নববর্ষের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটি ঘরে
পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। দিনটি বাংলাদেশে নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন উৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুল-ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপন করা হয় নববর্ষ।
বর্ষবরণের চমকপ্রদ ও জমজমাট আয়োজন ঘটে রাজধানী ঢাকায়। এখানে বৈশাখী উৎসবের অনুষ্ঠানমালা যেন এক মিলন মেলার সৃষ্টি করে। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে রমনা উদ্যান ও এর চারপাশের এলাকায় উচ্ছল জনস্রোতে সৃষ্টি হয় জাতীয় বন্ধন। ছায়ানটের উদ্যোগে জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’-এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়। আমরা জানি, ১৩৭২ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫) ছায়ানট প্রথম এ উৎসব শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলার প্রভাতী অনুষ্ঠানেও নববর্ষকে সম্ভাষণ জানানো হয়। এখানকার চারুশিল্পীদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নববর্ষের আহ্বানকে করে তোলে নয়নমনোহর এবং গভীর আবেদনময়। এ শোভাযাত্রা উপভোগ করে সব শ্রেণির আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। এদিন শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ, টি.এস.সি ও চারুকলাসহ সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাদের পুরোনো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তারা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়।
বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ছায়ানট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বি.এস.সি.আই.সি), নজরুল একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। সেসব কর্মসূচিতে থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, বর্ণাঢ্য মিছিল, বৈশাখী মেলা ইত্যাদি। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন পহেলা বৈশাখের উপর বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে। এ ছাড়া সংবাদপত্রগুলোতে বঙ্গাব্দ, নববর্ষ ও বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধসহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়।
সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনেও পহেলা বৈশাখ এক নতুন মাত্রা যোগ করে। তৎকালীন আইয়ুব সরকারের আমলে রবীন্দ্রসংগীত তথা বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার বিরোধিতার প্রতিবাদস্বরূপই বৈশাখের প্রথম দিনে ছায়ানট রমনার বটমূলে নববর্ষ পালনের আয়োজন করে। পরে ক্রমশই এ অনুষ্ঠান বিপুল জনসমর্থন লাভ করে এবং স্বাধীকার আন্দোলনের চেতনায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নীতির বিরুদ্ধে ও বাঙালি আদর্শের লালনে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় বাংলা নববর্ষ পালিত হতে থাকে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সংস্কৃতি অঙ্গনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়। বর্তমানে বাংলা নববর্ষ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
পুরোনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ উপলক্ষে পাহাড়িরা বর্ষবরণ উৎসব সেই আদিকাল থেকে পালন করে আসছে। এ উৎসব উপলক্ষে পাহাড়িদের বিভিন্ন খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আদিবাসী মেলার আয়োজন করা হয়।
নববর্ষের দিন মারমা উপজাতীয়রা আয়োজন করে ঐতিহ্যবাহী ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা পানি খেলা। পানিকে পবিত্রতার প্রতীক ধরে নিয়ে মারমারা তরুণ-তরুণীদের পানি ছিটিয়ে পবিত্র ও শুদ্ধ করে নেয়। পাহাড়িদের মধ্যে পানি উৎসবটি অত্যন্ত জনপ্রিয়।
নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত নববর্ষে তারা বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করে এবং সকালে স্নানাদি সেরে পূত-পবিত্র হয়। এ দিনটিতে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করে। নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি-পিঠা-পায়েসসহ নানা রকম লোকজ খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়। একে অপরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে। প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার মাধ্যমেও নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়, যা শহরাঞ্চলেও এখন বহুল প্রচলিত।
এই যে বৈশাখী আয়োজনে অসংখ্য মানুষের সমাগম দেখেই আমরা বুঝতে পারি বাঙালি জাতির ঐতিহ্যময় আয়োজনটি আমাদের কত প্রিয় এবং শুধু ঢাকায় নয়,সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় এই আয়োজন থাকে। নতুন বছরের শুরুতে এই আনন্দ আয়োজন কিন্তু আমাদের সারা বছরই শক্তি যোগায়। এ সকলই আমাদের সুসংস্কৃতিবান হতে সাহায্য করে।
ফেরদৌসি মজুমদার, নাট্যব্যক্তিত্ব
এসএন