ভারতের সঙ্গে সম্মানজনক টেকসই সম্পর্ক দরকার
ভারতের সঙ্গে আমরা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে চাই। আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য বাড়ছে। তবে ভারতে ব্যবসা বাণিজ্য বেশি বাড়ছে, আমাদের এখানে কম বাড়ছে। ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের তালিকা থেকে বাদ চলে যাবে। কাজেই আমাদের বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা থাকবে না।
সুতরাং, এখন যেমন বিনা শুল্কে আমরা ভারতে পন্যসামগ্রী নিয়ে যেতে পারি, সেই সুযোগটিও থাকছে না। সেজন্য কম্প্রিহেনসিভ ইকোনোমিক পার্টনারশিপ আমরা চালু করতে পারি, সে জন্য দুই দেশের প্রধানগণ চেষ্টা করবেন। এরপর যে জায়গাটিতে আমাদের আসল কাজটি, আমরা কী করে আমাদের স্বার্থকে সংরক্ষণ করে ভারতে বিনিয়োগ পেতে পারি, আমাদের পন্য রপ্তানি বাড়াতে পারি, যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভারতসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে কীভাবে করতে পারি, সেটিও কিন্তু আমাদের জন্য বিশেষ বিবেচনার বিষয়। কারণ, হলো যে, অর্থনীতি যদি চালু না থাকে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অথবা যোগাযোগে যদি আমরা উপকৃত না হই, তাহলে সেটি খুবই ক্ষতির কারণ হবে। কাজেই অর্থনীতির জায়গাটিতে বাংলাদেশ যেন তার রপ্তানির মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। সে জন্য ভারত থেকে বিনিয়োগ বলেন, যোগাযোগ বলেন, সব সহযোগিতা যেন আমরা পাই, সে বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে। সেই ভিত্তিতেই আমাদের দুই দেশের স্বার্থ এবং আমাদের নিজেদের স্বার্থ দুটি বিষয়কে মাথায় রেখেই আমরা ভবিষ্যতে আলোচনা করব।
আমরা জানি বাংলাদেশ নদীমতৃক দেশ। নদী আমাদের প্রাণ। আমরা জানি ভারতের সঙ্গে আমাদের ৫৪টি নদী আছে। ৫৪টি নদীর মধ্যে একমাত্র গঙ্গা নিয়ে একটি চুক্তি হয়েছে এবং সেটিও ২০২৬ সালে শেষ হয়ে যাবে। তাই এসব কাজে আমরা আরেকটু সৃজনশীল হতে পারি। কোনো জায়গাতে আমরা উভয়পাক্ষিকভাবে নতুন কিছু করতে পারি কি না, সেটি বিবেচনার বিষয় আসবে। অন্যান্য ৫৩টি নদীর মধ্যে তিস্তা চুক্তিটা একটি হতাশার জায়গা। তিস্তাকে আলোচনার এজেন্ডা থেকে বাদ দেওয়ার প্রবণতা আমরা দেখেছি।
তিস্তা নিয়ে কোনো অগ্রগতি হবে বলে আমি মনে করছি না তবে সেটি দেখার বিষয়। কুশিয়ারা নিয়ে খানিকটা অগ্রগতি হবে হয়ত। তারপরও কিন্তু ৫১টি নদী থাকে। এইসবগুলো নদীর সঙ্গে কিন্তু জলবায়ু সংশ্লিষ্ট থাকে। কারণ, এই নদীগুলি বহমান আছে বলেই কিন্তু সমুদ্রের লোনা পানি ছেড়ে রাখতে পারছি। সেই বিবেচনায় আমি মনে করি যে, অন্যান্য নদীগুলো নিয়েও ভাবনার দরকার আছে এবং দ্রুতগতিতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এসব কিন্তু জনমনে বিভ্রান্তি ও হতাশা তৈরি করতে পারে। আমরা যেকোনো সম্পর্কেই যদি প্রশ্ন করতে চাই, তাহলে তার সবকিছুর সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। জনগণের স্বার্থই সরকার বাস্তবায়ন করতে পারে।
আমি মনে করি, যেহেতু আমরা নিকট প্রতিবেশী, যেহেতু আমাদের উভয়ে উভয়কে প্রয়োজন, যেহেতু আমাদের সম্পর্ক বহুমাত্রিক, যেহেতু আমরা একই ধরনের চ্যলেঞ্জ মোকাবিলা করি, সেক্ষেত্রে দুই দেশের সহযোগিতা পারস্পরিক ভিত্তি, পারস্পরিক সম্মান, উভয়ের জন্যই প্রয়োজন। উভয়েই ভবিষ্যতমুখী টেকসই অ্যাপ্রোচ নিয়েই কিন্তু ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ককে দেখা উচিত। আমি মনে করি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে গিয়ে এই বিষয়েই সমাধানের পথ খুঁজে বের করবেন ।
আরেকটি বিষয় আমি উল্লেখ করব, সেটি হচ্ছে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড। যতকিছুই আমরা করি না কেন, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বিষয়টিকে মানুষ ভাল চোখে দেখে না। এটি একেবারেই একটি নেতিবাচক ধারণা মানুষের মধ্যে জন্মলাভ করেছে। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অনেকবার বলা হয়েছে, অনেকবার অঙ্গীকার করেছেন। আমি মনে করি এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখা উচিত। মানুষ যদি দেখে যে, আমার মানুষ মারা হচ্ছে, সেখানে অনেককিছু দিয়ে আপনি যদি বোঝাতে চান, মানুষ কিন্তু গ্রহণ করতে চাইবে না। কাজেই আমাদের পারস্পরিক স্বার্থেই এই বিষয়টিতে আমাদের আরও বেশি মনযোগী হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
প্রধানমন্ত্রীর ভারতে সফরে এই বিষয়গুলোই প্রাধান্য পাবে এবং মানুষের আগ্রহের কথা বিবেচনা করেই আমরা সমাধানের দিকেই যাব। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের পরস্পরকে পরস্পরের প্রয়োজন আছে এবং পারস্পরিক সম্মানজনক ভবিষ্যতকে সামনে রেখে টেকসই সম্পর্ক তৈরি করা প্রয়োজন আছে। উভয়পক্ষের চেষ্টায় কেবল সেটি সম্ভব হবে। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর এই সফরটি একটি ক্যাকারিস্টের ভূমিকা পালন করবে আমি সেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত