জনসংখ্যাধিক্যের সমস্যা
সবকিছুরই একটি সর্বোচ্চ বহন ক্ষমতা আছে। তা অতিক্রম করলে প্রবল চাপ, যন্ত্রণা এবং শেষে ভাঙন দেখা দেবে। আমাদের দেশে বলা হচ্ছে টিএফআর অনেক কম এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ। তাই চিন্তার কিছু নেই এবং ৫৬ হাজার বর্গমাইলে ১৮ কোটি মানুষ জনসম্পদ। আমাদের মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ, বিচারকের সংখ্যা ২২০০ এর মতো এবং আইনজীবীদের সংখ্যা ৯১ হাজারের কাছাকাছি। ৭ বছর আগে এই মামলার সংখ্যা ছিল ৩০ লক্ষ।
বিশেষ করে জমির উপর বর্ধিত জনসংখ্যার বেআইনি প্রবেশের ফলে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ভীতিকরভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলখানায় ধারণক্ষমতার চাইতে ২.৫ গুণের বেশি মানুষকে আটকে রাখতে হচ্ছে ১২-১৪ বছর পর্যন্ত। কারণ পুলিশ ও বিচারকদের প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও মামলা তদন্ত করে রায় প্রদান করা পর্যন্ত সময় লাগছে কয়েক বছর এবং রায় কার্যকর হতে সময় লাগছে ৮-১২ বছর পর্যন্ত। মামলা জট এবং তাতে জড়িত বিপুল সংখ্যক মানুষের নাম, অপরাধের ধরণ ও ধারা, পিতা-মাতার নাম, ঘটনাস্থল, সাক্ষী, আলামত ও অন্যান্য উপাত্ত নিশ্চিত করে এর কম সময়ে বিচার কাজ করা অসম্ভব।
শাজনিন খুনের মামলার রায় কার্যকর হতে ১৮ বছর এবং আহসান উল্লাহ্ মাস্টার খুনের মামলার রায় কার্যকর হতে ১২ বছর সময় লেগেছিল। তারা ছিলেন প্রতাপশালী মানুষ কিন্তু নির্দোষ। সাধারণ বিচার প্রার্থীদের অবস্থা কেবল অনুমেয় নয় বরং দেখা যাচ্ছে। এতটুকু ভূমিতে ১৭ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ (প্রায় এক কোটি প্রবাসী), শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যানবাহন, চলাচল এবং বিনোদন দিনে দিনে কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। কারণ বছরে ২২ লক্ষ মানুষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন অত্যন্ত দুর্গন্ধপূর্ণ হয়ে উঠছে।
জলাবদ্ধতা কার সৃষ্টি? সমৃদ্ধির অনুসঙ্গ টায়ার-টিউব, শক্তবর্জ্য, শিল্পবর্জ্য, প্লাস্টিক ও চিকিৎসাবর্জ্য কোথায় রাখব? গৃহে তো দূরের কথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ কোথায় বানাব? একটি ফ্ল্যাটে ২০ তলায় শিশু আছে অন্তত ৪০ জন। খেলার জায়গা নিচে খুব বেশি হলে আছে ২০ ফুট। যা রাত ১২টা-১টা পর্যন্ত যানবাহন দিয়ে ভরা। তাদের কেউ কেউ তাই খেলছে বাইরের রাস্তায় এবং তাতে গাড়ির কাচ ও গৃহের জানালা ফেটে বচসা এবং অশ্লীল ভাষা বিনিময়ের ঘটনা ঘটছে। খ্রিস্টান ধর্মে বলা হয় মৃতের সৎকার হচ্ছে ‘এ ডিসেনট বেরিয়াল’। এতে মানুষের শেষ মর্যাদা নিহিত আছে। আর আমার শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলামের অনুসারী বাঙালি মুসলমানকে কবর দেওয়ার জন্য নানা স্থানে তদবির করতে হয়। কবরের জমি কিনতে চাইলে তার দাম এক কোটি ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রদান করতে হয় এবং তা দুলর্ভ। ফলে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে পুরোনো মৃতের হাড়-গোড় এবং দূষিত ভগ্নাবশেষের সঙ্গে কবরস্থ করতে হচ্ছে।
এভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এই অমর্যাদা এবং অসম্মান বাড়তে থাকবে। সিকাটুলী পুকুর কি রক্ষা করা গেছে সর্বাত্মক আন্দোলন করেও? ৩ দিনের ছুটিতে ৩৯৮ জনের প্রাণহানি কী তদন্ত কমিটি করে সুরাহা করা যাবে? বছরের অন্তত ১২টি দিন পোকামাকড়ের মতো বিস্তারে ট্রেন, বাস, ট্রাক এবং বিভিন্ন জলযানে চড়ে মানুষ যেভাবে যাতায়াত করেন তা কি মর্যাদার নাকি নিরাপত্তার? পাকা জায়গা বৃদ্ধি পাচ্ছে কারণ গৃহ নির্মাণ, তাহলে বৃষ্টির পানি মাটির ভেতরে ঢুকবে কি করে? গাছ লাগাব কোথায়? অক্সিজেন কমছে, তাপ বাড়ছে, ছায়া কমছে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাড়ছে।
