সতর্ক না হলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা
ভারতের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে ‘রাধাকৃষ্ণ’ নামের সিরিয়ালটি সময় পেলে মাঝেমধ্যে দেখে থাকি। হংস নামের এক অসুরের ভাইয়ের নাম ডিম্বক। কৃষ্ণ একজন নারীকে (রাধা) অসম্মানের দায়ে হংসকে বধ করার পর যখন ডিম্বককে শাস্তি দিতে যাচ্ছিলেন তখন ডিম্বক কৃষ্ণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেও কৃষ্ণ তা না শোনায় রাধা ক্ষমা করে দিতে কৃষ্ণকে অনুরোধ করেন। কৃষ্ণ রাধার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি, ডিম্বক মুক্তি পায়। কিন্তু কৃষ্ণ রাধাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে ডিম্বককে ক্ষমা করে দেওয়া ভবিষ্যতে এক মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। পরে তাই ঘটেছিল। ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনার কথাই আমরা জানি।
১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শান্তি কমিটির লোকজন, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, পাকিস্তানপন্থী বেসামরিক ও সামরিক আমলা, প্রভৃতি কি ভূমিকা রেখেছিল সেসব আমরা এখনো ভুলে যাইনি। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের অধিকাংশকেই ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ওইসব স্বাধীনতা বিরোধীরা নিজেদের সংশোধনের পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী বা আওয়ামী লীগ বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের জোট ধীরে ধীরে বিস্তৃত ও শক্তিশালী হতে থাকে। আর সেই ক্ষমার জন্য জাতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে এবং এখনো নানাভাবে দিয়ে যাচ্ছে।
আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি কূটনীতিবিদ বাংলাদেশের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে পাকিস্তানের ওইসব দূতাবাস ত্যাগ করেছিলেন। অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থেকে কয়েকজন বাঙালি কূটনীতিবিদও পাকিস্তান সরকারের চাকুরিতে বহাল থেকেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে অন্তরে বিদ্যমান পাকিস্তান প্রেম নিয়েই তাদের অধিকাংশ বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে ক্ষমা করে দিলে তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। তাদের কেউ পররাষ্ট্র সচিবও হন। এমনকি, একজন বিএনপি সরকারের প্রতিমন্ত্রীও হয়েছিলেন। শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েই নয় অন্যান্য মন্ত্রণালয়েও এমন অনেকে ছিলেন। তারা বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদে আসীন হলেও মনেপ্রাণে ছিলেন পাকিস্তানি, নিজেদের বাঙালি করতে পারেননি, বাংলাদেশকে ভালোবাসতে পারেননি। যে উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ওইসব কর্মকর্তাকে শোধরানোর সুযোগ দিয়েছিলেন তা না করে তারা ভেতরে ভেতরে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধেই কাজ করে গেছেন। অবসরে যাওয়ার পর যারা এখনো জীবিত রয়েছেন তাদের আমরা একই ধারায় চলতে দেখছি।
এ ছাড়া, আরেকটি গ্রুপ ছিল নিজেদের দলের মধ্যে, অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগের মধ্যে। ওই গ্রুপে ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যারা ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানি হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন তারা এবং স্বাধীনতার পর যারা ওই পুরাতনদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এখানে তেমনি একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হচ্ছে।
১৯৭১-এর সেপ্টেম্বর মাস। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে চলছে। সাত/আট জনের একটি দলকে সঙ্গে নিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমদ দমদম বিমান বন্দরে হাজির হলেন নিউইয়র্ক যাওয়ার জন্য। তার উদ্দেশ ছিল বিশ্ববাসীকে অবগত করানো যে স্বাধীনতা নয়, বরং পাকিস্তানের সঙ্গেই বাংলাদেশ থাকতে চায়। যাহোক ভারতীয় গোয়েন্দাদের তৎপরতায় খন্দকার মোশতাকের সেদিনের ইচ্ছাটি পূরণ করা সম্ভব হয়নি, বিমানবন্দর থেকেই তাদের ফিরে আসতে হয়েছিল। ওই ঘটনা তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের না জানার কথা নয়। কিন্তু তারা কি ওই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিলেন বা কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিলেন? মোশতাককে ক্ষমা করে দেওয়া হয়, মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর সেই সুযোগের আড়ালে সে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। নিজেকে শোধরানোর কথা না ভেবে নিজের নেতাকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে মীরজাফরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যই মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। জেনারেল এম এ জি ওসমানী মোশতাকের প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিলেন। দুই সপ্তাহ পর জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে যোগ দিতে লন্ডন যায়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের এই ছিল দল ও দলনেতার প্রতি আনুগত্যের নমুনা। যে লক্ষ্য ও চেতনায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তার প্রতি আস্থার নিদর্শন।
এভাবে সেদিন যেসব পাকিস্তান-বিশ্বাসী নেতা ও কর্মকর্তাদের হাতে নবীন বাংলাদেশের দায়িত্ব দেওয়া হলো, তাদের কর্মকাণ্ড মনিটর করার কোনো ব্যবস্থা কি প্রশাসনের কাঠামোতে রাখা হয়েছিল? তারা কি বাংলাদেশকে ভালোবাসতে পেরেছিলেন? না কি তারা পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার্থে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মধ্যে থেকে কাজ করে যাচ্ছিলেন? ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা সেসব গ্রুপ যে একটি নেটওয়ার্কের মধ্যে এসে দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছিল সে খবর রাখার কি কোনো ব্যবস্থাই ছিল না? জানিনা দেশ পরিচালনার নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের চিন্তা-চেতনায় কেন এসব বিষয় ধরা পড়েনি। তারা দেখতে পেলেন না যে তাদেরই চোখের আড়ালে ঈশান কোনে অল্প অল্প করে মেঘ জমতে শুরু করেছে? না কি জানা সত্ত্বেও নিরব থেকেছিলেন?
গত ৩১ আগস্ট জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার কাছে অবাক লাগে যারা খুনিদের ক্ষমতা দিয়ে মন্ত্রী বানায়, গণতন্ত্রকে হত্যা করে সেনা শাসন আনে, এদের সঙ্গে কীভাবে অনেক মানুষ চলে গেল? আমরা বাবা-মা-ভাই সব হারিয়েছি। আমরা মামলা করতে পারিনি, বিচার চাইতে পারিনি। তাদের নিয়ে ক্ষমতায় বসায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে গিয়ে কথা বলে। আর তারাই হয়ে গেল প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে সেনাবাহিনীতে একের পর এক ক্যু হয়েছে। বহু সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। অনেকের লাশ পায়নি। ঢাকা জেলে প্রতিদিন ১০-২০টা করে হাজার হাজার সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। মামলার নামে প্রহসন হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পরে মামলা দেওয়ার ঘটনাও হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডে স্বাধীনতাবিরোধী ও যাদের আমরা পরাজিত করেছি, তাদের হাত ছিল।’
গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লায় সাত তরুণ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামে যোগ দিতে ঘর ছেড়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী জানিয়েছে। দেশের অন্যান্য এলাকা থেকেও প্রায়শই এ ধরনের খবর পাওয়া যায়। জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বা অন্যের প্ররোচনায় জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়া এদেশের তরুণদের জন্য নতুন কিছু নয়। আমাদের মনে আছে ২০১৬ সালে ঢাকার হলি আর্টিজান হামলার কথা। প্রশ্ন হচ্ছে কারা এদের উগ্রবাদের দিকে টেনে নিচ্ছে? নিশ্চয়ই তারা রাজনীতির আবরণেই আমাদের মাঝে থেকে এই তৎপরতা চালাচ্ছে। দেশের বাইরেও যে তাদের নেটওয়ার্ক রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তাই দেশের অভ্যন্তরে যারা মূলহোতা হিসাবে কাজ করছে তাদের উৎপাটন করতে না পারলে এ ধারা চলতেই থাকবে।
ষড়যন্ত্রকারীরা যে এখনো এদেশের মাটিতে বিরাজ করছে না তা কি কেউ বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন? নিশ্চয়ই না। আমাদের মনে রাখতে হবে তাদের তৎপরতা কিন্তু থেমে নেই। যে কোনো সময়ই ছোবল মারতে পারে। ঘরের ভেতর যেমন ষড়যন্ত্রকারীরা রয়েছে, তেমনি বাইরে থেকে ইন্ধন যোগানই নয় সার্বক্ষণিক সমর্থন ও সহযোগিতা দেওয়ার সংযোগও রয়েছে। সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কিছুটা সজাগ থাকলেও জানিনা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের অভ্যন্তরে এ সব কাজকর্ম মনিটর করার কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা রয়েছে কিনা। বাস্তবতা হলো, নানা অবয়বে ওইসব লোক সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্থান ধারণ করে ছড়িয়ে রয়েছে, নির্বিঘ্নে নিজেদের করণীয় করে যাচ্ছে যারা দেশ চালাচ্ছেন তাদের সহযোগিতায় তাদেরই আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে। নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সেদিন এটা যেমন সত্য ছিল, এখনো একই স্রোতে তা বহমান রয়েছে। আমরা শুধু অঘটন ঘটলেই জানতে পারি তার ব্যাপকতা এবং ধ্বংসমাত্রা। আর ভুক্তভোগী খেসারত দিয়ে যান তার লোকজনদের উপর সরল বিশ্বাসের প্রতিদান হিসাবে।
বলতে দ্বিধা নেই যে শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সরকারের প্রশাসনের ভেতর লুকিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তিগুলোও নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের গোপনীয়তা পাচার করছে। সংখ্যায় এখন তারা কিন্তু মোটেও কম নয়। তাদের ভেতরের আসল চেহারা ঢেকে রেখে সরকা্রের (এমনকি প্রধানমন্ত্রীর) কাছে তাদের নিজেদের লোক হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। এর পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন উপরের স্তরের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বা সরকারের ঘনিষ্ঠ আমলারা। গত কয়েক দশক ধরেই এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। এসবক্ষেত্রে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে ব্যক্তি সম্পর্ককেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। আসল পরিচয় আড়ালে রেখে এসব লোক সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যে কারো কোনো ক্ষতি করবে না বা বড় কোনো বিপর্যয় ডেকে আনবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? তাই সতর্ক না হলে যে কোনো মুহূর্তেই বিপদ ঘটার সম্ভাবনা। আর আমরা তা দেখতে চাই না।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত
আরএ/