বাংলা নববর্ষের অর্থনীতি
বাংলা নববর্ষকে ঘিরে সকল উদযাপনের মূল কথা বাঙালির আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান এবং অসাম্প্রদায়িকতার মর্মবাণী তুলে ধরা। করোনার আক্রমণের আগের বছরগুলোতে নগরে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ব্যপ্তি বেশ বাড়ছিল। পার্কে-উদ্যানে, পাড়ায় মহল্লায়, হাতিরঝিলে, রবীন্দ্র সরোবরে নানা অনুষ্ঠানে বিশেষ করে তরুণরা বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেবার যেন প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিল।
সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসি বাঙালিরাও বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাংলাদেশ তৈরি করার আনন্দে মেতেছিল। কিন্তু কভিড-১৯ হঠাৎ করে বাঙালির এই আনন্দযজ্ঞে বাধ সাধে। তাদেরকে ঘরবন্দি করে ফেলে। আর অসময়ে প্রাণ ঝরে যাবার আশঙ্কা তো ছিলোই। তবে বিজ্ঞানের কৃপায় দ্রুত টিকা আবিষ্কারের ফলে মানবজাতি এই যাত্রায় রক্ষা পায়। পর্যটন শিল্প আবার মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। বিদেশে থাকা ছেলে-মেয়েরা দেশে ফিরে আসছে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে আসছে এবারের বাংলা নববর্ষ। নিঃসন্দেহে সময় অনেকটাই বদলে গেছে। তাই এবারের বাংলা নববর্ষ উদযাপনেও নতুন নতুন ফ্যাশন পণ্য ও সাংস্কৃতিক আয়োজন লক্ষ করা যাবে বলে আশা করা যায়।
আর উৎসবের এই রকমফের বাঙালির ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতিতেও নতুন নতুন প্রভাব নিশ্চয় ফেলবে। তবে সম্প্রতি বঙ্গবাজার পুড়ে যাবার কারণে অনেক ক্ষুদে ব্যবসায়ীর পুঁজি ও স্বপ্ন দুইই পুড়ে গেছে। প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মতো কর্মীর আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এরা ঈদের বাজারে খুবই সক্রিয় থাকার কথা ছিল। তাই এই ঈদে তাদের আনন্দ উঠে গেছে। তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অন্যান্যদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
নিঃসন্দেহে আমাদের সাংস্কৃতিক লড়াই-এ পয়লা বৈশাখ বরণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু সেই ইতিহাস আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। এর শুরুটা এমন এক সময়ে হয়েছিল যখন নিজেদের বাঙালি হিসেবে দাবি করাটাই সাহসের কাজ ছিল। ১৯৬১ সালে একদিকে পাকিস্তান আমলের দমবন্ধ পরিবেশ, আর অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলনের মধ্যেই এসেছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ। স্বৈরাচারি ও গণবিরোধী পাকিস্তান সরকার অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে এই উদযাপনের উপর। এর প্রতিবাদে গণমুখী আঙ্গিকে সুর ও সংগীতকে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই), আহমেদুর রহমান (‘ভিমরুল’) সহ আরও অনেকেই সম্মিলিত উদ্যোগ নেন। এভাবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। মূলত ছায়ানট সংগঠকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক, হাইকোর্টের বিচারপতি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক গুণীজনেরা ঐক্যবদ্ধভাবে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে এগিয়ে আসেন। ‘আমরা রবীন্দ্র সংগীত গাইবই’ বলে সেদিন জোর সংকল্প প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। একই সঙ্গে তিনি নজরুলকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপনেরও বিরুদ্ধে ছিলেন। আর সে কারণেই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রবোধ মিলে মিশে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পোক্ত করা সম্ভব হয়েছিল পাকিস্তানি সেই আঁধার যুগেও। তবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার ধারা-বিবরণীটি ঠিক সেভাবে আমাদের সন্তানদের বলে উঠতে পারিনি আমরা। তাই বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন নির্মাণের রাজনৈতিক যুদ্ধের ভিত গড়তে, সংস্কৃতি কর্মীরা, বিশেষ করে ‘ছায়ানট’ সংগঠক ও কর্মীদের অবিস্মরণীয় ভূমিকা আজকের তরুণ প্রজন্মকে জানানোর প্রয়োজন রয়েছে। সুর দিয়ে মানুষের মনের গভীরতর স্বপ্নকে প্রভাবিত করার এই প্রচেষ্টাকে আরও সক্রিয় করার অভিপ্রায়েই ১৯৬৭ সালে রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেন ছায়ানট সংগঠকরা। প্রয়াত ড. নওয়াজেশ আহমদ ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক একজন বিজ্ঞানী। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এক স্মারক বক্তৃতায় (২০০৭) তিনি বলেছিলেন কীভাবে রমনা বটমূলের পয়লা বৈশাখের সূত্রপাত হয়। সন্জীদা আপার মুখেও এ কথা বহুবার শুনেছি। ড. নওয়াজেশ সেদিন বলেন, ‘১৯৬৭ সনে ওয়াহিদুল এবং সন্জীদা আমাকে বলল, ‘এবার আমরা বাংলা নববর্ষ বাইরে করব। তুমি একটা গাছ দ্যাখো’। আমার উপর ভার দিল ওয়াহিদুল। আমি ওয়াহিদুলকে রমনা বটমূলের কথা বললাম।’
রমনা বটমূলে আজ যেখানে অনুষ্ঠান হয় সেটা আসলে বট নয়। অশ্বত্থ। আমরা বট বলেই চালিযে দিয়েছিলাম। জায়গাটা এখন যেমন তখন তেমনটা ছিল না। চারদিকে শুধু জঙ্গল আর ঘাসে ভর্তি। তবু আমি ওয়াহিদুলকে বললাম জায়গটা কিন্তু খুব শান্ত। কোলাহলমুক্ত। ছায়ানটের ছেলে-মেয়েদের ভালোই লাগবে। ও রাজি হয়ে গেল। সারারাত আলো জ্বেলে ছায়ানটের কর্মীরা সেই ঘাস কাটল, জঙ্গল পরিষ্কার করল। এভাবেই ছায়ানটের বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন শুরু হলো। আজ এই অনুষ্ঠান যে জাতীয় পর্যায়ে চলে গেছে তাতে আমার খুব ভালো লাগে।’ (দেখুন, আতিউর রহমান, রবীন্দ্রসাধক ওয়াহিদুল হক, দিপ্তী প্রকাশনী ২০১১, পৃ. ৩১১)। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। রমনা বটমূলের এই নববর্ষ উদ্যাপন এখন সারা দেশ এবং বাঙালি অধ্যুষিত বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ বাঙালি বাংলা নববর্ষে পথে নেমে পড়ে। নুতন জামা-কাপড় পড়ে এক উজ্জ্বল সকালে তাদের আনন্দঘন উপস্থিতি বাঙালির অস্তিত্বের জানান দেয়। পাশাপাশি চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের এক অসাধরণ অগ্রযাত্রার প্রতীক বাঙালির এসব আয়োজন।
তাই করোনা-পরবর্তীকালে বাংলা নববর্ষের পুরোদমে উদযাপন নিশ্চয়ই আবারও আমাদের সাহস জোগাবে আগামীর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে এগুনোর জন্য। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে নববর্ষের এই উদযাপনের সাংস্কৃতিক গুরুত্বের পাশাপাশি রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্বও। ভেবে দেখুন এই সর্বজনীন সাংস্কৃতিক উদযাপনকে কেন্দ্র করে করোনাজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থায় ঝিমিয়ে পড়া খাতগুলোতে গতি সঞ্চার করে অর্থনীতির জন্য কতোটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বাঙালির এই সর্বজনিন উৎসব। মধ্য ও উচ্চ বিত্তের কথা না হয় নাই বা বললাম, শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ যারা, ধরা যাক গার্মেন্ট শ্রমিকদের কথা, তারা সকলেই কিন্তু পরিবারের জন্য নববর্ষ উপলক্ষে কিছু কেনাকাটা করেছেন। লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টস কন্যারা নতুন শাড়ি কিনছেন। তরুণরাও নতুন রঙিন পোষাক কিনছেন। ফল কেনার হিড়িক পড়ে যায় নববর্ষের ভোরে। ফ্যাশনের এই জোয়ারের বিরাট প্রভাব পড়ছে আমাদের অর্থনীতিতে। উৎসবের এই অর্থনীতি পাশ্চাত্যের বড় দিনের অর্থনীতির মতোই দিন দিন বাঙালির মনে ঠাঁই করে নিচ্ছে। এই উৎসবে কয়েক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হওয়ার কথা। গ্রামেও তো এখন সেবাখাতের ব্যাপ্তি বিরাট। গ্রামীণ আয়ের ষাট শতাংশই আসছে অ-কৃষি খাত থেকে। কাজেই নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামের অ-কৃষি খাতের উদ্যোক্তারাও বাড়তি বেচাকেনার মুখ দেখবেন। দেশব্যাপী টাকার এই লেনদেনের ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মীদেরও আয়-রোজগার বাড়বে। তাদের জন্য নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির চাপ মোকাবিলা কিছুটা হলেও সহজতর তো হবেই। করোনার দুর্দশা কাটিয়ে দুই বছর বাদে পুরো মাত্রায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন অর্থনীতির জন্য সুখবরই বটে।
দশ-পনেরো বছর আগেও পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে পোশাক কেনা অত বেশি ছিল না। কিন্তু করোনা আসার আগে আগে ২০১৯ সালের পয়লা বৈশাখকে ঘিরে পনেরো হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি। এই পোশাক কিন্তু কেবল বিপণি বিতানে বিক্রি হয়েছে এমনটি নয়। বরং ফুটপাতের বিক্রেতাসহ অনানুষ্ঠানিক বিক্রয়কেন্দ্র থেকেও এর একটি বড় অংশ বিক্রি হয়েছে। ২০১৯ সালের আগের হিসাব বলছে এই বিক্রির পরিমাণ বছরে গড়ে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। করোনাকালে এই প্রবৃদ্ধি নিশ্চয়ই ধাক্কা খেয়েছিল। তবে গত বছরের নববর্ষে আমরা পুরোপুরি আগের ধারায় ফিরে আসার পথ খুজে পেয়েছি। এর আবার দুই বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পোশাক এবং ভোগ্যপণ্য বিক্রি বাড়তে দেখেছি গত বছর। এ বছর নিশ্চয় বিকিকিনির হার আরও বাড়বে। তবে মূল্যস্ফীতি বাড়ন্ত বলে সাধারণ মানুষের কেনাকাটার পরিমাণ যতোটা আশা করা গিয়েছিল ততটা হয়তো হবে না। তবে অর্থনীতি মোটেও ঝিমিয়ে পড়েনি। এখনো বেশ সচল। সবল। ফলে অর্থনীতির গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় বাংলা নববর্ষের এই সময়টা যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
ড. আতিউর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর