বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | ৪ পৌষ ১৪৩১
Dhaka Prokash
Header Ad

জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: বিজয়ের পরিপূর্ণতা অর্জন

বাঙালি জাতির জীবনে ১০ জানুয়ারি অনন্য ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭২-এর এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ বিজয়ের পরিপূর্ণতা অর্জন করে। যদিও ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হানাদার মুক্ত হয়। কিন্তু বাংলার মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। যতক্ষণ মহান নেতা ফিরে না এসেছেন, ততক্ষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনি। স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়, যেদিন জাতির জনক স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন সোনার বাংলায় ফিরে এসেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের প্রধান কারাগার লায়ালপুর জেলে রাখা হয়েছিল। আগস্টের মাঝামাঝি সামরিক আদালতে তার বিচার শুরু হয়। বিচারের রায় ছিল পূর্বনির্ধারিত। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের সময় ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন বিনা শাস্তিতে সে পার পাবে না। বিচারটা ছিল প্রহসনের। গোটা বিচার প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি আদালতে চুপচাপ বসে থাকতেন। বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে তার পক্ষে নিয়োগ করা আইনজীবী জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মুজিব নিজের পক্ষে কোনো অবস্থান নিতে চান কি না।’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। আমাকে অথবা আমার জনগণকে বিচার করার কোনো অধিকার এদের নেই। আইনের দিক দিয়ে কোনো বৈধতা এই আদালতের নেই।’ (পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দীজীবন, আহমেদ সালিম) ’৭১-এর ৩ ডিসেম্বর, প্রহসনমূলক বিচরের রায়ে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির দ- হয়। পরে তাঁকে লায়ালপুর থেকে স্থানান্তর করা হয় মিয়ানওয়ালি জেলে।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তার কারাকক্ষের পশে কবর খোঁড়া হয়।’ আহমেদ সালিম লিখেছেন, ‘জেলের ডেপুটি সুপার ফজলদাদ একদিন ব্যারাকে এসে ৮ জন বন্দিকে বাছাই করলেন। এদের দিয়ে ৮ ফুট লম্বা, ৪ ফুট প্রশস্ত ও ৪ ফুট গভীর গর্ত খোঁড়া হলো। উপস্থিত সবাই বুঝতে পারলেন সেই রাতেই শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেওয়া হবে। ৯টার মধ্যে কবর খোঁড়া সম্পন্ন হলো। কিন্তু সেই রাতে কিছু ঘটলো না। ফাঁসি দেওয়ার নির্ধারিত দিন জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে শেখ মুজিবকে ফাঁসি না দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, যদি মুজিবকে ফাঁসি দেওয়া হয় তবে বাঙালির ক্রোধের লক্ষ্য হবে পূর্বাঞ্চলে মোতায়েনকৃত পাকবাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার থেকে সর্বনিম্ন সৈনিক পর্যন্ত সবাই। ভুট্টোর উপদেশ অনুসারে ইয়াহিয়া খান মুজিবের ফাঁসি স্থগিত রাখেন। কয়েকদিনের জন্য কবর ভরাট করা হয়। ১৫ দিন পর একইভাবে গর্ত খোঁড়ার হুকুম আসে। এবারও শেখ মুজিবের ফাঁসি দেওয়া হলো না। এমনি প্রক্রিয়া ৩ বার ঘটেছিল এবং ৩ বারই তার ফাঁসি পিছিয়ে দেওয়া হয়।’ (প্রাগুক্ত) ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয়ী হলে, ইয়াহিয়া খান সেই আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারেননি। পাকিস্তানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খানকে অপসারণ করে ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে আবেদন করেছিলেন, ‘আমার একটি স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে, সেটি হলো শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো, আমাকে সেই সুযোগ দেওয়া হোক।’ যে কারণে ভুট্টো মিয়ানওয়ালি কারাগারের জেল সুপার হাবীব আলী’র কাছে বার্তা পাঠায় এবং বঙ্গবন্ধুকে মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে চশমা ব্যারাজ’স্থ হাবীব আলী’র বাসভবনে নিয়ে রাখা হয়। এরপর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুনয়-বিনয় করে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সম্পর্ক রাখার জন্য অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

