বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের পর্যালোচনা
বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে আসছে বছরের জন্য কিছুটা সঙ্কোচনমুখী বাজেট কাম্য ছিল। তবে অংশীজনেরা আরও আগে থেকেই বলে আসছিলেন এই কাটছাটের ছাপ যেন স্বাস্থ্য খাতের ওপর না পরে। প্রস্তাবিত বাজেটে কাটছাট হয়নি। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে ৩২ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা থেকে ১৪ শতাংশ বেড়ে আসছে বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ৩৬ হাজার ৮৬৩ টাকা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, এ মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রতি বছরই একইভাবে বাড়ছে। ফলে মোট বাজেটের শতাংশ হিসেবে এ খাতে বরাদ্দ অপরিবর্তিতই থেকে গেছে। চলতি বছরের সংশোধিত এবং আসছে বছরের প্রস্তাবিত-এ দুটো বাজেটেই মোট বরাদ্দের ৫.৪ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে এ মন্ত্রণালয়টির জন্য। গত এক দশক ধরেই এই অনুপাত ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেশে স্বাস্থ্যব্যয়ের চাহিদা এবং সমতুল্য অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে বিশেষজ্ঞরা এ অনুপাত ১০ শতাংশের বেশি করার পক্ষে। আমরা আসছে বছরে মোট বাজেটের অন্তত ৭ শতাংশ এই মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ করার আহ্বান জানিয়েছিলাম।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চলতি বছরের সংশোধিত বাজেট এবং আসছে বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনাটি আরেকটু ভেঙে করা যায়। মন্ত্রণালয়ের মোট বাজেটকে পরিচালন এবং উন্নয়ন-এই দুই ভাগে ভাগ করে যদি দেখি তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, মোট স্বাস্থ্য বাজেট যেখানে ১৪ শতাংশ বেড়েছে সেখানে স্বাস্থ্যের পরিচালন বাজেট বেড়েছে ১২ শতাংশ, আর উন্নয়ন বাজেট বেড়েছে ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ উন্নয়ন বাজেটের প্রবৃদ্ধি বেশি। শুধু তাই নয় মন্ত্রণালয়ের মোট বাজেটে চলতি বছরে পরিচালনের অংশ বেশি হলেও আসছে বছরে উন্নয়নের অংশটুকু বেশি হবে। ফলে ধরে নেয়া যায়, স্বাস্থ্য খাতে সেবার আওতা ও নতুন নতুন সেবা যুক্ত করার জন্য আসছে বছরে বেশি মনযোগ দেওয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগ, অর্থাৎ স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের মধ্যে দ্বিতীয়টির বাজেটের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক বেশি হতে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মোট উন্নয়ন বাজেট ১৮ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। তবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তথা এডিপি-এর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ১৯ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। কারণ, এডিপির আওতায় এই মন্ত্রণলায়টি ছাড়া আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়/বিভাগ/ব্যুরো স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ পেয়েছে। চলতি বছরের এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের তুলনায় আসছে বছরের এডিপিতে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ ৪০ শতাংশ বেশি। প্রস্তাবিত এডিপিতে ৩টি নতুন প্রকল্পসহ স্বাস্থের জন্য মোট প্রকল্পের সংখ্যা ৫৮টি। স্বাস্থ্য খাতে এডিপি বরাদ্দের ৪৬ শতাংশ আসছে উন্নয়ন সহযোগিদের দেওয়া প্রকল্প সাহায্য থেকে।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বিশেষভাবে উল্লেখ্য বরাদ্দগুলোর মধ্যে আছে-৫টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট স্থাপন। করোনাকালে গৃহীত ‘কোভিড-১৯ ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ এবং ‘কোভিড-১৯ রেসপন্স ইমারজেন্সি অ্যাসিটেন্স’ প্রকল্প দুটো আসছে বছরে চলমান থাকছে। করোনা-পরবর্তি স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য ৫,০০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে (ইতোমধ্যে ২৬ কোটি ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে)। সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল নীতিমালা ২০২০-এর আওতায় মৌলিক গবেষণা চলমান রাখা হয়েছে এবং এ জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া অসংক্রামক রোগের সঠিক চিকিৎসায় রোগীর তথ্য সংরক্ষণের জন্য এমআইএস সফটওয়্যার সংযোজন এবং ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ অর্জনের লক্ষ্যে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নের কথা বাজেট বক্তৃতায় এসেছে।