দুটি ১২ তলা বা ২০ তলা ভবনের মধ্যেবর্তী স্থানে ফায়ার ব্রিগ্রেড যে প্রস্থের রাস্তা চায় তা এখন কতটুকু অবশিষ্ট আছে? ড্রেনের বর্জ্য ঠিকাদাররা ড্রেনের পাকা পাড়ের উপর ফেলে রাখেন। কেবল তো দোষ দিলে হবে না সেগুলো রাখার জায়গা কোথায় আছে? বুড়িগঙ্গার পানিতে গৃহস্থলী, ধোপার এবং শিল্পবর্জের এক বড় অংশ গিয়ে পড়ছে। জলযানের এবং যাত্রীর ব্যবহৃত বর্জ্যের স্থানও বুড়িগঙ্গা। এগুলো ফেলার জায়গা কোথায়? এটি পারস্পরিক দোষারোপ করার বিষয় নয়। এটি সক্ষমতার বিজ্ঞানসম্মত বিবেচনার বিষয়।
যারা কাজ করেন তারা যে কতটা অতিষ্ঠ— তার একটি প্রমাণ এই যে, কয়েক বছর আগে এক বড় কর্তা বলেছিলেন যমুনা থেকে পানি এনে বুড়িগঙ্গার পানি দূষণমুক্ত করা হবে। আমরা নানা বিষয়ে অতীতের কর্তৃপক্ষের দোষ দিয়ে বলি যে সঠিক নগর, শিক্ষা, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ইত্যাদির সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছিল না বলেই আজ এই অবস্থা। আবার কেউ বলেন, একটি বসবাসযোগ্য জনপদ রেখে যাব বা গড়ে তুলব, তার মানে তার এই অনুভূতিটি হচ্ছে যে, এটি বসবাস যোগ্য নয়। ধানমন্ডির আবাসিক এলাকাকে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন ইটের বস্তি। এইসবের প্রধান কারণটি কী?প্রায়ই বলি যে কোনো স্থানে ছিল উপচে পড়া ভিড়। তো এইভাবে মানুষ বাড়লে এই ভিড় কি কমবে নাকি বাড়বে? তারপর সমৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথা প্রতি ২ হাজার মার্কিন ডলার গড় আয় বাড়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগত যানবাহন এখনো কিছুই বাড়েনি। এটির গড় এখনো ০.২৫টি, উন্নত দেশে সেটি গড়ে প্রায় ০৩ টি। মানুষের সমৃদ্ধি যে বৃদ্ধি পায় তার লক্ষ্য ব্যাংকে ২ কোটি টাকা সঞ্চয় রেখে ঘর্মাক্ত গণপরিবহনে চড়ার লক্ষ্যে নয় বরং একটি সু-শীতল মোটরগাড়িতে চড়বার জন্য। তো এই জনসংখ্যায় ব্যক্তিগত গাড়ি সামান্য সংখ্যক বৃদ্ধি পেলেও চলার গতি কী হবে? আশ্চর্যজনক যে এ নিয়ে ড. ইউনুসের মতো মানুষও একটি মন্তব্য করেননি। এখন ঢাকা শহর তো বটেই টঙ্গী, জয়দেবপুর ও নারায়ণগঞ্জ এর মতো স্থানেও রাস্তা এবং রেলওয়ে স্টেশন এর দুপারে মাইলের পর মাইল বর্জ্যের স্তুপে পরে থাকে কর্তৃপক্ষের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও, কারণ স্থানের অভাব। কোথাও কোথাও ১৪ থেকে ৮৫ মাইল লম্বা যানযট মহাসড়ক গুলোকে স্থবির করে রাখছে। এবং বিভিন্ন শহরে যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় এখন সাড়ে ৪ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে।
যারা বলেন জনসংখ্যা জনসম্পদ তাদের স্ব-বিরোধী অবস্থান প্রায় স্পষ্ট হয়ে উঠে। যখন দেখি সরকারি টিভিতে তো বটেই বেসরকারি চ্যানেলেও পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলা হচ্ছে একটি সন্তান থাকলে আর নয়, দুটি থাকলে কখনোই নয়। তাহলে এই সম্পদবীদদের মতে জনসম্পদ কোন পর্যন্ত? এটি কি ১৮ কোটি, ২০ কোটি, ২২ কোটি নাকি ৪০ কোটি, তা বলেন না কেন তারা। জনসংখ্যা যদি জনসম্পদই হবে তাহলে এই সম্পদ কমানোর জন্য এই প্রচেষ্টা কেন? মানুষ তো চায় সম্পদ বৃদ্ধি করতে। মাত্র ১২/১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা জনসম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের এতো প্রচেষ্টা কেন? গাড়ি পার্কিং নিয়ে প্রতিদিন চারশত বর্গমাইলের প্রায় সর্বত্র যে অশ্লীল এবং কুৎসিত কলহ হয় তা হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ? কেউ অপরাধ করতেই পারেন কিন্তু নূন্যতম নৈতিক প্রত্যাশা হচ্ছে এই যে, তাকে বিচার করে নির্দোষ/দোষী প্রমাণ সাপেক্ষে কারাগার থেকে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু সাধ্যের অতীত মামলাভার থাকার ফলে অভিযুক্তদের আটকে রাখতে হচ্ছে। ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা মুজিব বলেছিলেন, আজ বড় দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় একটি ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তি হতে ২ বছর সময় লাগে। এর প্রধান কারণ জন্যসংখ্যাধিক্য।