ভারতের আকাশসীমা পাকিস্তানের জন্য নিষিদ্ধ থাকায় বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ে তাঁকে মুক্তি দিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা বজায় রেখে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার তাঁকে লন্ডন পৌঁছে দেয়। দ্রুতগতিতে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে বরণ করতে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় তারা বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেবে। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করেন ব্রিটিশ সরকার। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ব্রিটেনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। হোটেলে পৌঁছার কিছুক্ষণের মধ্যে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা লেবার পার্টির হ্যারল্ড উইলসন (পরে প্রধানমন্ত্রী) বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। হ্যারল্ড উইলসন প্রথম কোনো রাজনৈতিক নেতা যিনি করমর্দনের জন্য বঙ্গবন্ধুর দিকে হাত বাড়িয়ে প্রথম উচ্চারণ করেন ‘গুডমর্নিং মিস্টার প্রেসিডেন্ট’। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রদানের ব্যাপাওে ব্রিটেনের অনুসৃত নীতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে কনজারভেটিভরা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে আমরা পূর্ণ সমর্থন জানাবো।’

উল্লেখ্য যে, দেশ স্বাধীনের পর ’৭২-এর ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম পশ্চিমা দেশ হিসেবে ব্রিটেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বিকালে বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে যান। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। আন্তরিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এডওয়ার্ড হিথ বলেন, ‘আপনাকে কী সহযোগিতা করতে পারি বলুন।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি দ্রুত দেশে ফিরতে চাইছি।’ এডওয়ার্ড হিথ ত্বরিৎগতিতে ব্যবস্থা নেন। বৈঠক চলাকালেই নিশ্চিত হয় যে, ব্রিটিশ রাজকীয় কমেট জেট বিমানে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেবেন জাতির জনক। বৈঠক শেষে বিদায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন গাড়িতে উঠবেন তখন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ সৌজন্য প্রদর্শন করে গাড়ির দরজা খুলে দেন। কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য কোনো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এমন সম্মান পূর্বে দেখাননি। এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী হিথের সমালোচনায় হয়। তিনি সে-সব সমালোচনার জবাবে বলেছিলেন, ‘আমি যাকে সম্মান প্রদর্শন করেছি তিনি একটি জাতির মুক্তিদাতা মহান বীর। তাঁকে এই সম্মান প্রদর্শন করতে পেরে বরং আমরাই সম্মানিত হয়েছি।’ জাতির জনক শুধু বাঙালীর বন্ধু নন, তিনি ছিলেন বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু তথা বিশ্ববন্ধু। বিশ্ব নেতারা তাঁকে এভাবেই সম্বোধন করতেন।

৯ জানুয়ারি লন্ডনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু একটি বিবৃতি প্রদান করেন। ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলার মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দী জীবন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য অনুরোধ জানাবে।’ পরিশেষে তিনি বলেন, ‘আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজী নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’ বিবৃতির শেষে সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যে আপনার বাংলাদেশে ফিরে যাবেন সেই দেশ তো এখন ধ্বংসস্তূপ?’ তখন জাতির জনক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার বাংলার মানুষ যদি থাকে, বাংলার মাটি যদি থাকে, একদিন এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করব।’

১৬ ডিসেম্বর প্রিয় দেশ শত্রুমুক্ত হলেও তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন আমরা জানতাম না। যেদিন ৮ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সংবাদ জানলাম সেদিন এক অনির্বচনীয় আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল সারা দেশে। যেদিন তিনি ফিরে এলেন সেদিনটি ছিল সোমবার। সকাল থেকেই লক্ষ লক্ষ মানুষ ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে চারদিক মুখরিত করে মিছিল নিয়ে বিমানবন্দর অভিমুখে। রণক্লান্ত যুদ্ধজয়ী মুক্তিযোদ্ধা, শ্রদ্ধাবনতচিত্তে সংগ্রামী জনতা, অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে সন্তানহারা জননী, স্বামীহারা পত্নী, পিতৃহারা পুত্র-কন্যা সব দুঃখকে জয় করে স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথা ভুলে গর্বোদ্ধত মস্তকে সকলেই অধীর আগ্রহে সেদিন অপেক্ষায় ছিল দু’হাত বাড়িয়ে জাতির জনককে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করার জন্য।

