অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ উন্নয়নের খেসারত দিতে হচ্ছে
দেশের শতভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছানো সরকারের লক্ষ্য ছিল। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে শতভাগ বিদ্যুতায়নে সরকারের ঘোষিত কর্মসূচি শেষ হলো বলা যায়। কিন্তু সবাই বিদ্যুৎ পেল কি না, সেটি এখন বিবেচ্য বিষয়। জ্বালানি তেল, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে ভর্তুকি দিয়ে এবার গ্রীষ্ম মৌসুমে চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে না বলে ধারণা করা যায়।
এখন আমাদের সামনে দুটো চ্যালেঞ্জ আছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের পরও উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে লোডশেডিং করা হতে পারে। আর যারা বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় থেকেও সংযোগ নিতে পারছে না, তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো।
বিআইডিএসের এক গবেষণা বলছে, বিচ্ছিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা গেলেও ১৫ শতাংশ জনগণ সংযোগ নিতে সক্ষম নন। বিচ্ছিন্ন চরে বিদ্যুৎ সুবিধা পেয়ে ওই জনপদের মানুষ নানা অর্থনৈতিক কাজ করার সুযোগ পাবে। জ্বালানির উচ্চদামের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিচ্ছিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া গ্রাহকরা। করোনা পরিস্থিতিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয় আরও কমে গেছে। এ অবস্থায় শতভাগ মানুষের বিদ্যুৎ–সংযোগ পাওয়া ও শতভাগ মানুষকে লোডশেডিংমুক্ত রাখা সরকারের জন্য চরম চ্যালেঞ্জ হিসেবে অপেক্ষা করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশ এসেছে বেসরকারি খাতের অবদান থেকে। চাহিদার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতা বিদ্যুৎখাত উন্নয়নের সূচক হতে পারে না। কারিগরি বিবেচনায় এটি অপরিকল্পিত, অগ্রহণযোগ্য ও অযৌক্তিক উন্নয়ন। যার ফল অনেকটা বাড়তি দাম দিয়ে এখন ভোগ করছি ভবিষ্যতেও করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের অধিকাংশ সক্ষমতাই কয়লা, গ্যাস ও তরল জ্বালানিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতায় চাহিদা অনুসারে জ্বালানি সরবরাহ করতে না পারার কারণে উৎপাদন সক্ষমতার সিংহভাগই উৎপাদনহীন থেকে যাবে। এ অবস্থায় এটা জাতির জন্য বোঝা হবে। বেসরকারিখাতে উত্তরোত্তর ভাড়া অব্যাহত রাখতে হবে। এটি ভোক্তা ও সরকারের জন্য অসহনীয় হবে বলে শঙ্কা আছে।
উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন এগোতে পারেনি। এর জন্য খেসারত দিতে হচ্ছে। দুই বছর ধরে উৎপাদন করলেও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে শতভাগ বিদ্যুৎ নেওয়া যায়নি। ঢাকায় আনার জন্য সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হয়নি নির্ধারিত সময়ের পরও। প্রতি মাসেই কোটি কোটি টাকার কেন্দ্র ভাড়া দিতে হচ্ছে। এমন করেই অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ উন্নয়নের খেসারত দিতে হচ্ছে। ভোক্তারা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না, সেটি দেখার বিষয় আছে। স্থানীয়ভাবে সরবরাহ করার জন্য অঞ্চলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা সরকারের জাতীয় কৌশলেই আছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে সেই বিবেচনা থেকে। এ কেন্দ্র থেকে ওই অঞ্চলের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো যেত। এতে সেখানকার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর প্রয়োজন হতো না। ঢাকায় আনার সঞ্চালন লাইন তৈরির বিষয়টি ব্যয়বহুল ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের নমুনা।
বর্তমানে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে, তার জন্য সঞ্চালন লাইনে ঘাটতি নেই। প্রক্ষেপণ অনুসারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়েনি। এটিও আমাদের জন্য অশনিসংকেত। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা না থাকায় এসব খাতের বড় অংশ নিজস্ব উৎপাদিত ক্যাপটিভ বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীল রয়ে গেছে। তাই বিদ্যুৎ সরবরাহের জাতীয় গ্রিডে চাহিদা বাড়েনি। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঞ্চালন লাইন বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল। এ খাতে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার পরিকল্পনার কথাও শোনা গিয়েছিল। এটি হলে আরও ভয়াবহ ব্যাপার। এটা এখন সোনার হরিণ বলা যায়। যা শোনা যায়, দেখা যায় না। সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়ার বিষয়টি ভোক্তার জন্য এমনই বলে মনে হয়।
লেখক: জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাব
আরএ/