আমাদের অবশ্যই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আজ যখন নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন মামলার শাস্তি ৮ বছরেও বাস্তবায়ন করা যায় না সে অবস্থা দেখলে জাতির পিতা তো শোকে মূর্ছা যেতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩০ এর দশকে বলেছিলেন আমাদের জন্মশাসন করতেই হবে। এই দুজনের প্রতিভা অপর যে কোনো বাঙালির চেয়ে আলোকবর্ষ দুরের কিন্তু এখন মনে হয় আমরা অনেকেই এই দুজনের চেয়ে বেশি বুঝি। গায়ে গায়ে ধাক্কা দিয়ে পদপথ, ড্রেন, রাস্তা, মহাসড়ক, হাট-বাজার, শিক্ষালয়, চিকিৎসালয় ও যানবাহন তথা সর্বত্র চলা মানব মর্যাদার পরিপন্থী। মানুষ বন্যপ্রাণী, গাছ বা আসবাবপত্র নয়।
দুজন মানুষের মধ্যে অবশ্যই ব্যক্তিগত শালীন দূরত্ব বজায় রাখা অত্যাবশ্যক। অন্তত এই দিক বিবেচনা হলেও জনসংখ্যাকে কমিয়ে আনার ব্যাপক উদ্যোগ সমাজের সর্বনিম্ন ইউনিট থেকে গ্রহণ করতে হবে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, বর্ধিত জনসংখ্যার ব্যবহৃত জ্বালানি তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। ঢাকা শহরে ৫০ লক্ষ লোকের জীবন-যাপন সম্ভব অথচ সেখানে আছেন প্রায় সোয়া ২ কোটি। এমনি ৫৬ হাজার বর্গমাইলে ইউএনএফপি এর মতে যে জনসংখ্যা হওয়ার কথা তা করার দীর্ঘমেয়াদি এবং স্বল্প মেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বড় মুনাফার জন্য প্রয়োজন বড় বাজার, বড় বাজারের জন্য প্রয়োজন বিপুল মানুষ, এই নীতিতে বিশ্বাসী যারা আছেন— সরকার যেন তাদের সঙ্গে নিয়ে এর একটি সমন্বয় করে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেন। এই প্রত্যাশা করি। আমাদের অনেকে পট করে বলে ফেলেন যে, বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে এই সমস্যার সমাধান। ঢাকায় আমার জীবিকা এবং একটি ফ্ল্যাট বা বাসস্থানের মালিক। এই ধরনের মানুষদের বিকেন্দ্রীকরণ করে ঢোলসমুদ্র বা আন্ধারমানিকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তাদের ঢাকার ফ্ল্যাটে কেউ তো থাকবেন এবং যানবাহনও থাকবে। তাহলে এর ফল তো শূন্য। আর তুঘলকী আইন প্রয়োগ করে বাড়ির মালিকদের বাইরে পাঠিয়ে দিলে এই বাড়িগুলোর ব্যাংক ঋণ, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল এবং করপোরেশন ও আয়কর কে বহন করবেন?
আমরা কোনোভাবেই জাতির পিতা বা রবীন্দ্রনাথের মেধার ধারের কাছেও অবস্থান করি না। তারা দুজনেই সমষ্টির স্বার্থ বুঝতেন। একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে গেলে প্রকৃতিও একসময় আমাদের বিরুদ্ধে যাবে। আকাশ ছিদ্র হয়ে গেছে বা ১২ হাজার মাইল দূরের সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের দুর্দশার জন্য দায়ী- এ কথা দীর্ঘদিন বলা যাবে না। রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাই জনসংখ্যা কমানোর উদ্যোগ চালু রাখতে হবে। মুনাফার দিকে আমরা উদাসীন নই। তাই সন্তান সংখ্যা কম করার প্রলোভন দেখিয়ে এবং তাতে নানা রকম প্রণোদনা দিলে তা ফলপ্রসূ হবে বলে আশা করা যায়। অন্ততপক্ষে মানব মর্যাদার পরিপন্থী গায়ে গায়ে ধাক্কা দিয়ে চলা এবং অমর্যাদাকর শেষ কৃত্য রোধ করার জন্য হলেও দেশের জনসংখ্যা কমাতে হবে।
লেখক: মাসুদ আহমেদ, গল্পকার
আরএ/