১৭ বছরের যৌবনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
আজ ২৮ মে, আমাদের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। হাঁটি, হাটি; পা, পা করে বছরগুলো পার করেছে। ১৭তম বর্ষে পদার্পণ করেছে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে, ময়নামতি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে লালমাটির এই ক্যাম্পাস। লিখেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি চৌধুরী মাসাবি
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, চট্টগ্রামের মাঝামাঝি, কুমিল্লা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণে, সদর দক্ষিণ থানায় অবস্থিত। আর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সবুজ গাছ গাছালিতে ছাওয়া। তবে ছোট, বড় টিলা আর উঁচু, নিচু লালমাটির ঢিবি অনন্য প্রাপ্তি। । সেখানে আছে ইতিহাসের রোমাঞ্চকর গল্প।
এককালের প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ জনপদ ‘সমতট’ রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল এই লালমাই-ময়নামতি অঞ্চল। ইতিহাসের পথ বেয়ে সপ্তম শতাব্দীতে বাংলার চন্দ্রবংশীয় রাজা ভব দেবের হাতে শালবন বা আনন্দ বিহারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিহারটি ছিল পুরো এশিয়া মহাদেশে বৌদ্ধদের জ্ঞানঅর্জনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উচ্চতম বিদ্যাপীঠ। তৎকালীন পন্ডিত, অধ্যাপকরা সবাই নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দিয়েছেন। পৃথিবীর বহু দেশের শিক্ষাথীরা নানা শাস্ত্রীয় জ্ঞান অন্বেষণে এই আনন্দ বিহারে আসতেন। আবাসিক বিহার হিসেবে এখনো অনন্য এই শালবন বিহার।
৬৩৮ সালে বিশ্ববিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং শালবন বিহারে আসেন। তখন আনন্দ বিহারে চার হাজার ভিক্ষু (ছাত্র) দেখতে পান তিনি। হিউয়েন সাং ময়নামতি অঞ্চলে ৩৫টি বিহার (শিক্ষাকেন্দ্র) দেখেছেন বলে তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তৎকালীন সমতট, বর্তমানে কুমিল্লাবাসীদের তিনি শিক্ষানুরাগী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সেই বিহার আর নেই। গড়ে উঠেছে সেখানে বাংলাদেশের অন্যতম সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। নাম কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। অন্যসব ক্যাম্পাসের মতো আমাদেরও ১৭ বছরে পদার্পণের গল্পটি মোটেও সহজ ছিল না।
২০০৭ সালের ২৮ মে এই পূণ্যস্থানে প্রথম ব্যাচে মোট ৭টি বিভাগে ৩শ ছাত্র, ছাত্রী ও ১৫ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় আমাদের । এখন ৬টি অনুষদ হয়েছে। বাড়তে, বাড়তে মোট ১৯টি বিভাগ গড়ে উঠেছে। পড়ালেখা করছেন ৭ হাজার ৫৫ জন ছাত্র, ছাত্রী। আমাদের জন্য রয়েছেন ২শ ৫২ জন অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক। ৯১ জন কর্মকর্তা ও ১শ ৭৫ জন কর্মচারী রয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ৫টি আবাসিক হল। এগুলো হলো ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল’, ‘কাজী নজরুল ইসলাম হল’, কুমিল্লার সন্তানের নামে ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল’, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা জমিদার আমাদের নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর নামে ‘নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হল’ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে ‘শেখ হাসিনা হল। এই হলটি নির্মাণাধীন। শিক্ষার্থীদের পরিবহন সুবিধায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব মালিকানার ৮টি বাস, ১২টি ভাড়ায় চালিত বাস।
২০২০ সালের ২৭ শে জানুয়ারি হয়েছে প্রথম সমাবর্তন। আনন্দঘন সমাবর্তনানুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছেন আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ। অংশগ্রহণ করেছেন ২ হাজার ৮শ ৮৭ জন পাশ করা ছাত্র, ছাত্রী। ১ম ব্যাচ থেকে ৮ম ব্যাচ পর্যন্ত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করা এই সকল শিক্ষার্থী রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর সম্বলিত সনদ লাভ করেছেন।
নানা জল্পনা, কল্পনা; অনেক চড়াই, উৎরাই পার করে এত দূর এলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি জানি, আমাদের প্রাণপ্রিয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাপ্তি ও অধিকারের অনেক ফারাক আছে। পর্যাপ্ত ক্লাসরুম, অডিটোরয়াম, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, যথেষ্ট রিসার্চ সেন্টার, টিএসসি, মিডিয়া ল্যাবসহ অনেক কিছুর অপ্রতুলতা রয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের ওপর ভর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেষ্টায় ফলে ভালোভাবে চলছে। সব আশা ও প্রত্যাশা অতিশীঘ্রই বাস্তবে রূপদান করতে চলছে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ৫০ একরকে ২শ ৫০ একরের পরিণত করার প্রশাসনের কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে তৈরি করা হয়েছে ২ কোটি টাকার প্রধান ফটক। গেল বছরের ২৪ মে ১শ ৯৮ দশমিক ৮৯ একর ভূমি অধিগ্রহণ করতে তারা কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের অফিসকে ৪৭১ কোটি ১১ লক্ষ ২২ হাজার ৫৫ টাকার চেক দিয়েছেন। ফলে ১০ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে জেলা প্রশাসন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে ২০০ একর ভূমি বুঝিয়ে দিয়েছেন। তবে কদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রধান অতিথি হিসেবে বলেছেন, ‘সরকার কোনো সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়কে ৫০ থেকে ৬০ একরের বেশি জায়গা দেবে না। যাদের বেশি জায়গা আছে তারা ছেড়ে দেবেন।’ এই তথ্যটি মাথায় আছে আমাদের অধ্যাপকদের?
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উপচার্য অধ্যাপক ড. এফ. এম. আব্দুল মঈন। ১৭তম প্রতিষ্ঠাবাষিকীতে স্যার বলেছেন, ‘যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র, ছাত্রীদের মূল কাজ হচ্ছে, সৃজনশীল, একাডেমিক পড়ালেখা ও গবেষণা করা। অমুকের চামড়া তুলে নেব আমরা-এসব বাজে কাজের পেছনে সময় নষ্ট না করে সবাইকে জীবনের এই সময়গুলো ভালোভাবে, ভালো কাজে ব্যয় করতে হবে। সারাবিশ্বেই তাই হয়। আমরা জানি না বলে করি ও বিপদ আনি। ফলে আমাদের কাজ হবে, কীভাবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বাড়াতে পারি। বাংলাদেশ ও বিশ্বের বুকে নিজেরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি। শিক্ষিত ও সজ্জ্বন হতে পারি। ভালো চাকরি পেতে পারি। ভালো চাকরি ও জীবনে ভালো করতে ভালো পড়ালেখা করার কোনো বিকল্প নেই।’
ওএস।