছিলটি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ব ঘোষিত সমাবেশে যাওয়ার জন্য ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের দিকে গেলে তাতে বাধা দেয় ছাত্রলীগ ও পুলিশ। পুলিশ ব্যাপক টিয়ারশেল রাবার বুলেট ও ছররা গুলি ছুড়তে থাকে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
বেলা পৌনে ২টার দিকে আন্দোলনকারীদের নেতা আবু সাইদ পুলিশ ও ছাত্রলীগের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা আর গুলি ছুড়বেন না।’ এরপর দু’হাত তুলে বলেন, ‘আপনারা আমাকে গুলি করেন।’ সাথে সাথে ১ নম্বর গেট থেকে পুলিশ তার বুকে তিন রাউন্ড ছররা গুলি ছুড়লে মাটিতে পরে যান তিনি। শিক্ষার্থীরা তাকে দ্রুত রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে ভর্তি করায়। সেখানে চিকিৎসাধীন মৃত্যু হয় আবু সাঈদের।
এর মধ্যেই রণক্ষেত্রে পরিনত হয় পার্কের মোড়সহ আশপাশের এলাকা। ১ নম্বর গেট থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রাম দা, বেকি, লাঠিসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পার্কের মোড় ও মডার্ন মোড়ের দিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ধাওয়া করে পুলিশের সহযোগিতায়। আবার সাধারণ শিক্ষার্থীরা গাছের ডাল, লাঠি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে প্রতিরোধ গড়ে তুললে পুলিশ তাদের উদ্দেশ্যে টিয়ারশেল নিক্ষেপ এবং রাবার বুলেট ও গুলি ছোড়ে।
বেলা পৌনে ৩টায় সেখানে পার্কের মোড়ের দিকে মোটরসাইকেল মহড়া নিয়ে আসেন জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সিদ্দিকী রনির নেতৃত্বে ৩০ থেকে ৩৫ জন যবুলীগ নেতাকর্মী। এরপর সেখানে আসেন জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীরা। তারাও শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধে দফায় সংঘর্ষে অংশ নেন। এভাবে বেলা পৌনে ৪টা পর্যন্ত অন্তত ১২ দফায় সংঘর্ষ চলে। একপর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে পুলিশ ও ছাত্রলীগ যুবলীগ স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতাকর্মীরা পার্কের মোড় ছেড়ে দিয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করেন। তখন লালবাগ থেকে মডার্ন মোড় পর্যন্ত পুরো এলাকা দখল করে নেয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা ১ নম্বর গেট ভেঙে দফায় দফায় ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করে।
এরই মধ্যে খবর আসে ছাত্রলীগ হলের ছাত্রীদের ওপর হামলা করেছে। খবর পেয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধু হলে ভাঙচুর চালায়। সেখানে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়ার ব্যক্তিগত গাড়ি এবং বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা ভিসির বাসভবনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। আগুন ধরিয়ে দেয় একটি পুলিশের গাড়িসহ কয়েকটি গাড়ি ও মোটরসাইকেলে।
অন্যদিকে এ সময় চারতলার মোড়ে ছাত্রলীগের এক নেতার মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও ১ নম্বর গেটের সামনে অবরোধে উপেক্ষা করে যাওয়ার সময় সিটি ব্যাংকের একটি গাড়িতে ভাঙচুর চালায় তারা।
সংঘর্ষের সময় পুলিশের ছররা গুলি ও টিয়ারশেলে বাংলাভিশনের ভিডিও সাংবাদিক জনিসহ ১০ সাংবাদিক এবং শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে।
এদিকে মেডিক্যাল ক্যাম্পাসে লাশ নিয়ে মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। এরপর লাশ তাদের কাছ থেকে পুলিশ হেফাজতে নিলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়। লাশের দাবিতে আবারো বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মডার্ন মোড় থেকে ক্যোম্পাসের দিকে পুলিশের সাজোয়া গাড়ি ও কয়েক শ’ পুলিশ কর্ডরন করে আসতে থাকলে শিক্ষার্থীরা আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠে। তারা বিক্ষোভ নিয়ে ক্যাডেট কলেজের প্রধান গেটের সামনে গিয়ে পুলিশের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পুলিশ সাজোয়া যানসজ পিছু হটতে থাকে।
ক্যাডেট কলেজ পোস্ট অফিসের সামনে গেলে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে আসে এক প্লাটুন বিজিবি। তাদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করে তারা। পরে তারা মডার্ন মোড়ের আশপাশে অবস্থান নেয় এবং লাশের দাবি করে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে তাদের সেখান থেকে বের করে দিয়েছে ছাত্রলীগ।
রংপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মো: মনিরুজ্জামান জানান, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুড়েছে। পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অন্তত ১০ পুলিশ আহত হয়েছে। এ ঘটনায় এক শিক্ষার্থী মারা গেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে এ ঘটনায় রাবার বুলেট বিদ্ধ হওয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নিহতের হওয়ার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
তবে রংপুরের ডিসি মোবাশ্বের হাসান রাত ৮টায় জানান, ছাত্রী নিহতের ঘটনা গুজব। মেফতাউল ইসলাম মিতা নামের ওই শিক্ষার্থী এখন সুস্থ ও নিজ বাড়িতে আছেন।
এদিকে নিহতের বাড়ি পীরগঞ্জের জাফরপাড়ায় চলছে শোক। তার বাবা মকবুল হোসেন আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয়কর্মী বলে জানা গেছে। সূত্র: নয়াদিগন্ত