অভ্যন্তরীণ মহামারিতে রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু
ডেঙ্গু পরিস্থিতি দেশের অভ্যন্তরীণ মহামারির আকার ধারণ করেছে। আমরা জানি, এবছর বেশ ভালো রকম বৃষ্টিপাত হয়েছে। বিশেষ করে সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বেশ কয়েকদিন প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই বৃষ্টিপাত এডিস মশা উৎপাদনের জন্য উপযোগী। অন্যদিকে নগরায়ন বাড়ছে। প্রচুর পরিমাণ পলিথিনের ব্যবহার হচ্ছে দেশে। আর পলিথিনে বৃষ্টির পানি জমার পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছে। যেগুলো এডিস মশা উৎপাদনের অন্যতম কারণ।
আরেকটি বিষয় হলো, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে পলিথিনের অতিরিক্ত ব্যবহার, তাদের বিভিন্ন ধরনের ঘর-বাড়ি-স্থাপনা ইত্যাদি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। এসব কারণে পানি জমার ফলে এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি হয়েছে। সেখানে পরিষ্কার বৃষ্টির পানি জমছে, ফলে ডেঙ্গু ভাইরাসের উৎপত্তি বাড়ছে এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এরকম নগরায়ন ঢাকার বাইরেও বেশ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সে কারণে এডিস মশার বিচরণ ক্ষেত্র বেড়েছে। রোগীর বিস্তৃতি বেড়েছে। কাজেই ব্যাপক জনউদ্যোগের মাধ্যমে শহরাঞ্চলকে যদি স্বাস্থ্যকরভাবে আমরা গড়ে না তুলি, এ নগরকে যদি সরকারিভাবে গুরুত্ব না দিই, তাহলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা আছে।
একই ভাইরাস দিয়ে ডেঙ্গু সংক্রমিত হয় না কিন্তু আমরা জানি, ডেঙ্গু ভাইরাস চার রকমের। এবার যে ভাইরাসটি বেশি সংক্রমিত হচ্ছে, সেটি ৪ নম্বর ভাইরাস এবং সেটির ফলে অবস্থা আরও বেশি খারাপ হচ্ছে। এবার আক্রান্তের হার অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। কাজেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে গেলে আমাদের কমিউনিটি ভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন বসতবাড়ি নষ্ট হচ্ছে, সেক্ষেত্রে মানুষকে সক্রিয় করে তাদের দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে ছোট এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ করে কাজ করতে হবে। আরেকটি হচ্ছে রোগী শনাক্ত করা।
ডেঙ্গুতে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তারা জানছেন না যে, তাদের ভেতর ডেঙ্গু ভাইরাস আছে। কাজেই যেখানেই আমরা এডিস মশা পাচ্ছি, সেখানেই ব্যাপক আকারে ‘মাস্ট কিলিং’ কর্মনীতি গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কেন হচ্ছে সেটি ডেঙ্গু, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া অথবা অন্যকিছু হোক, সেটি যদি সরকারি উদ্যোগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা করা হয়, তাহলে যাদের যে রোগ হয় সেক্ষেত্রে প্রাথমিক ব্যবস্থা নিলেই সেটি আর গুরুতর অবস্থায় যাবে না। ফলে রোগীর সংখ্যা কমে যাবে, হাসপাতালের উপর চাপ কমে যাবে।
কাজেই আমি বলব এখানে কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত বৃষ্টিপাত বেশি হওয়া, দ্বিতীয়ত নগরায়ন বৃদ্ধি পাওয়া এবং যেটি কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবান্ধব নয়। রোগী শনাক্ত করে তাকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বরাদ্দ পর্যাপ্ত নেই। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় প্রত্যেক নাগরিক যেন স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসে এবং সেই স্বাস্থ্যসেবা পরবর্তী পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা কোনো কাজে আসেনি। চিকিৎসার কথা যদি ধরা হয়, সেখানেও দেখব সব নাগরিক কিন্তু সুরক্ষিত নয়। কাজেই আমাদের অন্যতম করণীয় যেটি ছিল ২০৩০ সাল নাগাদ সব নাগরিককে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় নিয়ে আসা। এখন ২০২২ কিন্তু আমরা সেক্ষেত্রে খুব একটা এগোতে পারিনি।
ডেঙ্গু করোনার মতো নয়। তবে বর্তমান সময়ে এটি একটি অভ্যন্তরীন মহামারি হিসেবেই বিবেচিত। আমি মনে করি, ডেঙ্গু প্রশমনে সারা বছর জুড়েই সার্ভে করা দরকার। সিটি কর্পোরেশনের সামান্য অংশ সামান্য জনবল আছে এটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তবে আমাদের প্রচুর ভলেনটিয়ার প্রয়োজন। গোটা শহরে একসঙ্গে একইদিনে মশা নিধন করার পরিকল্পনা এর আগে নেওয়া হয়েছে। তবে শহরের মধ্যে কোনো প্রাকৃতিক বিভাজনের দেয়াল নেই এমনকি কোনো নদীও নেই। ওষুধ পথ্য দিয়ে হাসপাতাল ভরে কিন্তু মশক নিধনে কোনো ভূমিকা গ্রহণ না করলে কোনো ফল হবে না। পুরো ঢাকা সিটি এখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। উপযুক্ত চিকিৎসা একইসঙ্গে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েই আমাদের ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে হবে।
লেখক: পরামর্শক; রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)
এসএন