ঢাকায় যখন সাজ সাজ রব, তখন সকাল হতেই দিল্লীর রাজপথ ধরে হাজার হাজার মানুষের মিছিল পালাম বিমানবন্দর ও প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। দিল্লীর জনসাধারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে এক অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট জেটটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবতরণ করলে তাঁর সম্মানে ২১ বার তোপধ্বনি করা হয়। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পর পূর্বেই উপস্থিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ তাঁকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, ‘আপনার জন্য আমি গর্বিত। ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ আপনার জন্য গর্ব অনুভব করে। শেখ মুজিবকে আমাদের মাঝে পেয়ে ভারতের জনগণ আজ আনন্দে আত্মহারা। শেখ মুজিব তাঁর জনগণকে নতুন জীবন দান করেছেন। তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্ন আজ সার্থক।’ দিল্লীতে সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতিকালে লক্ষ মানুষের সমাবেশে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ভারতবাসীর উদ্দেশে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেন, ‘আমার জন্য এটা পরম সন্তোষের মুহূর্ত। বাংলাদেশে যাবার পথে আমি আপনাদের মহতী দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কারণে যে, আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী-যিনি কেবল মানুষের নন, মানবতারও নেতা। তাঁর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার ন্যূনতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব। এ অভিযাত্রা সমাপ্ত করতে আপনারা সবাই নিরলস পরিশ্রম করেছেন এবং বীরোচিত ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দীদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায়। অবশেষে আমি নয় মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি।’ অভ্যর্থনার আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় বঙ্গবন্ধু একান্তে ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘ম্যাডাম প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আমি ঋণী। আপনি আমার বাংলার মানুষকে অস্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছেন; আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দিনগুলোতে আপনি পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আপনার কাছে আমরা চিরঋণী। প্রধানমন্ত্রী, আপনার নিকট আমার একটি অনুরোধ। আপনি কবে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করবেন।’ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী মহানুভবতার স্বরে বলেছিলেন, ‘আপনি যেদিন চাইবেন।’ বঙ্গবন্ধু এমন বিচক্ষণ নেতা ছিলেন যে, এ রকম একটি অবস্থার মধ্যেও রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যার্পণের বিষয়টি আলাপ করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি আদায় করে নেন।
এরপর অবসান ঘটে আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার। দিল্লী থেকে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট বিমানটি ঢাকার আকাশ সীমায় দেখা দিতেই জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। দুপুর ১:৫১ মিনিটে ঢাকা বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। বিমানে সিঁড়ি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য নেতারা, আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, কেন্দ্রীয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ছুটে যাই নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে। আমার হাতে ছিল পুষ্পমাল্য। জাতির জনককে মাল্যভূষিত করার

সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। সে এক অবিস্মরণীয় ক্ষণ, অভূতপূর্ব মুহূর্ত। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন। তাঁর চোখে তখন স্বজন হারানোর বেদনা-ভারাক্রান্ত অশ্রুর নদী, আর জ্যোতির্ময় দ্যুতি ছড়ানো মুখাবয়ব জুড়ে বিজয়ী বীরের পরিতৃপ্তির হাসি। বিমানের সিঁড়ি বেয়ে জাতির জনক তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। চারদিক থেকে তাঁর উপর পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী রাষ্ট্রপ্রধানকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ করেন। এ সময় বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণী ওসমানী, লে. কর্নেল শফিউল্লাহ্ এবং বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র লেফটেন্যান্ট শেখ কামাল জাতির জনকের পাশে ছিলেন। গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতারা, ঢাকাস্থ বিদেশি মিশনের সদস্যরা, মিত্র বাহিনীর পদস্থ সামরিক অফিসার, বাংলাদেশ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে করমর্দন করেন।

রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যাওয়ার জন্য জাতীয় নেতারাসহ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অপেক্ষমান ট্রাকে চেপে রওয়ানা দেই। সুদৃশ্য তোরণ, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দিয়ে সজ্জিত রাজপথের দু’পার্শ্বে দাঁড়ানো জনসমুদ্র পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ময়দানে পৌঁছলাম। লক্ষ লক্ষ অপেক্ষমান জনতার মুহুর্মুহু করতালি আর ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ রণধ্বনিতে চারদিক মুখরিত। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠে চতুর্দিকে তাকালেন এবং রুমালে মুখ মুছলেন। বঙ্গবন্ধুর মখের দিকে তাকিয়ে আমার কেবলই মনে হয়েছে, জাতির জনক জীবনভর এমন একটি দিনের অপেক্ষায়ই ছিলেন। দীর্ঘ কারাবাসের ক্লান্তিতে মলিন মুখটি তবু সমুজ্জ্বল। উন্নত ললাট, প্রশান্ত বদন, দু’চোখ তখনো অশ্রুসিক্ত, কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। সে অবস্থায়ই চিরাচরিত ভঙ্গিতে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশে নিবেদন করলেন তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতা। হৃদয়ের সবটুকু অর্ঘ্য ঢেলে আবেগঘন ভাষায় বললেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ দীর্ঘ ৯ মাস ১৪ দিন নির্জন কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গোনা একজন মানুষ কী করে এ রকম উদ্বেলিত পরিস্থিতিতেও স্থির-প্রতিজ্ঞ থেকে বলছেন, ‘ভাইয়েরা, তোমাদেরকে একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। আজকে আমি বলি, আজকে আমাদের উন্নয়নের জন্য আমাদের ঘরে ঘরে কাজ করে যেতে হবে।’ আরও বললেন, ‘সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ।’ বক্তৃতায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে-গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।’ ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মদান স্মরণ করে বেদনা-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাংলায় আজ বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বলেন, ‘গত পঁচিশে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব কুকীর্তির বিচার করতে হবে।’ পরিশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে বঙ্গ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি। কবিগুরুর মিথ্যা কথা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ।’ লক্ষ লক্ষ মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছে এবং পরম পরিতৃপ্ত হয়েছে এই ভেবে যে, আজ থেকে আমরা প্রকৃতই স্বাধীন। সভামঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ১৮ নং বাড়িতে গেলেন। যেখানে পরিবারের সদস্যবৃন্দ অবস্থান করছিলেন। সেই বাড়ির সামনে আর একটি বাড়ি তখন তাঁর জন্য রাখা হয়েছিল। কেননা ধানমন্ডির ৩২ নং বাসভবনটি শত্রুবাহিনী এমনভাবে তছনছ করে দিয়েছিল যা বসবাসের অনুপযুক্ত ছিল। প্রিয় সহকর্মীদের সঙ্গে ১১ জানুয়ারি বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন এবং ১৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আমাকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় তাঁর রাজনৈতিক সচিব করেন। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র। কাছে থেকে দেখেছি দিবারাত্রি নিরলস পরিশ্রম করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে স্বাভাবিক করতে যখন তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিলেন তখনই দেশি-বিদেশি ঘাতকচক্র জাতির জনককে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করল!

জাতির জনকের দুটি স্বপ্ন ছিল-বাংলাদেশ স্বাধীন করা, এবং দেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়ে প্রথম স্বপ্ন তিনি পূরণ করেছেন। আরেকটি স্বপ্ন বাস্তবায়নে যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিলেন, তখনই বুলেটের আঘাতে সপরিবারে জাতির জনককে হত্যা করা হলো। আমাদের সৌভাগ্য তাঁর দুই কন্যা তখন বিদেশে অবস্থান করায় রক্ষা পান। ’৮১-এর মধ্য ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যার হাতে রক্তে ভেজা আওয়ামী লীগের পতাকা আমরা তুলে দিয়েছিলাম। সেই পতাকা হাতে নিয়ে নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে তিনি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। প্রতিপক্ষের শত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ ‘মুজিববর্ষ’ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তী পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচক আজ ইতিবাচক অগ্রগতির দিকে ধাবমান। করোনা অতিমারী সফলভাবে মোকাবিলা ও দেশের মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাক্সিন প্রদান করে তিনি মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সম্প্রতি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে নিষেধাজ্ঞার যে কূটকৌশল চলছে আশা করি সেই পরিস্থিতিও ধৈর্যের সঙ্গে তিনি মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বিশ্বজুড়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহন মেট্রোরেল চালু করেছেন। যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে জাতির জনক ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় তারই সুযোগ্য উত্তরসূরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আজ তা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হতে চলেছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নের চরম শিখরে নিয়ে যাবেন এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবেন।

তোফায়েল আহমেদ: আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ

Header Ad
Header Ad

কক্সবাজারে ট্রাক-অটোরিকশা সংঘর্ষ, শিশুসহ নিহত ৫

ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজারের পেকুয়ায় ডাম্পট্রাক ও অটোরিকশার সংঘর্ষে শিশুসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন আরও দুইজন।

বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) সকাল ৭টার দিকে পেকুয়া এবিসি আঞ্চলিক মহাসড়কের ধনিয়াকাটা এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহতরা হলেন- অটোরিকশাচালক পেকুয়ার ধনিয়াকাটার ছৈয়দ আলমের ছেলে মনিরুল মান্নান, চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকার ফিরোজ ও তার স্ত্রী শারমিন এবং তাদের শিশু সন্তান। নিহত অপরজনের পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসিম উদ্দিন চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, সকাল ৭টার দিকে পেকুয়া এবিসি এলাকায় মিনি ট্রাক (ডাম্প ট্রাক) ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে ৫ জন নিহত হয়। আরও দুইজন আহত হন। দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি দুইটি জব্দ করা হয়েছে।

Header Ad
Header Ad

মাদককাণ্ডে ফেঁসে যাচ্ছেন তিন শীর্ষ নাট্যাভিনেত্রী!

অভেনেত্রী মুমতাহিনা চৌধুরী টয়া, সাফা কবির এবং তানজিন তিশা। ছবি: সংগৃহীত

দেশের শোবিজ অঙ্গনে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নাট্যাভিনেত্রী ও মডেল মাদক সম্পৃক্ততার অভিযোগে আলোচনার কেন্দ্রে। অভিযোগের তালিকায় রয়েছে সাফা কবির (আনাতোনি কেলি সাফা) ও মুমতাহিনা চৌধুরী টয়ার নাম, যাদের বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লেষের অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এছাড়া, নাট্য জগতের আরেক পরিচিত মুখ তানজিন তিশা এবং সংগীতশিল্পী সুনিধি নায়েকের বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লেষের বিষয়ে বিশেষ অনুসন্ধান চালাচ্ছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (নারকোটিক্স)। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে, যা শোবিজে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।

সম্প্রতি দেশের একটি গণমাধ্যমে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- সূত্রে জানা গেছে, মাদকসহ গ্রেফতার হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে তথ্য-প্রমাণসহ সাফা, টয়া, তিশা এবং সুনিধির নাম বেরিয়ে আসে। একটি বিশেষ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে তারা নিয়মিত মাদক সংগ্রহ করে আসছিলেন। ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের অ্যাডমিন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী অরিন্দম রায় দীপকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে।

অভেনেত্রী তানজিন তিশা। ছবি: সংগৃহীত

ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নারকোটিক্সের সহকারী পরিচালক রাহুল সেন গণমাধ্যমকে বলেন, দীপকে গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে আমরা কয়েকজন প্রথম সারির অভিনেত্রী ও মডেলের মাদক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছি। এ বিষয়ে এখনও তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অভেনেত্রী মুমতাহিনা চৌধুরী টয়া। ছবি: সংগৃহীত

এ বিষয়ে নারকোটিক্স বলছে, মাদক সম্পৃক্ততার অভিযোগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সাবেক ছাত্র দীপের ওপর বিশেষ নজরদারি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে তার গতিবিধি অনুসরণের ধারাবাহিকতায় ১৭ অক্টোবর ঢাকা বিমানবন্দরে গ্রেফতার হন দীপ। এ সময় তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সিসা, এমডিএমএ, এলএসডি ও কুসসহ বেশ কিছু মাদক উদ্ধার করা হয়। পরে নারকোটিক্সের একটি বিশেষায়িত টিম দীপকে ২ দিনের রিমান্ডে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, মাদক ব্যবসার বিষয়ে মৌখিক স্বীকারোক্তির একপর্যায়ে দীপের মোবাইল ফোনের কললিস্ট ও হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটিং পরীক্ষা করা হয়। এতে জনপ্রিয় কয়েকজন অভিনেত্রীর মাদক সম্পৃক্ততার তথ্য মেলে। এমনকি তাদের পক্ষ থেকে দেওয়া মাদকের অর্ডারসংক্রান্ত কয়েকটি সুনির্দিষ্ট হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটিং রেকর্ডও পাওয়া যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, দীপের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সাফা, টয়া, তিশা এবং সুনিধি নায়েকের নামে সেভ করা কয়েকটি নম্বর থেকে নিয়মিত মাদকের অর্ডার দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরে নম্বরগুলো যাচাইয়ের জন্য ফোন নম্বরের রেজিস্ট্রেশন রেকর্ড সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট নম্বরগুলো সাফা কবির এবং টয়ার নামেই রেজিস্ট্রেশনকৃত। তবে তানজিন তিশার নম্বরটির রেজিস্ট্রেশন রয়েছে তার মা উম্মে সালমার নামে।

অভেনেত্রী সাফা কবির। ছবি: সংগৃহীত

গণমাধ্যমের হাতে আসা কয়েকটি চ্যাটিং রেকর্ডে দেখা যায়, ২৩ এপ্রিল সাফা কবির তার মোবাইল নম্বর থেকে ৩টি এমডিএমএ অর্ডার দেন। এজন্য দীপের হোয়াটসঅ্যাপে তিনি সংক্ষেপে লেখেন ‘ই’ দিতে পারবা আমাকে ৩টা।’ পালটা বার্তায় দীপ লেখেন দাঁড়াও বলি। সাফা লেখেন ‘ওকে’। এরপর দীপ লেখেন কিভাবে নিবা? যাওয়ার পথে? সাফা লেখেন ‘আমি চেষ্টা করব।’

এছাড়া ৫ সেপ্টেম্বর আরেক চ্যাটিংয়ে মাদকের অর্ডার দেন অভিনেত্রী টয়া। তিনিও সাংকেতিক ভাষায় লেখেন ‘ই’ লাগবে ৫টা। ফিরতি বার্তায় দীপ লেখেন ‘ফর বাংলা ফ্রুট?’ (সম্প্রতি কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত প্রাইভেট পার্টি)। এরপর টয়া লেখেন ‘ইয়াপ (ইয়েস)।’

মাদক বিক্রির এই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আরও কয়েকজন অভিনেত্রী ও সংগীত শিল্পীর চ্যাটিং পাওয়া যায়। এদের অন্যতম হলেন অভিনেত্রী তানজিন তিশা এবং সংগীত শিল্পী সুনিধি নায়েক। চ্যাটিংয়ে সুনিধি নায়েক কয়েকটি ব্র্যান্ডের এমডিএমের প্যাকেট শেয়ার করে অর্ডার দেন।

নারকোটিক্স বলছে, ভারতীয় নাগরিক সুনিধি নায়েক দীর্ঘদিন ধরে মাদকাসক্ত। বাংলাদেশের নামকরা সংগীত শিল্পী এবং কোক স্টুডিওর অন্যতম উদ্যোক্তা শায়ান চৌধুরী ওরফে অর্ণবকে বিয়ে করে তিনি ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তবে সম্প্রতি অর্ণবের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়েছে এমন কথা বিভিন্ন মিডিয়ায় শোনা যায়।

সংগীতশিল্পী সুনিধি নায়েক। ছবি: সংগৃহীত

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, দীপ গ্রেফতারের পরপরই সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ তাদের মোবাইল ফোন থেকে গোপন চ্যাটিং রেকর্ড মুছে ফেলার চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে তারা পুরোপুরি সফল হননি। গ্রেফতারের পর তাৎক্ষণিকভাবে দীপের মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এতে মাদক কেনাবেচাসংক্রান্ত চ্যাটিং রেকর্ড মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি।

সূত্র জানায়, বর্তমানে রাজধানীর গুলশান এবং বনানীকেন্দ্রিক ধণাঢ্য পরিবারের সন্তানদের অনেকেই এমডিএম, এলএসডি এবং কুশ নামের উচ্চ আসক্তি সম্পন্ন মাদকের দিকে ঝুঁকছে। চোরাইপথে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং থাইল্যান্ডসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ থেকে এসব মাদকের চালান আসছে। স্ল্যাপচ্যাট, মেসেঞ্জার বা হোয়্যাটসঅ্যাপ গ্রুপে এগুলো বিক্রি করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গোপনীয়তার জন্য বিভিন্ন সাংকেতিক নামে এসব মাদক বিক্রি করা হয়ে থাকে। যেমন এমডিএম ‘ই’ নামে, এলএসডি ‘এসিড’ এবং এক ধরনের তরল গাঁজা টিএসসি নামে কেনাবেচা হয়। ইলেকট্রিক সিগারেটের মতো ভেপ আকারে তরল গাঁজা সেবন করা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা গণমাধ্যমকে জানান, এমডিএমএ পরীক্ষাগারে তৈরি এক ধরনের কৃত্রিম ওষুধ। এটি অনেক দেশে এস্টাসি বা সুখানুভূতির মাদক হিসাবে পরিচিত। এটি ইয়াবার উপকরণ মেথাএমফিটামিনের মতোই অতি উত্তেজক মাদক। এটি মানবদেহে এমন একটি শক্তিশালী প্রভাব তৈরি করে যাতে সময় এবং উপলব্ধি জ্ঞানের বিচ্যুতি ঘটে। তবে অনেক সময় এটি শান্তি, আনন্দ, সহানুভূতি এবং এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের বর্ধিত অনুভূতি তৈরি করে।

Header Ad
Header Ad

গুম-খুনে জড়িত ২০ কর্মকর্তার পাসপোর্ট স্থগিত, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

প্রতীকী ছবি

গুমের সঙ্গে জড়িত ২০ সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তার পাসপোর্ট স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে তাদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) এসব তথ্য জানা গেছে। রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. কামরুজ্জামানের সই করা একটি প্রজ্ঞাপনে এ আদেশ দেওয়া হয়।

এতে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) অতিরিক্ত আইজিপিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের ভিত্তিতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম চলছে।

ওই ২০ কর্মকর্তা হলেন, র‌্যাবের সাবেক ডিজি মোখলেছুর রহমান, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও বেনজীর আহমেদ, র‌্যাবের সাবেক এডিজি জিয়াউল আহসান (বর্তমানে গ্রেপ্তার) ও কর্নেল তোফায়েল মোস্তুফা সারোয়ার, র‌্যাব-৭ এর সাবেক সিও লে. কর্নেল মেফতা উদ্দিন আহমেদ, র‌্যাবের সাবেক সিও অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার লুৎফুল কবির (র‌্যাব-৪) ও শাহাবুদ্দিন খান (র‌্যাব-১০), র‌্যাবের সাবেক পরিচালক লে. কর্নেল মাহাবুব আলম, র‌্যাব-১১-এর সাবেক সিও লে. কর্নেল কামরুল হাসান, র‌্যাব-১-এর সাবেক সিও লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম, সিটিটিসির প্রধান পলাতক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম ও ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মোহাম্মদ মারুফ হাসান, ডিবির সাবেক ডিসি মশিউর রহমান, সিটিটিসির সাবেক এডিসি তৌহিদুল ইসলাম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু তাহের মোহাম্মদ ইব্রাহিম, মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, মাহাবুবুর রহমান সিদ্দিক।

Header Ad
Header Ad

সর্বশেষ সংবাদ

কক্সবাজারে ট্রাক-অটোরিকশা সংঘর্ষ, শিশুসহ নিহত ৫
মাদককাণ্ডে ফেঁসে যাচ্ছেন তিন শীর্ষ নাট্যাভিনেত্রী!
গুম-খুনে জড়িত ২০ কর্মকর্তার পাসপোর্ট স্থগিত, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
ভাইরাল ভিডিওটি ছিল ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’, ব্যবহৃত হয়েছে ডামি অস্ত্র
শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের দুর্নীতি অনুসন্ধানে ৫ কর্মকর্তা নিয়োগ
৫ বছর পর চালু হচ্ছে রংপুর চিনিকল, এলাকায় খুশির বন্যা
মোদির বিতর্কিত পোস্ট: যে বার্তা দিলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
ভারত থেকে ৫০ হাজার টন চাল কিনবে সরকার
তনুর গ্রাফিতির ওপর পোস্টার সাঁটালেন মেহজাবীন, সমালোচনার ঝড়
ফ্যাসিস্ট সরকার দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে: তারেক রহমান
আবারও বাড়ল স্বর্ণের দাম, ভরিতে কত?
তাবলিগ ইস্যুতে যা বললেন মিজানুর রহমান আজহারী
নির্বাচনের জন্য ৬ মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়: সালাহউদ্দিন আহমেদ
এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউলের দুর্নীতির অনুসন্ধানে দুদক
দিনাজপুরে অর্ধকোটি টাকার নিষিদ্ধ ট্যাবলেটসহ আটক ২
রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা থেকে খালাস পেলেন তারেক রহমান
শামা ওবায়েদকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য, কনটেন্ট ক্রিয়েটর ইলিয়াসের বিরুদ্ধে ঝাড়ু মিছিল
প্রধান উপদেষ্টা মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেবেন
সাকিবকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ
এবার ভারতীয় পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপে ট্রাম্পের হুমকি