পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিতর্ক অর্থহীন
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানেই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে কোনো লাভ করা যাবে না। এখানে যারা টাকা বিনিয়োগ করবে তারা সেই টাকা বিনিয়োগ করে শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটানোর চেষ্টা করবে। যে টাকাটি বিনিয়োগ করছে, সেখান থেকে যেটুকু উপার্জিত হবে, সেটি শিক্ষা খাতেই পুনরায় ব্যবহার করা হবে। এখানে ট্রাস্টের যারা সদস্য আছেন, তারা কোনো টাকা-পয়সা নিতে পারবেন না। কিন্তু আমরা দেখেছি, আমাদের গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় তথ্য-উপাত্ত থেকে। যে তথ্য এসেছে সেটি হলো অনেকেরই অর্থ নিয়ে পাচার করে দেওয়ার মতো অভিযোগও এসেছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ, যারা শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ করবেন, তারা যেন এ ধারণা নিয়ে আসেন যে, শিক্ষা প্রসারের জন্য সেটি পুনরায় ব্যবহার করবেন। এই মনোভাব পোষণ করতে না পারলে সেটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
বিভিন্ন কারণে হোক অথবা যে কারণেই হোক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করার সুযোগ করে দেওয়া হলো না, সেই দায়-দায়িত্ব কে নেবে? সেই দায়-দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। কারণ, ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষাজীবন শেষে দেশের উন্নয়নে অংশগ্রহণ করবেন। সেক্ষেত্রে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে সবক্ষেত্রে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় একটি বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত ছাত্ররা বিভিন্ন দাবি দাওয়াসহ বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে যখন আমাদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছে। তখন এসব করতে গিয়ে তাদের নিয়মিত পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। এ বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখতে হবে।পড়াশোনা ক্ষতি করে কিছু করা যাবে না।
বিদেশে দেখা যায়, যারা উচ্চ শিক্ষা নেন তারা নিজস্ব অর্থ উপার্জন করে লেখা পড়া করে। কেউ তাদের বাবা মায়ের পয়সাতে লেখাপড়া করেন না। অথচ আমাদের দেশে ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়া করছে, কিন্তু তারা জানছে না তাদের দেওয়া বেতন ভাতা দিয়ে কী কী উন্নয়ন কার্যক্রম হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা কিন্তু প্রতিবাদ করছে। তারা সংবাদ সম্মেলন করে অন্তত জানাচ্ছে। তারা তাদের চেষ্টাটা অব্যাহত রাখতে চেষ্টা করে যেটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও দরকার।
আমার মনে হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যে বিতর্ক আমরা করি, সেই বিতর্কটি একটি অর্থহীন বিতর্ক হয়। কারণ, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যদি দুইভাগে ভাগ করে ফেলি, তখন সেটি বিশ্ববিদ্যালয় আর থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞা, এর কার্যক্রম লক্ষ্য উদ্দেশ্য আর্থিকভাবে বিনিয়োগ সরকার করছে, জনগণের টাকা সেখানে ব্যয় করা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো কতটুকু ফলপ্রসূ হচ্ছে সেটি লক্ষ্য রাখা দরকার। কিছু ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী সমবেত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে, কিন্তু সেটি কতটা সফল হচ্ছে সেটি দেখা জরুরি।
শিক্ষার্থীদের যে সুযোগ সুবিধা, সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা পাবিলক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর যেমন বর্তায়, তেমনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরও। সেদিকটি অবশ্যই দেখতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তাদেরও আবাসিক সুবিধা থাকতে হবে। তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড খেলাধুলাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান রক্ষা করা জরুরি। এভাবে উন্মুক্তভাবে যদি আমরা দেখি তাহলে দেখা যাবে যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যে পার্থক্য সেটি আমরা অনেকটা কমাতে পারব। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। অথবা নতুনভাবে বিষয়গুলোকে নিয়ে বিতর্ক বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না।
উন্নত বিশ্বে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে। তারা কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেগুলোকে উদাহরণ হিসেবে দেখতে হবে। ছাত্র প্রতিনিধিত্ব কীভাবে করতে হয় সেগুলো দেখে সে অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করতে পারি। শিক্ষা যেহেতু সবচেয়ে জরুরি একটি ক্ষেত্র, শিক্ষা যেখানে একটি জাতির ভিত রচনা করে, শিক্ষাক্ষেত্রে এ পরিবর্ধন, পরিবর্তন উন্নয়ন করা জরুরিভাবে আমাদের প্রয়োজন আছে।
ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর নামে তাদেকে প্রতারণা করা, তাদেরকে সুযোগ সুবিধা কম দেওয়া সেটি কোনোভাবেই সঠিক হচ্ছে না। কাজেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষা কার্যক্রম খুবই জরুরি বিষয়। সেটি নিয়ে আমাদের এখন থেকেই নতুন করে শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য চিন্তা-ভাবনা প্রয়োজন।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়