আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে গুরুত্ব দিতে হবে
প্রধানমন্ত্রীর এই সফরটি একটি রুটিন সফর। এটি একটি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১০ সালে যখন ভারত সফরে গিয়েছিলেন, তখন থেকেই কিন্তু ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কটি একটি নতুন গতি লাভ করে এবং গত দশ বছর ধরে আমাদের সঙ্গে ভারতের বেশ কয়েকটি সেক্টরে সহযোগিতার একটি ক্ষেত্র ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে, সেই ক্ষেত্রগুলোর উন্নয়ন হলে আমরা তাদের থেকে সুবিধা পেতে পারতাম একইভাবে ভারতও লাভবান হতে পারত। সেখানে আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি।
বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কটি ধরে একটি কূটনৈতিক ইনোভেশন তৈরি করতে চেষ্টা করেছে। ২০১০ সালে আমরা যখন ভারতের জন্য মংলা সমুদ্র বন্দরকে উন্মুক্ত করলাম তখন এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আমরা ভারতের সঙ্গে একটি অসাধারণ উদ্যোগ, একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করলাম।
পাশাপাশি আমরা নেপাল এবং ভুটানকেও এই বন্দর ব্যবহারের একটি সু্যোগ আমরা করে দিলাম। তার মানে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জন্য একটি উন্মুক্ত ব্যবসা বাণিজ্যের পথ সৃষ্টি করে দিল। আমরা যারা দক্ষিণ এশীয় দেশ তাদের মধ্যে আদান প্রদান বাড়বে, যোগাযোগ বাড়বে এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কটি আরও বেশি সুষম হবে। ২০১০সালের ওপেন রিজিওনাল জোনের কনসেপ্ট থেকেই কিন্তু বিবিআইএম এর ধারণাটি প্রথম সঞ্চারিত হয়।
এখন যেটি হয়েছে, ভারত বাংলাদেশের যোগাযোগ বেড়েছে। কিন্তু নেপাল ভুটানকে সংশ্লিষ্ট করে এই যোগাযোগের মাত্রাটি আমরা বৃদ্ধি করব ভেবেছিলাম, সেটি কিন্তু এখনো হয়নি। বাংলাদেশ এখনো বিশ্বাস করে, এ ধরনের যোগাযোগ বৃদ্ধি পেলে সেটি সকলের জন্যই উপাদেয় হবে। আমরা কিন্তু তারই ধারাবাহিকতায় নেপাল, ভুটান, ভারত ছাড়াও পূর্বদিকে মিয়ানমার এবং আশিয়ানদের সঙ্গে এমনকি থাইল্যান্ডের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়ানোর প্রস্তাব কিন্তু আমরা দিয়ে রেখেছি। কাজেই শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ সেই উদ্যোগটি নিয়েছিল। প্রায় দশ বারো বছর পরে সেই বিষয়গুলোর কতটুকু অগ্রগতি হলো, সেটি মূল্যায়নেরও একটি প্রয়োজন আছে। আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রী যখন বসবেন, তখন আসলে সেই ইস্যুগুলোতেও আমরা ঠিক কোথায় আছি সেটিরও একটি পর্যালোচনার একটি বিষয় আছে এবং সেটি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। সেক্ষেত্রে এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে সামনে আমরা কতদূর যেতে পারি সেটিও ভেবে দেখার দরকার আছে। ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের একটি বড় ধরনের জটিলতা ছিল নিরাপত্তা সম্পর্ক।
এ ছাড়াও আমরা কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থেই সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুগুলোতে সহযোগিতা করছি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, সেটিকে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া যায়। এখানে আমার ধারণা খানিকটা চিন্তার সুযোগ কিন্তু আছে। আমি এখানে একটু সতর্ক হয়ে কাজটি করার পক্ষে । তার কারণ হচ্ছে যে, সাম্প্রতিককালে ভূরাজনৈতিক যে পরিবর্তন হচ্ছে, সেখানে আমরা কিন্তু কোনো রকম সামরিক ব্যবস্থায় অংশ নেইনি অথবা নেব না এ রকম একটি সিদ্ধান্ত আমরা নিয়ে রেখেছি।
কাজেই নিরাপত্তা কাজে নিশ্চয়ই আমরা পারস্পরিকভাবে সহযোগিতা করব। কিন্তু আমরা যেন এমন কোনো কাজে না জড়াই, যেটি ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের সামরিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে না ফেলা হয়। এটির জন্য আমাদের চিন্তা ভাবনা থাকতে হবে। সেটি নিশ্চয়ই আমাদের কূটনৈতিক নীতি নির্ধারক যারা আছেন তারা চিন্তাভাবনা করবেন। আমরা ইতিমধ্যেই জানি, চীনের সঙ্গে ভারতের, চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, এদিকে ভারত মহাসাগরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি বিষয়গুলো কিন্তু আমাদের সঙ্গে পরিচিত।
এক্ষেত্রে আমাদের নিরাপত্তার জায়গাটিতে, আমরা যেমন ভারতের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করার জন্য কাজ করব, ভারত আমাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য কাজ করবে, কিন্তু আমরা যেন সামরিক প্রক্রিয়ার মধ্যে জড়িয়ে না পড়ি সেদিকটিতে আমাদের সাবধান থাকতে হবে।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত