যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন বর্বরতার সাক্ষী। বাংলাদেশের জনগণের জনগোষ্ঠীর উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও অসংখ্য নারীর উপর পাশবিকতাই শুধু নয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের রাস্তাঘাট শিল্প-কলকারখানা, আবাদি জমির ফসল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা বোমা মেরে ও আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল। বিজয়ের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পিত কায়দায় নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। স্বাধীন হলেও একটি জাতির জন্য মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য যা যা করা দরকার সবই করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর কুলাঙ্গার রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। যুদ্ধবিধ্বস্ত এক ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠন এর কাছে ছিল খুবই একটি দূরূহ ব্যাপার। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন থেকে দিল্লীতে যাত্রা বিরতি দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেন। দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু নিজেকে দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন এবং এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের এক বিরাট চ্যালেঞ্জে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেশের ভেতর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির নানা ষড়যন্ত্র এবং বামপন্থীদের নানারকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু সফলভাবে বাংলাদেশের পুনর্গঠনের কাজটি করেছিলেন তাঁর সততা ও অসাধারণ দেশপ্রেমের কারণে । ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কালরাতে জাতির পিতা সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার না হলে বাংলাদেশে তাঁর হাত ধরেই বিশ্বের দরবারে অনেক আগেই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করতে পারত।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যে অবদান ও আত্মত্যাগ রেখেছেন তা অবিস্মরণীয়, একজন বিশ্বনন্দিত নেতা হিসেবে পরম মমতায় একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার জন্য নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু দেশ স্বাধীন করেই ক্ষান্ত হননি, সদ্য স্বাধীন-সার্বভৌম যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে তিনি বৃহৎ কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে আলোকিত নেতৃত্ব দেন, পালন করেন আরেক ঐতিহাসিক মহান দায়িত্ব। স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু যে সংগ্রাম করেছিলেন, যে ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করেছিলেন তা ইতিহাসের পাতায় সেইভাবে প্রতিভাত হয়নি। তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো সময় (১২.০১.১৯৭২ থেকে ১৪.০৮.১৯৭৫ পর্যন্তÍ) বাংলাদেশের সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলেন। এই স্বল্পতম সময়ে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পরম মমতায় ও নিরলস প্রচেষ্টায় পুনর্গঠন করতে তিনি সক্ষম হয়েছেলিন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর বাস্তবায়িত সংস্কার কর্মসূচিগুলো ও নানা উদ্যোগের প্রতি আলোকপাত করলে আমরা এই মহান নেতার রাষ্ট্রনায়কোচিত নানা কৃতিত্বের কথা জানতে পারব, জানতে পারব বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদানের কথা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি প্রথম প্রহরে। মুক্তিলাভের পর লন্ডন হয়ে দিল্লীর যাত্রা বিরতি শেষে ১০ই জানুয়ারি বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেকটি আলোকিত অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বতঃস্ফূর্ত গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে দিল্লী থেকে বৃটিশ এয়ার ওয়েজের কমেট বিমানটি (ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে) বেলা ১.৪১ মিনিটে যখন তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌঁছায়, তখন বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স পরিণত হয়েছে এক জনসমুদ্রে যা কেবলমাত্র ৭ মার্চে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের জনসমুদ্রের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। রেসকোর্সের জনসভায় তিনি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়লেন, দুই চোখ গড়িয়ে পড়েছিল বহুবার অশ্রু। অশ্রুসজল তাঁর এ ভাষণটিতে আবেগের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর ও আন্তÍর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি যে আহ্বান ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা ছিল বীরোচিত এক বিশ্ববরেণ্য নেতার ভাষণ ও স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের মহান অঙ্গীকার। বক্তৃতায় যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সবার সাহায্য সহযোগিতা চেয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি আশা করি, দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন, যে আমার রাস্তা নাই, ঘাট নাই, আমার জনগণের খাবার নাই, আমার মানুষ গৃহহারা, সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারী, তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো। মানবতার খাতিরে আমি তোমাদের কাছে সাহায্য চাই। দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। আমার বাংলাদেশকে তোমরা রিকোগনাইজ করো, জাতিসংঘে স্থান দাও। দিতে হবে উপায় নাই। দিতে হবে। আমরা হার মানব না, আমরা হার মানতে জানি না।” শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে সম্মিলিত উদ্যোগে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বারবার। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে রেসকোর্সের সেই ভাষণে আবেগ আপ্লুত বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম, ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এই স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, কর্মী বাহিনী তোমাদের মোবারকবাদ জানাই। তোমরা গেরিলা হয়েছো, তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।’
বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যখন ফিরে আসলেন দেখলেন ভয়াবহ এক ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজয়ের আঁচ করতে পেরে স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালিরা যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে এজন্য এদেশের বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, গ্রাম্য হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস ভবন এবং সড়ক ও রেলপথ ধ্বংস করে দেয়। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের সময় গোটা বাংলাদেশ ছিল এক যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ড। বাংলাদেশের গুদামে খাদ্য নেই, মাঠে ফসল নেই, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ শূন্য, সড়ক ও রেলপথ বিচ্ছিন্ন, নৌ ও সমুন্দ্রবন্দরগুলো বিধ্বস্ত, স্কুল-কলেজগুলো ছিল পরিত্যক্ত সেনাছাউনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও পিস কমিটির সদস্যদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসে সারা বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ এবং ভয়াবহতা এখানে বলে শেষ করা যাবে না। এ বিষয়ে মুজিবনগর সরকার ও বঙ্গবন্ধুর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচটি ইমামের লেখা বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-'৭৫ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে একটি মন্তÍব্য এখানে তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন ‘পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশকে এক ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, সারাদেশের মানুষজনের হাতে তখন মাত্র চার কোটি টাকার মতো ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার কোনো মজুদ বাংলাদেশ ব্যাংকে ছিল না। [...] মাত্র ১০ হাজারের মতো নথি দিয়ে শুরু হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়। বঙ্গবন্ধু যেদিন টেলিফোনে কথা বলতে শুরু করেন সেদিন ঢাকা জেলা থেকে মাত্র তিনটি জেলার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল।’
দেশে ফিরেই অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সরকার পদ্ধতি নির্ধারণে মনোনিবেশ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে প্রবাসে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার গঠনের সময়ই বঙ্গবন্ধু ঐ সরকারের প্রেসিডেন্ট মনোনীত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাঁর অনুপস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধু সেই পদে বহাল ছিলেন। এই সরকারই পরবর্তীতে ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে আনুষ্টানিকভাবে শপথ নিয়েছিল যা ইতিহাসে মুজিবনগর সরকার নামে অভিহিত। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোয় বঙ্গবন্ধু সর্বদাই সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবেই নিজ মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর প্রত্যাবর্তনের ১ দিন পরেই ১১ই জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশের সাময়িক সংবিধান আদেশ-১৯৭২ জারি করা হয়। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান আইনসভার জন্য নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি তারিখে তিনি নতুন রাষ্ট্রের প্রথম সংসদ গঠন করেন। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐদিনই (১১.১.৭২ তারিখ রাতে) বঙ্গবন্ধুর এক আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২ জানুযারি সংসদীয় সরকার কাঠামোর অধীনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে বঙ্গবন্ধু সেই রাষ্ট্রপতির অধীনেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এর আগে স্বাধীন দেশে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সরকার প্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে সংসদীয় গনতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়।
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সময় দক্ষ জনবলের অভাব পূরণ করা, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভেঙে যাওয়া প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন করা এবং সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়া অর্থনৈতিক, শিক্ষা, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতের ভিত মজবুত করা বঙ্গবন্ধুর সরকারের জন্য ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। এমন এক চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের সে দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেন এবং বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়ে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্ঠায় মনোযোগ দেন ও আন্তÍর্জাতিক সাহায্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র এক বছরের মধ্যে শেখ মুজিব দেশ পুনর্গঠনের জন্য যেসকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় সেগুলোকে চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনাসহ উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি হাতে নেন।
বঙ্গবন্ধু সরকারের শাসনামলের উল্লেখযোগ্য কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ যার মাধ্যমে যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তিমূল রচিত হয় এবং যার সুফল বাংলাদেশের মানুষ এখনো ভোগ করে চলেছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিম্নে তুলে ধরা হলো।
ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার: আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদানকারী ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় সোয়া লক্ষ ভারতীয় সৈন্যকে ভারতে ফেরত পাঠানোর মতো একটি দুরুহ ও একটি কঠিন কাজ বঙ্গবন্ধু হাতে নেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের কিছুদিনের মাথায়। বঙ্গবন্ধু সেই কাজটি করেন দৃঢ়চিত্তে ও সুচারুরূপে। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ভারত সফরে গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মিটিং করেন। এর সূত্র ধরে ঘোষণা আসে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চের আগে বাংলাদেশ ত্যাগ করবে। পরে অবশ্য ২৫ মার্চকে ডেডলাইন হিসেবে নেয়া হয়। তবে ১৫ই মার্চের আগেই ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের কাজ সম্পন্ন হয়। দেশ মুক্ত হওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের সে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু। এমন নজির পৃথিবীর সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল। এ ক্ষেত্রে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অবদানও স্মরণীয়।
এক কোটি শরণার্থীকে বাংলাদেশে পুনর্বাসণ: নব নির্বাচিত মুজিব সরকার গুরুতর কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, যার মধ্যে ছিল, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দেশ ছেড়ে ভারতের সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া ১০ মিলিয়নের অধিক শরণার্থীর পুনর্বাসণ, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা উপকরণ সরবরাহ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়াবলি। এ ছাড়া, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এবং যুদ্ধের ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও চরমভাবে ভেঙে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো, বিধ্বস্ত দেশের যুদ্ধাক্রান্ত নাগরিক এবং ভারতের সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ শরনার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসে তাদের পুনর্বাসণ ও অবকাঠামো পূননির্মাণসহ আর্থিক, শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ পুনরুজ্জীবন করা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় বলেছেন, ছয় সপ্তাহের স্বল্প সময়ে সাত মিলিয়নের অধিক শরণার্থীকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে হবে। যথারীতি সেটা করা হয়েছে। এ রকম বিপুল জনসংখ্যার ত্রাণ ও পুনর্বাসণ নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক কাজ। তবে জাতিসংঘের সহযোগিতায় এই দুঃসাহসিক কাজই দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকার। বঙ্গবন্ধুর সফল প্রচেষ্টার কারণে জাতিসংঘ যুদ্ধ-বিধ্বস্ত পরবর্তী বাংলাদেশ পুনঃগঠনের সহায়তার জন্য ৪১১ কোটি টাকা প্রদানের ঘোষণা প্রদান করেছিল। ভারত সরকার সে সময় বাংলাদেশকে ত্রাণ ও পুনর্বাসণ কাজের জন্য ২৫০ মিলিয়ন ডলার সহযোগিতা প্রদান করে। জাতিসংঘের ত্রাণ পরিচালনা কমিটি ১৯৭২ সালের এক প্রতিবেদনে যুদ্ধ পরবর্তী এক বছরের মাথায় দেশটিকে সুশৃঙ্খল ও গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার জন্য তৎকালীন সরকারকে ধন্যবাদ জানায়।
প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন ও সংবিধান প্রনয়ণ করা: ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে এসে সরকারের হাল ধরেছিলেন এবং দেশের সব কর্মকাণ্ড অতি দ্রুততম সময়ে সাংবিধানিক বিধিবিধানের আওতায় নিয়ে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজস্ব এবং দলের সমষ্টিগত ধ্যান-ধারণার আলোকে স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলারূপে গড়তে অসংখ্য উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে মূল ভিত্তি হিসেবে নিয়ে বাংলাদেশের সব সরকারি কর্মপরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। স্বাধীন দেশে একটি জাতীয় ও পূর্ণাঙ্গ সরকার কাঠামো গঠনের অত্যন্ত তাৎপর্যপূণ কাজটি বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও মেধার আলোকে দক্ষতার সাথে করতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বাধীন দেশের সরকার পরিচালনার জন্য নতুন প্রতিষ্ঠান গঠন, নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ, পূর্বে থেকে বিদ্যমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুনরেকত্রীকরণ এসব কিছুর ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু নিরলস পরিশ্রম করে একটি সুদূরপ্রসারী প্রশাসনিক কাঠামোর রুপরেখার গোড়াপত্তন করেছিলেন যার ফল আমরা এখনো ভোগ করছি। প্রশাসনিক কাঠামো সমন্বয়ের পরের কাজটি ছিল জাতীয় সংবিধান প্রণয়ন। শেখ মুজিব উনার অন্তর্র্বতী সংসদকে একটি নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব প্রদান করেন এবং চারটি মূলনীতি হিসেবে
‘জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র’ ঘোষণা করেন যা মুজিববাদ নামেও পরিচিত। মাত্র এক বছরের মধ্যে একটি সুলিখিত ও বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত সংবিধান তৈরি করে বঙ্গবন্ধু বিশ্বে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়ার পর সংবিধানের বিধিমতে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠন করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে পূর্ণমাত্রায় গতিবেগ সঞ্চার করে। বহুবিধ সমস্যা আইনের মাধ্যমে সমাধান করার প্রয়োজনীয়তার জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৬.১২.৭১ থেকে ১৫.১২.৭২ পর্যন্ত এক বছরে দেড়শত আইন প্রণয়ন করেন। এর মধ্যে ২৬টি আইন সংবিধানের মাধ্যমে রক্ষা করা করা হয়। তৎকালীন মার্কিন দূতাবাস যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে পাঠানো এক বিশেষ প্রতিবেদনে জানায় যে, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু সব কিছু তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কাজ করতে সক্ষম হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যেভাবে প্রশাসনকে পুনঃবিন্যাস করেন তাতে মনে হয়নি বাংলাদেশ মাত্র এক বছর আগে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
সফল পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ: অর্থনৈতিক খাতের বাইরে অন্যান্য চ্যালেঞ্জ ছিল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুশাসন এবং বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে কার্যকর কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে ভারতকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহারের কাজটি সম্পন্ন করার পর বঙ্গবন্ধু সরকার সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কার্যকর কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায় ও আন্তÍর্জাতিক সংস্থাসমূহের সদস্য পদলাভে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির ব্যাপারেও জাতির জনক সজাগ ছিলেন এবং এ ক্ষেত্রে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ বঙ্গবন্ধুর সফল নেতৃত্বে তাঁর সময়ে বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ গ্রুপ, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ, আইএলও , ডব্লিএইচও, আইএমএফ, ওআইসি (অর্গাইনেজশন অব ইসলামিক কনফারেন্স)-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য পদ লাভ করে এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধু সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত হয় ‘২৫ বছরমেয়াদি’ বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তি। বিশ্ব শান্তি পরিষদের উদ্যোগে ১৯৭৩ সালের ২৩শে মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়া শান্তিÍ সম্মেলন অনুষ্টিত হয় এবং গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তিতে অবদান রাখায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরী’ শান্তি পদকে ভূষিত করে। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের ১০ই মে তারিখে আন্তÍর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সংস্থার সদস্যপদ পায় এবং ১৯৭৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। ১৯৭৫ সালের ১৭ মে বাংলাদেশ বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার সদস্য পদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর দক্ষ কূটনৈতিক উদ্যোগের ফলে তার শাসনামলে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো সময়ে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে ১২১টি দেশের স্বীকৃতি এবং ১৪টি আন্তÍর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। এমনকি পাকিস্তানের স্বীকৃতিও আদায় করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭৪-এর ২৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় ভাষণ দান করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান ও মহত্তর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীন-স্বকিয়তার পরিচয় দেন, পরাশক্তির চোখ রাঙানি কিংবা আঞ্চলিক শক্তি কী ভাবছে তার দিকে তাকিয়ে তিনি পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেননি। ১৯৭৩ সালের মিসর-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু ইসলাম, আরব দেশ এবং ওআইসিকে সমর্থনে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা দেখাতে দ্বিধা করেননি। তার ব্যক্তিগত উদ্যোগেই তখন মিসর ও সিরিয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিকিৎসক দল ও চায়ের কার্টুন পাঠানো হয়েছিল। ওআইসির সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক এটা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে সদস্য হওয়ার আমন্ত্রন জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত ‘ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা’র শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন এবং এই শীর্ষ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সদস্যপদ লাভ করে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়নে যে সাফল্য এনেছেন, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে এখনো অদ্বিতীয় হয়ে আছে।
দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গণহত্যা, ধর্ষন ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত পাকিস্তানিদের দোসর দালাল বাঙালিদের বিচার শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি জারীকৃত বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের মাধ্যমে। মূল আইনে অপরাধের সংখ্যা ৬০টি নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের জুন মাসে প্রণীত সংশোধনীতে অপরাধের সংখ্যা বাড়িয়ে ৬৯টি স্থির করা হয়। এই আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তির সাজা ছিল মৃত্যুদণ্ড থেকে শুরু করে কমপক্ষে তিন বছরের কারাদণ্ড প্রদান। এই আইনের অধীনে ৩৭ হাজার ৪ শত ৭১ জন দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই দালালদের বিচারের জন্য সারা দেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে যা কিছু বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল তা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি সাজা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়া এবং ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন রহিত করা হয়। ফলে ৭১’র মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত অনেক যুদ্ধাপরাধীও জেল থেকে বেড়িয়ে আসে। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীসহ তাদের সহযোগী আলবদর ও রাজাকারদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে বিচার করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে শান্তিÍ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩ (আন্তÍর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আাইন) বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে ১৯৭৩ সালের ২০ই জুলাই জাতীয় সংসদে পাস হয়। এই আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট অপরাধের বিচার করার বিধান রয়েছে।
কৃষি সংস্কার ও কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়ন: মুক্তিযুদ্ধের সময় কৃষি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রন্তÍ হয়। এ খাতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী তার পরিমাণ সেই সময়ের টাকায় প্রায় ৩৭৯ কোটি ৫ লাখ। যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশে যাতে একজন মানুষও না খেয়ে মারা না যায়, সেজন্য নানা ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। খাদ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ভূর্তকি দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে পর ২২ লক্ষেরও বেশি কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসন করার যে দায়িত্ব বর্তেছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের উপর তা দক্ষতার সাথে পালন করা হয়। চাষাবাদের ক্ষেত্রে নতুন যান্ত্রিক পদ্ধতি প্রবর্তনের লক্ষ্য স্থির করেন। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষকের মাঝে সার, ওষুধপত্র ও উন্নতমানের বীজ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের শাসনামলে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ৭৮৬ কোটি টাকার প্রথম জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেন। এই বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয় শিক্ষা ও কৃষি খাতে। প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল যেখানে ৪০ কোটি টাকা সেখানে কৃষিখাতে বরাদ্দ রাখা হয় ১০৩ কোটি টাকা। যেহেতু ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮৫% ছিল কৃষক, সেই কৃষকের কল্যাণার্থে বঙ্গবন্ধু অনেকগুলো যুগান্তÍকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো-জমির সমস্ত বকেয়া খাজনা মওকুফসহ ২৫ বিঘা পর্যন্তÍ জমির খাজনা মওকুফ করেন এবং পরিবার পিছু-সর্বাধিক ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সিলিং নির্ধারণ করেন ও নতুন চর বিনামূল্যে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টন করা হয়।এ ছাড়া, তিনি কৃষকদের মধ্যে ৩০ কোটি টাকার কৃষি ঋণ বিতরণ করাসহ কৃষকদের মধ্যে বীজ, সার, গভীর ও অগভীর নলকূপ বিতরণ এবং ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসের মধ্যে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প পুর্নোদ্যমে চালুর ব্যবস্থা করেন । তাঁর উদ্যোগের ফলে ভারত থেকে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে শুকনো মওসুমে পদ্মা নদীতে ৫৪,০০০ কিউসেক পানি সরবরাহের নিশ্চয়তা লাভ করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু সরকারই সরকারিভাবে খাদ্য মওজুদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের মধ্যেই ১০০টি খাদ্য গুদাম নির্মাণ করে। নয় মাসব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান বাহিনী ও রাজাকার-আলবদর কর্তৃক লক্ষাধিক গুরু জবাই করে মাংস খাওয়ার ফলে হালচাষের জন্য গবাদি পশুর সংকট সৃষ্টি হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে গবাদি পশুর সংকট কাটিয়ে উঠতে বঙ্গবন্ধু সরকার কৃষকদের মধ্যে ১ লক্ষ বলদ ও ৫০ হাজার গাভী বিতরণ করে। গ্রাম বাংলার ঋণে জর্জরিত কৃষকদের মুক্তির জন্য তিনি “খাই-খালাসী আইন” পাশ করেন। বঙ্গবন্ধু গ্রাম বাংলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও শিল্প-কৃষি উৎপাদনের জন্য পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। এ প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে কৃষিবিষয়ক ইন্সটিটিউট এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে কৃষি সংক্রান্ত গবেষণা, পরিকল্পনা পরিচালনা, সমন্বয়, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে যাচ্ছে।
