দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আছে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থা যদি আমরা লক্ষ্য করি, তাহলে দেখা যাবে বছরে দুইবার ঋতু পরিবর্তনের সময় অথবা মৌসুমি বায়ু দিক পরিবর্তনের সময় বঙ্গোপসাগরে কিংবা আরও গভীরে মহাসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। এই নিম্নচাপটি ধীরে ধীরে উত্তরে এগোয়। এটি উত্তর-পশিমে, উত্তর-পূর্বে যেতে পারে, সরাসরি উত্তরেও যেতে পারে। উত্তর-পশ্চিম হলে ভারতের উপকূলে আঘাত হানে। উত্তর-পূর্ব হলে মায়ানমারে আঘাত হানে। সরাসরি উত্তর কিংবা উত্তর-পশ্চিম কোনায় হলে বাংলাদেশে আঘাত হানে।
এটি কোন দিকে যাবে, বাতাসের চাপের দিক থেকে যেদিকে নিম্নচাপটি গতি বাড়ায় সেদিকে ঘূর্ণিঝড়টি রওনা দেয়। বছরের এই দুই সময়ে যদি সমুদ্রের পানির উত্তাপ ২৭ শতাংশ থাকে, তখন নিম্নচাপটি সমুদ্র থেকে প্রচুর শক্তি সঞ্চয় করে। মনে রাখতে হবে, নিম্নচাপটি ঘনীভূত হয়েছে বলতে চারদিক থেকে বাতাস ধাবিত হচ্ছে, সমুদ্রের পানির উচ্চতা উপরে উঠছে। জোয়ার অস্বাভাবিক মাত্রায় হচ্ছে এবং ভাটাও অস্বাভাবিক মাত্রায় নিচে নেমে যাচ্ছে। এটি বলা যেতে পারে ভারতের দক্ষিণ এটি বলা যেতে পারে এটি ভারতের একেবারে দক্ষিণ কোনা থেকে মধ্যখানে বাংলাদেশ হয়ে মায়ানমারের দক্ষিণ পর্যন্ত যেকোনো জায়গায় আঘাত করতে পারে এবং নির্ভর করে বাতাসের গতিবেগের উপরে। এর শক্তি নির্ভর করে সমুদ্র থেকে কতটা শক্তি সে গ্রহণ করল। আমরা অনেক সময় দেখি নিম্নচাপটি উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং তারপর কোনদিকে থেমে আছে। যখন সে থেমে থাকে তখন সে আরও বেশি শক্তি সঞ্চয় করে।
এবারে মোখার কথা যদি বলি, ১০ থেকে ১২ দিন আগে থেকেই নিম্নচাপের কথা বলা হয়েছে। মহাকাশে যে ভূ-উপগ্রহগুলো আছে, সেগুলো থেকে ভূপৃষ্টে বা সমুদ্রপৃষ্ঠে ঘূর্ণিঝড়টি কতদূর নাগাদ শক্তিশালী হবে। সে অনুযায়ী সবগুলো পূর্বাভাস মোটামুটি সঠিক। তবে বলা বাহুল্য এই পূর্বাভাস কখনো অঙ্ক করে চলে না। দিক পরিবর্তন করে। কাজেই হয়তো একটি আনুমানিক দিক নির্দেশনা দেওয়া যায়।
এটি গেল বিজ্ঞানের ব্যাপার। মানুষকে যে পূর্বাভাস দেওয়া হবে, তাদেরকে যে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, এটি কিন্তু মানুষেরই ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনায় আমি মনে করি অনেক গোলমাল আছে, অনেক উন্নতি করার ব্যাপার আছে। প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের আবহাওয়া দপ্তর পরিচালিত হয় সামরিক বিভাগের অধীনে অর্থাৎ মিনিস্ট্রি অফ ডিফেন্স। তারা নিয়ম কানুন সুক্ষ্মভাবে মেনে চলেন। কিন্তু পূর্বাভাসতো আর সূক্ষ্মভাবে মেনে চলবে না। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, পূর্বাভাস ১০০/১৫০ বছর আগে সমুদ্র জাহাজ চলাচলের জন্য প্রণীত হয়েছিল যেন জাহাজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এই সমুদ্রগামী জাহাজকে মাছধরার ট্রলারকে আবহাওয়ার সতর্ক সংকেত দিলেতো আর কাজ হবে না। তাদের জন্য প্রয়োজন আছে। কিন্তু উপকূলে লক্ষ লক্ষ মানুষ বসবাস করে। তাদের জন্য পূর্বাভাসটুকু দিতে হবে।