সব মিলিয়ে বাজেট ২০২২-২৩-এ স্বাস্থ্য খাতে দেওয়া বরাদ্দকে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীলই মনে হচ্ছে। তবে এটাও মানতে হবে যে, এই বরাদ্দ আরও একটু উদার হতে পারতো। সম্পদের সঙ্কট এবং মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়নের ট্র্যাক-রেকর্ড বিবেচনায় নিয়েই হয়তো বাজেটপ্রণেতারা আরও বরাদ্দ দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, অন্যান্য খাতে এ মূহুর্তে খুব জরুরি নয় এমন বরাদ্দ আরেকটু কমিয়ে তা থেকে স্বাস্থ্যের জন্য বাড়তি বরাদ্দ নিশ্চিত করা যেতো। পুরো বাজেটে এমন কিছু কিছু মূলধন/উন্নয়ন ব্যয় রয়েছে যেগুলোতে চাইলে কাটছাট করা যায়। আর মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়নের অপারগতার কারণে কম বরাদ্দ দেওয়ার চেয়ে কিভাবে বাস্তবায়ন দক্ষতা বাড়ানো যায় সেটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।
বরাদ্দে আরেকটু উদার হলে কেমন হতো আসছে বছরের স্বাস্থ্য বাজেট? আমরা মোট বাজেটের ৫.৪ শতাংশের পরিবর্তে ৭ শতাংশ স্বাস্থ্যের জন্য চেয়েছিলাম। তা হলে স্বাস্থ্য বাজেটের আকার হতো ৪৭ হাজার কোটি টাকার বেশি (অর্থাৎ প্রস্তাবিত বরাদ্দের চেয়ে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা বেশি)। বর্ধিত বরাদ্দের অন্তত ৪৫ শতাংশ যেন প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার জন্য দেয়া হয় আমরা সে দাবিও জানিয়েছি (প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিকে বরাদ্দ মোট স্বাস্থ্য বাজেটের ৩৪ শতাংশ)। স্বাস্থ্য বাজেটের আকার উল্লিখিত মাত্রায় বাড়িয়ে তার ৪৫ শতাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় দিলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা বাবদ বরাদ্দ হতো ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি (অর্থাৎ প্রস্তাবিত বরাদ্দের চেয়ে ৮ হাজার ৭ শো কোটি টাকা বেশি)।
প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় এই বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া গেলে তার সম্ভাব্য সুফল কী হতে পারে? উন্নয়ন সমন্বয়ের বাজেট গবেষক দল সিমুলেশনের মাধ্যমে দেখিয়েছে যে, স্বাস্থ্য খাতের ‘মেডিকেল এন্ড সার্জিক্যাল সাপ্লাই’ উপখাতে বাড়তি ১,৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে পারলে, এবং ‘নগদ বেতন ও মজুরি’ উপখাতে বাড়তি ৬,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে পারলে গ্রামাঞ্চলের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের অংশ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পাবে, এবং নাগরিকদের ‘আউট-অফ-পকেট হেলথ এক্সপেন্ডিচার’ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমবে। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের নাগরিকরা স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৮ শতাংশ বহন করছেন। এভাবে বরাদ্দ দেয়া গেলে এ অনুপাত কমে ৫১ শতাংশ হতো। কাজেই দেখা যাচ্ছে আমরা যে বাড়তি ৮ হাজার ৭ শো কোটি টাকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ বাড়াতে বলছি তা দিয়ে গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাপ্রার্থীদের ‘আউট-অফ-পকেট কস্ট’ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমানো সম্ভব।
আগেই বলেছি বাড়তি বরাদ্দের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অন্তত প্রস্তাবিত বাজেটের অন্যান্য তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দে কাটছাট করেই পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবার জন্য বাড়তি আর্থিক সহায়তা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিদের কাছ থেকে পাওয়াও বাংলাদেশের জন্য খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়। বাজেট এখনও চুড়ান্ত হয়নি। সংসদের ভেতরে ও বাইরে যে আলোচনাগুলো হচ্ছে তা আমলে নিয়ে কিছুটা হলেও পরিবর্তন-পরিবর্ধনের সুযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ দরকারবোধে বরাদ্দ বাড়ানোর যে সময়োচিত ঘোষণা দিয়েছেন, সে নীতি স্বাস্থ্য খাতের জন্যও প্রযোজ্য হোক এই প্রত্যাশা রাখছি। সব শেষে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের স্বাস্থ্য বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ অব্যয়িত/অবাস্তবায়িত থেকে গেছে। এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। অন্য যে মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলো বাজেট বাস্তবায়নে তুলনামূলক বেশি দক্ষতা দেখাচ্ছে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব বলে মনে হয়। এবারে যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাশা অনুযায়ি বরাদ্দ দেওয়া যায়নি, তাই এবারের বরাদ্দগুলো বাস্তবায়নে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করতে হবে।
*লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি