পদ্মা সেতু: টেকসই অগ্রগতির পথ
পদ্মা বাংলাদেশ বহুলভাবে ব্যবহৃত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বড় নদী। হিমালয়ের পাদদেশে গঙ্গোত্রী থেকে পদ্মার জন্ম । ভারতে গঙ্গা নামে এই নদীকে ডাকা হয়। নদীর অন্য ধারাটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নাম ধারণ করে প্রবাহিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশের আরও একটি বড় নদী মেঘনার সঙ্গে মিশে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে গেছে।
পদ্মার লাল ডোরা রুপালি ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হিসেবে স্বীকৃত যা এই নদীতেই পাওয়া যায়।পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম খরস্রোতা নদী হলো এই পদ্মা । ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীটি তীব্র স্রোতের মাধ্যমে প্রায়ই গতি পরিবর্তন করে। বর্ষাকালে ভরা মৌসুমে প্রতি সেকেন্ডে ২৬ লাখ ঘনফুট পানি প্রবাহিত হয় পদ্মা নদীতে ।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগের প্রধান অন্তরায় ছিল পদ্মা নদী। প্রচন্ড খরস্রোতা পদ্মার ১১২ মিটার গভীরে পিলার নির্মাণের ভিত্তিতে পদ্মা সেতু কাঠামোগত প্রকৌশলের এক বিস্ময় হিসেবে এরইমধ্যে বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জন করেছে। সবচেয়ে বড় বাধা ছিল দু-দুবার পিলার গুলো তীব্র স্রোতে ভেসে যাওয়া। অবশেষে মোটা ইস্পাতের পাইপ ও বিশেষভাবে তৈরি অস্ট্রেলিয়ান সিমেন্টের মিশ্রন নদীর তলদেশের মাটিতে গ্রথিত করা সম্ভব হয় ।সেতুটি অন্তত ১০০ বছর দীর্ঘস্থায়ী সেবা দিতে পারবে। বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ার ও ব্যবস্থাপকরা সুদক্ষভাবেই সেতু নির্মাণ করেছেন এবং এমনিভাবে পরবর্তী তদারকিও করতে পারবেন। সেতুটির দুই ধারে সংযোগ সড়ক প্রায় ১২ কিলোমিটার লম্বা—জাজিরা প্রান্তেই ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটারের চেয়ে বেশি।
পদ্মা সেতু ব্যাপক শিল্পায়নের মাধ্যমে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় ২১টি জেলাকে দ্রুতগতি উন্নয়নের বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত করবে। অনেক লবণাক্ত জমি পুনরুদ্ধার এর মাধ্যমে উর্বর হয়ে অতিরিক্ত ফসল ফলাবে । হিমায়িত মৎস্য আর নয় বরং রান্না করা সতেজ মাছ সুন্দর প্যাকিং এর মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য আয় বাড়বে বহুগুণ । নবজীবন পাবে ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, হস্ত ও কুটির শিল্প। উৎপাদন বৃদ্ধি করে আয়-রোজগারের অগ্রগতি ও কর্মসংস্থানে ভরে উঠবে । কুয়াকাটার মতো আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্রে ঘটবে প্রাণসঞ্চার এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত হবে শতশত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জনগণ। দ্বিতল সেতুর উপরিভাগে চার লেনের সড়ক আর নিচের ডেকের রেল সংযোগ উত্তরণ ঘটাবে সুদুরপ্রসারি আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুনরুত্থানের টেকসই ও জোরালো হাওয়া। কৃষি, মত্স্য ও দুগ্ধখাতে উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সৃষ্টি করে হিমাগারে ধারণক্ষমতা ২০ লাখ টন থেকে অন্তত ৩০ লাখ টনে উন্নীত করা যায়, তবে আরেকটি কৃষি শিল্প বিপ্লব আনা সম্ভব হবে। এভাবেই শিল্প বিপ্লব কে উৎপাদনশীল জীবনধারণে পাল্টে দিয়ে জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ড বিস্তৃতি লাভ করবে। উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে।
সুশাসন নিশ্চিত করণের মাধ্যমে হিমাগারে পণ্য সংরক্ষণ অগ্রাধিকার দিলে বছরব্যাপী পণ্যসম্ভার বাজারে আসবে। মূল্য থাকবে স্থিতিশীল। উৎপাদনকারী ন্যায্যমূল্য পাবেন । দ্রুতগামী যানবাহন ও রেল-এর মাধ্যমে পদ্মা সেতু দিয়ে পণ্য সামগ্রী ও কাঁচামাল ভোক্তা ও শিল্প কারখানায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে । ভোক্তারাও ন্যায্যমূল্যে কিনতে পারবেন। সংশোধিত টোল ভাড়ায় ৩৫ বছরে পদ্মা সেতুর খরচ উঠে আসবে। গতিময় জীবন্ত পদ্মা সেতু ২০৩০ সাল নাগাদ পাঁচ কোটিরও বেশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করবে, দারিদ্র্য কমাবে এবং আয়, সম্পদ ও সুযোগ বৈষম্য কমিয়ে আনবে। সর্বোপরি এক উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ নির্মাণে এক অপার সম্ভাবনার অগ্রযাত্রার চাবিকাঠি এই পদ্মা সেতু।
লেখক: বাংলা একাডেমীর সভাপতি ও কথাসাহিত্যিক