শিক্ষা সংস্কার ও শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়ন: শুধু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নেননি; এ জনসংখ্যাকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার পরিকল্পনাও নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেজন্য তিনি জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন এবং স্কুল ও কলেজগুলোকে জাতীয়করণ করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করেন। ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি সরকারি এক ঘোষণায় ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালের ছাত্র বেতন মওকুফ করা হয়। ১৯৭২ সালের ২০ই জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেন। শিক্ষার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু যে যুগান্তÍকারী পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করেন তা হলো- আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও পঞ্চম শ্রেণি পর্যস্ত সকল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পুস্তক বিতরণ করেন এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ঘোষণা করেন; সবচেয়ে যুগান্তÍকারী পদক্ষেপ হচ্ছে তিনি দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করেন, ১১,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ৪০,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেন। এর ফলে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি সরকারি হয়; ৯০০ কলেজ ভবন ও ৪০০ হাইস্কুল পুণনির্মাণ করেন; বঙ্গবন্ধু সরকার জাতিসংঘের সহায়তায় ৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করেন; দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৫ মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন যেই কমিশন নিষ্ঠার সাথে করে মাত্র ১ বছরের মধ্যে ১৯৭৩ সালের ৮ই জুন একটি অন্তবর্তীকালীন রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করেন এবং ১৯৭৪ সালের মে মাসে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করে। শিক্ষার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সরকারের আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে জাতীয় সংসদে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ করার মাধ্যমে ঢাকা, রাজশাহী, চট্রগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রথম বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের (৪০ কোটি টাকা) চেয়ে শিক্ষা খাতে (৪৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা) ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয় । ঐ বছর মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য ১.২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
শিল্প ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও শিল্প কল-কারখানা জাতীয়করণ: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলায় শিল্পক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪০ কোটি টাকার বেশি। কাঁচামাল, বস্তুগত অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি এ ধ্বংসলীলার শিকার হয়। সরকারি খাতের অন্তর্গত পাটশিল্প, শিপইয়ার্ড ও ডিজেল প্লান্ট ইত্যাদির পুনর্গঠন ও পুনর্র্নিমাণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। এ ছাড়া, বেসরকারি খাতের হাজার হাজার কুটিরশিল্প ধ্বংস হয়ে যায় যুদ্ধের ধ্বংসলীলায়। এ ক্ষতি পূরণের জন্য জাতির পিতা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রপাতি জোগানের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেন। তিনি ১৯৭২-৭৩ সালের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেন ৫৭৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা। বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালের ২৫শে মার্চ পাট, বস্ত্র, চিনিকল, ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয়করণের আইন পাশ করে। এই আইনের আওতায় ৬৭টি পাটকল, ৬৪টি বস্ত্রকল এবং ১৫টি চিনিকল জাতীয়করণ করা হয়। পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও চালু করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারীর কর্মসংস্থান করেন। বঙ্গবন্ধু ঘোড়াশাল সারকারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্পস্থাপন, বন্ধ শিল্পলকারখানা চালুকরণসহ অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলা করে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করে দেশকে ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার জোর প্রয়াস গ্রহণ করেন।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন: মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পরিবহন ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। পলায়নরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বন্দরের চ্যানেলে মাইন পুঁতে যাওয়ার কারণেও দেশের প্রধান এই সমুদ্র বন্দর ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। তারা আত্মসমর্পণের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নগদ টাকা ও মজুদ স্বর্ণ জ্বালিয়ে দেয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিরা প্রায় ৮শ’ কোটি টাকা সরিয়ে নেয়। এতে সদ্য স্বাধীন হওয়া এই দেশটি অর্থশূন্য হয়ে পড়ে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর অর্থনীতি প্রায় অচল হয়ে পড়ে। খাদ্যশস্য, শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল, কৃষিজাত দ্রব্য এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি ও বিতরণ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এমন এক পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংস্কার কাজে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তা হলো- প্রথম পাঁচশালা (১৯৭৩-৭৮) পরিকল্পনা গ্রহণ করেন; তিনি নতুন চারটি করর্পোরেশন গঠন করেন, যেমন: (ক) বাংলাদেশ জুট কর্পোরেশন (খ) বাংলাদেশ সুগার কর্পোরেশন(গ) বাংলাদেশ টেক্সটাইল কর্পোরেশন এবং (ঘ) বাংলাদেশ গ্যাস এ্যা- অয়েল কর্পোরেশন; তিনি বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা ও বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভিন্ন ব্যাংকের ১০৫০টি নতুন শাখা স্থাপন করেন; তিনি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে এর ৩৩৫টি শাখা স্থাপন করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য নতুন মুদ্রা চালু করেন।
অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে শক্তিশালী করতে শেখ মুজিব একটি বিস্তৃত পরিসরের জাতীয়করণ কার্যক্রম হাতে নেন। এর ফলে পর্যায়ক্রমে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে থাকে এবং দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশঙ্কাকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২ সালের ১৯ মে বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশ কনজুমার সাপ্লাইজ করপোরেশন অর্ডার ১৯৭২ জারি করে।
বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা: বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতেও তিনি গভীর গুরুত্ব দিয়েছেন। আণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য, খাদ্য, কৃষি, শিক্ষা, শিল্পসহ জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতকে সহায়তা করার কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে এ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান বর্তমানে দেশের বৃহত্তম বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণার উন্নয়ন, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও শিল্প প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর) গঠন করেন। শুরুতেই ঢাকায় কেন্দ্রীয় গবেষণাসহ চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে আঞ্চলিক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন।
যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদুৎ বিতরণ পুনরুদ্ধার: মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর অর্থনীতি প্রায় অচল হয়ে পড়ে। খাদ্যশস্য, শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল, কৃষিজাত দ্রব্য এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি ও বিতরণ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এমন এক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু পুনর্গঠন কাজে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বন্দরের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা, নৌপরিবহন উন্নয়ন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ নেন এবং বেসামরিক বিমান চলাচল শুরুর ওপর গুরুত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধু নিরলস পরিশ্রম করে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটান।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদুৎ বিতরণ পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে দেশের বড় বড় সেতু, বিদুৎ কেন্দ্র, টেলিফোন ভবন পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করেন যা ছিল দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়। পরবর্তী বছরগুলোতে সরকার হার্ডিঞ্জ ব্রীজ, তিস্তা ও ভৈরব রেলওয়ে ব্রীজ পুনঃনির্মাণ করে যানবাহনের জন্য খুলে দেয়। চট্রগ্রাম বন্দর থেকে মাইন ও ভাঙ্গা জাহাজ অপসারণ করে বন্দর চলাচলের যোগ্য করে তোলা হয়। বঙ্গবন্ধু একই সাথে যমুনা নদীর উপর ব্রীজ নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়েছিল। তিনি ১৯৭৪ সালের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত সকল ব্রীজ-সেতু পুনঃনির্মাণ করেন এবং অতিরিক্ত ৯৭টি নতুন সড়ক সেতু নির্মাণ করেন। শুধু তাই নয় ঢাকা-আরিচা রুটের বড় বড় সড়ক সেতুগুলো বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে নির্মিত হয়। সে সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত রেল সেতুগুলোও চালু করা হয়। যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা ছিল বঙ্গবন্ধুর এক বৈপ্লবিক প্রয়াস। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭২ সালে যমুনা নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয় এবং ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে এজন্য বরাদ্দ রাখা হয়। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ১৯৭৩ সালে যমুনা নদীর উপর একটি সড়ক-কাম-রেলসেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা-সমীক্ষা হাতে নেয়। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে গঠিত কমিশন ১৯৭৪ সালের ৪ নভেম্বর যমুনা সেতুর প্রাথমিক সম্ভাব্যতা রিপোর্ট প্রণয়ন করে। বঙ্গবন্ধুর সময়ে ১৯৭২ সালের ৭ই মার্চের মধ্যে আভ্যন্তনীন রুটে বিমান চালুর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আন্তÍর্জাতিক রুটেও একটি বোয়িং সংযোজিত হয় এবং ১৯৭৩ সালের ১৮ই জুন ঢাকা-লন্ডন রুটে বিমানের প্রথম ফ্লাইট চালু হয়। কুর্মিটোলার আন্তÍর্জাতিক বিমান বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন গঠিত হয়। এই শিপিং করপোরেশন ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বেেরর মধ্যেই কোস্টারসহ ১৪টি সমুদ্রগামী জাহাজ সংগ্রহ করে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীণ সময়ে সারা দেশে বিদ্যুৎ সাব স্টেশনগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। বহু স্থানে উৎপাদন, বিতরণ ও সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়, অনেকস্থানে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন ও বিদ্যুৎ পোলগুলো বিনষ্ট হয়েছিল। দ্রুত সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ট্রান্সমিশন ও বিতরণ লাইন নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে জোর দেন এবং ৪০০ ধ্বংসপ্রাপ্ত সাব-স্টেশন পুনঃনির্মাণ করেন। ৪০০ ধ্বংসপ্রাপ্ত সাবস্টেশন পুনঃনির্মাণে খরচ পড়েছে ৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা। তিনি ৫০০০ বিদ্যুৎ পোল আমদানী করেন এবং ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ১৫০০ কিমি বিদ্যুৎ স্থাপন করেন । তাঁর উদ্যোগের ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন ১৯৭২ সালে জানুয়ারিতে উৎপাদিত ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত থেকে ডিসেম্বরে ৫০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। তিনি খুলনা-রাজশাহী ও সিদ্ধিরগঞ্জে পাওয়ার স্টেশন পুনঃসংস্কার করেন এবং এই সংস্কারে ৮ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৩ সালে দেশব্যাপী পল্লী বিদ্যুৎ কর্মসূচি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের ক্ষেত্রে দ্রুত কৃতিত্ব অর্জন করে দেশের অর্থনৈতিক ভিতকে মজবুত করতে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখেন।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নয়ন: বঙ্গবন্ধু সরকার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে একটি শক্ত নীতিমালা, পরিকল্পনা, অবকাঠামো রেখে গেছেন। ১৯৭২ সালে ঢাকায় বড় হাসপাতাল বলতে ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ড. গাস্টের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত পঙ্গু হাসপাতাল এবং আরও বেশকিছু স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলামের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় একটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট করার উদ্যোগ নিলেন। শাহবাগ হোটেল সে সময় অনেকটা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। বঙ্গবন্ধু এই শাহবাগ হোটেলেই প্রতিষ্ঠা করলেন ইনস্টিটিউট অব পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ (আইপিজিএমআর), যাকে আমরা সবাই পিজি হাসপাতাল বলে জানি। এই পিজি হাসপাতালই এখন বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতনামা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় যার নাম এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএসএমএমইউ)। এ ছাড়া, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু সরকার আরো নানামূখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীনের পর ৭,৪৮২ জন ডাক্তার, ৮২১ জন নার্স ও ১০৯২ জন ধাত্রী নিয়োগ করা হয়। পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় যেখানে হাসপাতালে ৮,৫৪৯টি শয্যা ছিল, সেখানে স্বাধীন হবার পর ১২,৬০৬টি শয্যায় উন্নীত করা হয়। এ সময় কলেরা-বসন্তের প্রতিষেধক টিকা ৪,৩২,৩৭,০২০ জনকে দেওয়া হয়। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক থানা স্বাস্থ্য প্রকল্প গ্রহণ বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আজও স্বীকৃত।
সামরিক বাহিনী ও রক্ষীবাহিনী গঠন: স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষাকল্পে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য বিস্তৃত প্রকল্প গ্রহণ করেন। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিডিআর গড়ে ওঠে। ১৯৭২ সালের ৬ই মার্চ তিনি বিডিআর গঠনের আদেশ জারী করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ই এপ্রিল পদাতিক বাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশ জারী করেন। শেখ মুজিব খাদ্য ক্রয়ের পাশাপাশি বিদেশ থেকে সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও সামরিক সামগ্রী সংগ্রহ করেন। যুগোস্লাভিয়ায় সামরিক প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে পদাতিক বাহিনীর জন্য আনা হয় ক্ষুদ্র অস্ত্রশস্ত্র এবং সাজোঁয়া বাহিনীর জন্য ভারি অস্ত্র। ভারতের অনুদান ৩০ কোটি টাকায় সেনাবাহিনীর জন্য কেনা হয় কাপড় ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মিগ বিমান, হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমান সংগ্রহ করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের নিকট ১৯৭২ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার কাছ থেকে বিমানবাহিনীর জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সামরিক সাহায্যের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিমানবাহিনী ১২ টি মিগ-২১ বিমান সামরিক অনুদান হিসেবে গ্রহণ করে। এগুলো ছাড়াও আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের মধ্যে একটি এএন-২৪ বিমান, একটি ভিআইপি এমআই-৮ হেলিকপ্টার, ৪টি এমআই-৮ হেলিকপ্টার এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ, পি-১৫, পি-৩৫ এবং পিআরআইভি-১১ রাডার সংগ্রহ করা হয়। তিনি ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য থেকে বিমান বাহিনীর জন্য হেলিকপ্টার ক্রয় করেন। ১৯৭৪ সালের ১১ই মার্চ তিনি কুমিল্লায় বাংলাদেশের প্রথম সামরিক একাডেমী উদ্বোধন করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্মকা-ের স্বার্থে সশস্ত্রবাহিনীর সহযোগী আরেকটি নিরাপত্তাবাহিনীর প্রয়োজন থেকে বঙ্গবন্ধু সরকার একটি আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করেছিল। জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠনের জন্য ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ তারিখে জাতীয় রক্ষীবাহিনী আদেশ-১৯৭২ (রাষ্ট্রপতির ১৯৭২ সালের ২১ নং আদেশ) জারি করা হয় এবং ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এ আদেশ কার্যকর হয়। ক্যাপ্টেন এ. এন. এম. নূরুজ্জামানকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান করা হয়। রক্ষীবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল সেনাবাহিনীর ছয় ভাগের এক ভাগ। শুরুর দিকে রক্ষীবাহিনী বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও চোরাচালানের মালামাল উদ্ধার করে এবং মজুতদার ও কালোবাজারীদের কার্যকলাপ কিছুটা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে উপরোক্ত বৈপ্লবিক ও কল্যাণমূখী পদক্ষেপগুলো ছাড়াও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তিকে মজবুত করাসহ দেশকে মুক্তিযুদ্ধের আলোকিত ধারায় পরিচালিত করবে। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য গৃহনির্মাণের কাজে তিনি হাত দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তার দেশের একজন মানুষও যাতে গৃহহীন না থাকে। তাই তিনি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন। তাঁর আমলে ১০ লাখ বসতবাড়ি নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশ অবজারভারের প্রথম পাতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ই জানুয়ারি প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু ত্রাণ ও পুনর্বাসনকে অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন। দৈনিক বাংলার ১৯৭৫ সালের ২৬শে জানুয়ারি রিপোর্টে বলা হয়, গৃহহীন মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু ৩ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস ও অকেজো হয়েছিল তা সমাধানকল্পে বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই ৫৫,০০০ টেলিফোন চালুর ব্যবস্থা করেন। বহিঃবিশ্বের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ স্থাপনের জন্য বঙ্গবন্ধুর পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ সমাপ্ত করেন। বাংলাদেশর হাইকোর্টের কার্যক্রম নির্বাহের উদ্দেশ্যে সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ হাইকোর্ট আদেশ, ১৯৭২ জারি করেন। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ ১৩ মাসে ১০ কোটি টাকা তাকাবি ঋণ বণ্টন, ৫ কোটি টাকার সমবায় ঋণ প্রদান ও সরকার গঠনের তিনদিনের মধ্যেই (১৫.১১.