রিজার্ভ ধরে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েছে তার সঙ্গে কয়েকটি কারণ সম্পৃক্ত বলে আমি মনে করি। প্রথমত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। রেমিট্যান্স কমে গেছে। রপ্তানি বাণিজ্য কমে গেছে এবং আমদানি-রপ্তানির মধ্যে বড় ধরনের একটি ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর কারণ হল, আমরা এককেন্দ্রিক রপ্তানির দিকে গিয়েছি। সেখানে রপ্তানির বৈচিত্র্য নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। আমাদের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। সেইসঙ্গে আমাদের জোগান কম। চাহিদা বেশি। আমাদের দুর্নীতি চরম মাত্রায়। তা ছাড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট রয়েছে। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক দুর্বলতা রয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনাও সঠিক ভূমিকা রাখতে পারেনি। বিষয়গুলো তো চেইনের মতো। একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত। এই অব্যবস্থাপনা তো দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। চাইলেই চট করে সংকট দূর করা সম্ভব হবে না।
প্রথমত কিছুটা রেমিট্যান্স বেড়েছিল কিন্তু সেটিকে ধারাবাহিক বলা যাবে না কিছুতেই। গত মাসের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, এক্সপোর্ট একটু কমে গেছে রেমিট্যান্সও। যাইহোক, সার্বিকভাবে কিন্তু আমাদের এক্সপোর্টের যে আয়, রেমিট্যান্স থেকে যে আয়, চলতি হিসেবে সেটি কিন্তু ঘাটতি কমানোর চেয়ে আরও বেশিমাত্রায় বেড়ে যেতে পারে। এদিকে ইম্পোর্টও বেড়েছে। সেখানে আবার কিছু অত্যাবশকীয় মেশিনারিজের ম্যাটেরিয়ালগুলো থাকতে পারে।
যাইহোক,সবমিলিয়ে একটু চাপের মুখে আছি আমরা। মাঝখানে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুটা রিল্যাক্স হলেও মাল্টিপল রেট যেটি ছিল, কাছাকাছি একটি রেটে আমরা গিয়েছি। অন্যদিকে চাপ বাড়ার ফলে আরেকটু সমস্যা বাড়বে। রিজার্ভতো অনেকটা কমেই গিয়েছে। এভাবে যদি বরাবর কমতেই থাকে অর্থাৎ বাণিজ্য ঘাটতি যদি বাড়তেই থাকে, তবে কিন্তু এটি একটি চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
অতএব, বাংলাদেশ ব্যাংককে কতগুলো পদক্ষেপ দ্রুত নিতে হবে। যেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের একার পক্ষে সম্ভব হবে না। এখানে কিন্তু বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ব্যাপার আছে। তারপর কাস্টমস এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে যে, লক্ষ্য রাখতে হবে আমদানি ঠিকমত হচ্ছে কি না। বেশি মূল্য দেখানো হচ্ছে কি না। অন্যদিকে আমাদের মনযোগ এটিই যে, আমাদের যে অর্থ আছে সেটি পাচার হয়ে যাচ্ছে কি না। এটি একটি বিপদের ব্যাপার। এটি যে রোধ করতে পারা যাচ্ছে, সেটি কিন্তু খুব মনে হচ্ছে না। এই বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে।
আমি মনে করি, ব্যাংকগুলো আরেকটু সজাগ হোক। টাকাগুলো যেন দ্রুত নিয়ে আসা যায়। এক্সপোর্ট আরনিংটা যেন তাড়াতাড়ি নিয়ে আসে। প্রত্যাবাসন যেন হয়। আমাদের রেমিট্যান্স যেন আরেকটু বাড়াতে পারি। সামান্য যেটুকু বেড়েছে এটি মোটেও সন্তোষজনক নয়। আমরা অন্যান্য দেশের দিকে যদি তাকাই, বিশেষ করে ভিয়েতনামের দিকে যদি তাকাই, ওদের ক্রমে ক্রমে বাড়ছে । এই বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে। কারণ আমাদের যে অবস্থা, সেটি চিন্তা করার মতোই। আমাদের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমাদের অসুবিধা হল, আমাদের দেশে এতগুলো মিনিস্ট্রি, এতগুলো এজেন্সি, এত ক্লিয়ারেন্স, এত আলোচনা যেগুলো হয়, সেগুলো ফলপ্রসূ হয় না। সেটির ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। হাতে গোনা কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করে সেটি কখনো ফলপ্রসূ হয় না। এটি যে একেবারে চট করে চলে যাবে সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। আমি দেখেছি অনেকে বলেছে, আর দুইয়েক মাস, তারপর আর কিছু নেই। আমরা হয়ত চরম সংকটে পড়ব না, তবে এখান থেকে উঠে আসতে চিন্তাভাবনার দরকার আছে। আমরা যদি কাজ করি দক্ষতার সঙ্গে তাহলে এখান থেকে উঠে আসা খুব একটা কঠিন হবে না বলেই আমি মনে করি।
লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।
আরএ/