পরিবারে আয় কমায় ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা
পাঁচটি মূল অনুষঙ্গের অন্যতম একটি হল শিক্ষা। আমরা বলে থাকি শিক্ষাই একটি জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ঘুণপোকা ধরেছে বহু আগেই। সব জায়গাতেই অসঙ্গতি আমরা জানি। এখন সেটি শিক্ষাব্যবস্থাকেও গ্রাস করে খাচ্ছে। আমরা যতই সৃজনশীলতার বুলি আওড়াই না কেন, আমরা দেখেছি একজন শিক্ষক নিজেই জানেন না সৃজনশীল প্রশ্নপত্র কিভাবে করতে হয়। কাজেই শিক্ষা শিক্ষক শিক্ষার্থী শিক্ষাঙ্গন কোনো কিছুই আজ ঠিক নেই!
বর্তমান প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা স্কুল বিমুখ হয়ে পড়েছে। করোনা মহামারি আমাদের একটা বড় রকমের সংকট ছিল। তখন এমনিতেই ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনার পরিবেশে ছিল না। স্কুল কলেজগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বেশ বড় একটি সময় ধরে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে যেতে পারেনি যে কারণে পড়াশোনার ধারাবাহিকতা ছিল না। করোনা পরবর্তী সময়ে পরিবারগুলোতে সংকটের কারণ হচ্ছে ,মানুষের কর্মসংস্থান কমে গিয়েছে।
অনেকের আয় কমে গেছে, কিন্তু জীবনযাপনে ব্যয় বেড়েছে প্রচুর। তা ছাড়া, যেহেতু দেশের কর্ম বাজারে একটি বড় অংশ, শতকরা ৮০ ভাগ, যারা ইনফরমাল সেক্টরে করোনাকালে তাদের সংকট ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ তারা কোনো কাজই করতে পারেনি। আরেকটি কারণ হলো, শুধুমাত্র কম আয়ের মানুষ নয়, প্রান্তিক আয়ের মানুষের কথাও যদি চিন্তা করি, যেমন স্বল্প পুঁজির মানুষ, উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মুদি দোকান, চায়ের দোকান, নতুন ব্যবসা তারা অনেকেই ধরা খেয়ে গেছে। তাদের জন্য সরকার থেকে সেভাবে প্রণোদনা ছিল না। সরকারের প্রণোদনা ছিল বড় ব্যবসার ক্ষেত্রে। যার ফলে প্রান্তিক মানুষ অথবা স্বল্প আয়ের মানুষের গুছিয়ে উঠাটাই বেশ কঠিন হয়ে গিয়েছে।
পরবর্তীকালে যখন তারা গুছিয়ে উঠতে শুরু করেছে, তখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, তেলের দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ইত্যাদি তাদের আক্রমণ করেছে। যার ফলে অনেক পরিবার ঘুরে দাঁড়াতেও পারেনি। যখনই একটি পরিবারে আর্থিক সংকট আসে, তাদেরকে বাজেট কাটছাঁট করতে হয়। বাজেট কাটছাঁটের মধ্যে এরা প্রথমেই খাদ্যদ্রব্য মূল্য কমাতে চেষ্টা করে। শিক্ষা ক্ষেত্রে যেটি দেখা যায়, তাদের ছেলেমেয়েরা যখন শিক্ষাগ্রহণ করতে থাকে, আর্থিক সংকট হলে তাদের উপরেই চাপটি গিয়ে পড়ে। মেয়েদের ক্ষেত্রে চাপটি আরও বেশি পড়ে।
করোনাকালীন দেখেছি শিশুশ্রম বেড়ে গিয়েছে। স্কুলের ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গেলে আমরা দেখতে পাব, কম বয়সী স্কুলগামী ছেলে-মেয়েরা কাজ করছে। এটির একটি বড় কারণ হলো, তাদের অভিভাবকদের আয় অনেক কমে গেছে। গত কয়েক মাসের জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে এত বড় ধাক্কা আসছে, করোনা পরবর্তী সময়ে প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার ফলে, টিকে থাকার জন্যই অনেক পরিবারে ছেলেমেয়েদের লেখা পড়া বন্ধ।
সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, সরকারি স্কুলে পড়লে বোধহয় খরচ নেই। কথাটি ঠিক নয়। সরকারি স্কুলে পড়লে সেখানেও খরচ আছে। কারণ, টিউশন ছাড়া পরীক্ষায় পাশ করা যায় না। গাইড বই কিনতে হয় বাধ্যতামূলকভাবেই। কোচিং এ যেতে হয়। সরকারি স্কুলে মেয়েদের হয়তো বেতন নেই। অন্যান্য খরচগুলো মিলে বেশ ভাল ব্যয় হয়। ফলে পড়াশোনা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয় না। সেকারণেই ছাত্র-ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার অপেক্ষাকৃত বেশি।
একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়, শিক্ষা নীতিমালা বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া যেভাবে নেওয়া হয়, এগুলোর মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। সৃজনশীলতার নিয়ম-কানুনগুলি যেভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো না জেনে না বুঝেই, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত চিন্তা না করে, বিভিন্ন বিদ্যালয়ের যে কাঠামোগত অবস্থা সেগুলি চিন্তা না করে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করে, শিক্ষকদের গুণগতমান উন্নয়নের ব্যবস্থা না রেখে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেটি চাকা বিহীন গাড়ির মতোই অকেজো হয়ে গিয়েছে। পুরো ব্যাপারটিই একটি প্রহসনে পরিণত হয়েছে।
লেখক: শিক্ষাবিদ