আমাদের দেশে ১ থেকে ১১ আমি পুনরায় বলছি, ১ থেকে ১১ এর যে সতর্ক সংকেত এটি জাহাজের ক্যাপ্টেনের জন্য দেওয়া হয়। মানুষের জন্য দেওয়া হয় না। বাংলাদেশের ৪টি বন্দর অর্থাৎ মংলা বন্দর পায়রা বন্দর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দর এই চারটি বন্দরকে কেন্দ্র করে দেওয়া হয়। এর আগের ঘুর্ণিঝড়গুলো যদি আমরা দেখি, সতর্ক সংকেতগুলো বেশ গোলমেলে ছিল। তবে আমি বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। কক্সবাজারকে ১০ নম্বর সতর্ক সংকেত দিয়েছে। মংলা ও চট্টগ্রামকে ৮ নম্বর কিন্তু ঘূর্ণিঝড় চলে গেল মায়ানমারের দিকে। ঘূর্নিঝড়ের ১০ নম্বরে আমি ভুল ধরছি না। কিন্তু এটিতো জাহাজের ক্যাপ্টেনকে দেওয়া হলো। এর সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসের খবরটুকু পরিষ্কার হতে হবে। কোন এলাকাতে জলোচ্ছ্বাস হবে, জলোচ্ছ্বাস কখন ল্যন্ড ফল করবে, এটি জানা দরকার। ভরা কাটালের সময় জলোচ্ছ্বাস আসে, পূর্ণ জোয়ারের সময় জলোচ্ছ্বাস আসে, তাহলে মহাবিপদ। ভাটার সময় যদি জলোচ্ছ্বাস আসে প্রভাবটা অনেক কম হয়। তাহলে বাতাসের গতিবেগ নিয়ে আমাদের এক ধরনের ভাবনা হবে।
জলোচ্ছ্বাসের বিষয় নিয়ে আরেক ধরনের ভাবনা হবে। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার যে স্ট্যন্ডিং অর্ডার আছে, সে অনুযায়ী সঠিক হলেও সঠিক সংকেত যে সবসময় সঠিক কাজ করবে তা কিন্তু নয়। এই সংকেতগুলো সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে দিতে হবে।
এর পরের কথা হচ্ছে আশ্রয় ব্যবস্থাপনা। ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত ব্যবহারের পরে আমাদের আশ্রয় ব্যবস্থাপনায় যাওয়ার কথা। খবরের কাগজে আমরা যতটকু দেখতে পাচ্ছি, অনলাইন অথবা ইন্টারনেটে যতটুকু দেখতে পেয়েছি, মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে চায়নি। তারা তাদের গুদাম বাড়িঘর ফেলে যেতে চায় না। আশ্রয় কেন্দ্রগুলো সব জায়গায় পর্যাপ্ত নয়। তা ছাড়া, প্রশ্ন হচ্ছে আশ্রয় কেন্দ্রে কখন যাব? ঘূর্ণিঝড় কখন আঘাত হানতে পারে? যেমন সতর্ক সংকেত অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে সম্ভাব্য সময়ের ১২/১৩ ঘণ্টা পরে। বিভিন্ন দেশে আমরা দেখি এরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় আঘাত করে। তারপর ৪/৫ ঘণ্টা খবর নেই। আমি মনে করি, আজকের সময়ে এটি পর্যাপ্ত নয়। ভারত যদি এটি ঘন ঘন করে আপডেট দেখাতে পারে, তাহলে আমাদের এখানে হবে না কেন?
আমি মনে করি, এখানে আমাদের একটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আছে। আমাদের সকল দফতরগুলোতে একজন মহাপরিচালক নেতৃত্ব দেন। আবহাওয়া দপ্তরে কিন্তু একজন পরিচালক নেতৃত্ব দেন। মহাপরিচালক নেই এবং এটি বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের জন্য সঠিক হতে পারে। আমার কথা হচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। বছরে কখনো একবার কখনো দুবার তিনবার হচ্ছে, এখন থেকে ১০/১৫ বছর পরে এর সংখ্যা আরও বাড়তে থাকবে। প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে। এই অদ্ভুত সতর্কতা সংকেত পদ্ধতি বদলাতে হবে। সতর্ক সংকেতগুলোতে সম্ভাব্য আক্রান্ত এলাকাগুলো দেখাতে হবে। এখন থেকে ঘূর্নিঝড়কে অর্থাৎ প্রাকৃতিক দূর্যোগগুলোকে মনে রেখে সম্পূর্ণ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর জন্য এখন থেকেই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ড. আইনুন নিশাত: ইমেরিটাস অধ্যাপক, সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়