১৯৭২) বঙ্গবন্ধু এক সরকারি আদেশের মাধ্যমে দেশে মদ, জুয়া, হাউজী ও ঘোড়-দৌড় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি একই সাথে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলেই রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করা হয় এবং জাতীয় প্রতীক প্রণয়ন করা হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানোর জন্য বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। ১৯৭২ সালের ৯ই মার্চ সাভার ও মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পাশাপাশি তিনি ১৯৭২ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকার মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন। পবিত্র ধর্ম ইসলামের অনুসারী বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। ইসলাম ধর্মের যথাযথ খেদমতের অভিপ্রায়ে ও ইসলাম সম্পর্কে গবেষণার লক্ষে ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার জন্য এক অধ্যাদেশ জারি করেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্মচর্চার ক্ষেত্রেও তিনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে দেশে এনে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। বঙ্গবন্ধু দুস্থ মহিলাদের কল্যাণের জন্য ১৯৭২ সালে নারী পুনর্বাসন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৪ সালে এই বোর্ডের কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করে ‘নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ সৃষ্টি করেন। চাকরির সকল ক্ষেত্রে নারীর জন্য তিনি ১০ ভাগ কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্ব হারানো নারী, শিশু ও অন্যদের জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের জুন মাসে ১ লাখ ৬৬ হাজার বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রতিটি শহীদ পরিবারকে আর্থিক অনুদান প্রদানের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনি গঠন করেন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে থাকা অস্ত্র সরকারের কাছে সমর্পণের জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৩১শে জানুয়ারি তারিখ বেঁধে দেন। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই অস্ত্র সমর্পন করেন। ১৯৭৩ সালের ১৫ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় বিশেষ খেতাব প্রদানের তালিকা সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। বঙ্গবন্ধু ৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বীর শ্রেষ্ঠ, ৬৮ জনকে বীর উত্তম, ১৭৫জন মুক্তিযোদ্ধাকে বীর বিক্রম এবং ৪২৬জন মুক্তিযোদ্ধাকে বীর প্রতীক পদক প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটকে পড়া চার লাখ বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত আনার প্রশ্নে জাতির পিতা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
এভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী বাংলা পুনগর্ঠনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ নির্মানে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন। জাতির পিতা একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে আপোষহীন ছিলেন। বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো সময়কালের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত পোড়ামাটির এক সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের শত সমস্যা জয় করে তাকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করান এবং বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে একটি মর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। '৭৫-এর পনেরোই আগস্টে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নৃশংস খুনিরা কর্তৃক বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার না হলে যে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন তা তাঁর হাতেই প্রতিষ্ঠিত হতো। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডর মাধ্যমে খুনীরা কেবল ব্যক্তি শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকেই হত্যা করেনি, তারা ধ্বংস করে দিয়েছিল একটি সদ্য স্বাধীন দেশের উন্নয়নস্পৃহাকে। বঙ্গবন্ধু শুধু একটা দেশ স্বাধীন করেননি, একটা জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনা ও আকাঙ্ক্ষার পরিপূর্ণতা ঘটিয়েছেন। নিঃশর্তে কোনো প্রতিদানের আশা না রেখেই সারাটা জীবন তিনি বিলিয়ে দিয়েছিলেন এই জাতির জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য। বাঙালির অধিকার আদায় ও স্বাধীনতার জন্য জীবনের প্রায় ১৩টি বছর জেলেই কেটে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর। তিনি সারাটা জীবন বাঙালিকে ভালোবেসেছিলেন, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন।
শারীরিকভাবে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি আমাদের মাঝে নেই এটা যেমন সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য তাঁর সততা, দেশপ্রেম, আদর্শ ও স্বাধীন সত্ত্বা নিবিড়ভাবে প্রোথিত বাঙালির হৃদয়ের গহীনে যা তাঁকে চির অমরত্ব দান করেছে। জাতির জনকের হাতের স্পর্শে গড়ে ওঠা এ দেশের একেকটি প্রতিষ্ঠান ও তাঁর সূদুরপ্রসারী উন্নয়ন পরিকল্পনা আজও সাক্ষ্য দিচ্ছে-স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতির পিতা শেখ মুজিব বেঁচে আছেন বাঙালির চিন্তা ও সত্ত্বায়। তাঁর সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা এ রাষ্ট্র তাঁরই আদর্শে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরই সুযোগ কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর অবিচল নেতৃত্ব আর মেধার আলোয় বিশ্ব দরবারে আজ অন্য এক আলোকিত বাংলাদেশ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত একটি উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই পথে জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। তাঁর হাতকে শক্তিশালী করাই এখন বাংলাদেশকে উন্নয়নের মূলধারায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র প্রেরণা এবং এর মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু যে শোষনমুক্ত সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি সাহসী নাম, একটি গর্বিত ইতিহাস, স্বাধীন বাংলাদেশের স্রষ্টা আর বিশ্বের শোষিত নির্যাতিত মানুষের বন্ধু। বিশ্বনন্দিত রাজনীতিবিদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বাঙালি জাতি চির ঋণী, তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তিনি আমাদের সুখে-দুখে অন্তহীন প্রেরণার উৎস। বাঙালির সংগ্রাম মূখর অমর কাব্যের কবি এই নেতার অসীম সাহস, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, ধৈর্য, দেশপ্রেম ও সততার আলোয় আজ শুধু বাঙালি নয়, বিশ্ববাসী আলোকিত। রাজনীতির কবি এই মহান নেতা তাঁর প্রজ্বলিত আলোকধারায় বাঙালির হৃদয়ে চির ভাস্বর, চির অম্লান। তাঁকে সপরিবারে হত্যা করার ৪৭ বছর পরও তিনি প্রতিনিয়ত স্বমহিমায় উদ্ভাসিত বাঙালির চিন্তা, আবেগ ও অনুভবে। দিন যতই অতিবাহিত হচ্ছে হিমালয়সম এই নেতার মুগ্ধতায় আবিষ্ট হচ্ছে বিশ্ব, শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় এই নেতা আজ বিশ্বে অনন্য উচ্চতায় আসীন। তাইতো প্রখ্যাত কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার ভাষায় বলতে হয়,
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
ড. মো. হাসিবুল আলম প্রধান: সভাপতি ও প্রফেসর, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়