পদ্মা সেতু: অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে উজ্জ্বল মাইলফলক
বাঙালির স্বপ্নের মিনার-পদ্মা সেতু চালু হতে যাচ্ছে। এটি নিশ্চয়ই নিছক স্টিলের কোনো কাঠামো নয়। পদ্মা সেতু আমাদের আবেগের নাম। আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের এক উজ্জ্বল মাইলফলক। বিপুল আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ দুই চোখ ভরে আমাদের আত্মশক্তির এই প্রতীকটি দেখছে। বঙ্গবন্ধু এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুজনেই দক্ষিণ বাংলার মানুষ। বাবার মতোই বঙ্গবন্ধুকন্যাও এই অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-কষ্ট বোঝেন। তাই ২০০১ সালের ৪ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে মাওয়া ফেরিঘাটের কাছেই এই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু সেতুটির নির্মাণ কাজ থমকে যায় রাজনৈতিক হীনমন্যতার কারণে। ২০০৯ সালে ফের ক্ষমতায় ফিরে এসে তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণকে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে অগ্রাধিকার তালিকায় নিয়ে আসেন। শুরুতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা, আইডিবি এই সেতুর অর্থায়নের অংশীদার হলেও পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক যুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণেও এই উন্নয়ন অংশীদাররা যুক্ত ছিল। তাই সরল বিশ্বাসেই বিশ্বব্যাংককে যুক্ত করেছিল বাংলাদেশ সরকার। প্রস্তাবিত ১.২ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পের অর্থায়নে শেষ পর্যন্ত সেই বিশ্বাসের দাম রাখেনি এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। অযথাই একটি নোংরা বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল মনগড়া দুর্নীতির অভিযোগ তুলে। বেলাশেষে সেই অভিযোগ কানাডার আদালতসহ কোথাও টেকেনি। বিশ্বব্যাংক ছাড়া অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদাররা খুবই বিব্রত বোধ করছিল এই অযথা অভিযোগ তোলার জন্য। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্ব তারা মানতে বাধ্য। তবুও এই প্রকল্পটি যাতে এভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে তাদের দৌড়ঝাপ আমি দেখেছি। সে সময়ের জাপানি রাষ্ট্রদূত একাধিকবার আমার সাথে দেখা করেছেন এবং বিশ্ব ব্যাংকের বাড়াবাড়ির সমালোচনা করেছেন।
সেই সময়টায় আমি খুব কাছে থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুরো ষড়যন্ত্রটা কেমন বীরত্বের সঙ্গে লড়ে ভুল করে দিলেন সে দৃশ্যও দেখেছি। খুবই দ্রুততার সঙ্গে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে নিজেদের অর্থে এই মেগা-প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে বিশ্বকে দেখিয়ে দেবেন আমরাও পারি। অর্থ বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও যখন তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আমরা বলেছিলাম, বাংলাদেশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় ঊর্ধ্বমুখী। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল। তাই বিশ্বব্যাংকের দেয় ১.২ বিলিয়ন ডলার না নিলেও আমরা আমাদের ব্যাংকিং খাত থেকে এই পরিমাণ বিদেশি মুদ্রার জোগান দিতে সক্ষম। আমরা জানতাম এই পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা এক বছরেই লাগার কথা নয়। তাই সরকার যদি টাকার জোগান দিতে পারে, আমরা ডলারের জোগান দিতে পারব। দেশবাসী জেনে খুশি হবেন যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি-সহযোগিতায় অগ্রণী ব্যাংক এরই মধ্যে ১.৪ বিলিয়ন ডলার পদ্মা সেতুর জন্য দিতে সক্ষম হয়েছে। বাদবাকি ডলারের জোগানও আমাদের ব্যাংকিং খাত দিতে পারবে। আর তা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তো আছেই। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ যে ২০১৬ সালে একটি দলীয় সভায় তিনি পদ্মা সেতুর জন্য প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রার সরবরাহের নীতি নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্রিয় ভূমিকার প্রশংসা করেছিলেন।
বলতে দ্বিধা নেই যে এত বড় প্রকল্পের অর্থায়ন বাংলাদেশ নিজেদের সম্পদ থেকেই সম্পন্ন করতে পারে সেটিই ছিল এই পদ্মা সেতু বিতর্কের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সে সময়ে প্রবাসী বাঙালিদের যে দেশপ্রেমের প্রকাশ দেখেছি তা সত্যি মনে রাখার মতো। তাদের কাছ থেকে কতো যে ই-মেইল এবং ক্ষুদে বার্তা পেয়েছি তা বলে শেষ করা যাবে না। কোন ব্যাংকের কোন হিসেবে তারা ডলার পাঠাবেন সে রকম প্রশ্নবাণে আমি জর্জরিত হয়েছি। আমাদের রোদে পোড়া পরিশ্রমী প্রবাসী কর্মীদের দেশের জন্য কিছু করার এই আকুতি সত্যি অসাধারণ। তাদের প্রতি রইলো অসংখ্য ধন্যবাদ। আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনেরাও নিশ্চয় পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের অনুষ্ঠান দেখে উদ্বেলিত হবেন। আমি নিশ্চিত যুগে যুগে বাঙালির কাছে ইতিহাসের এই মুহূর্তটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আবেগ ও উচ্ছাস বাদেও পদ্মা সেতুর প্রভাবে বাংলাদেশের, বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতির ওপর কি ধরনের প্রভাব পড়বে সে বিষয়ে নিয়ে কিছু বলতে চাই। নিশ্চিতভাবেই দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতিতে পড়বে ব্যাপক প্রভাব। এ অঞ্চলের একুশটি জেলার অর্থনীতি ও সমাজে আসবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। এই সেতু চালু হবার পর সড়ক ও রেল দুই পথেই দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন। দিনের পর দিন আর পণ্যবাহী ট্রাকগুলো ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় বসে থাকবে না। আর ঝড়-বৃষ্টিতে ফেরি বন্ধ থাকার কারণে মানুষের যাতায়াতও থমকে থাকবে না। সেতুটির কারণেই এই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোতে চলে আসবে। দক্ষিণ বাংলার গ্রামেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে। এই অঞ্চলের কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবেন। অন্যদিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারবেন তাদের গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু হবে শুনেই ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হতে শুরু করেছে। বরিশাল শহরের আশে পাশের জমির দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। পদ্মা সেতুর দুই পারেই এক্সপ্রেসওয়ের পাশের জমির দাম তিন-চার গুন বেড়ে গেছে। নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা, আবাসন প্রকল্প, রিসোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, মানব সম্পদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট ও নানা ধরনের এসএমই উদ্যোগ স্থাপনের হিড়িক পরে গেছে। খুলনা ও বরিশালে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। কুয়াকাটায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটছে দ্রুত গতিতে। আগামীতে বিকাশের এই ধারা আরো বেগবান হবে।
ঢাকার কাছে বলে পদ্মার ওপারে ছোট-বড় নানা শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। দক্ষিণ বাংলা হবে পর্যটনের এক উৎকৃষ্ট হাব। ছুটি পেলেই ঢাকা ও অন্যান্য নগরের বাসিন্দারা ছুটবেন দক্ষিণ বাংলার প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের সন্ধানে। তারা যাবেন কুয়াকাটা, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ এবং টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি পরিদর্শনে, যাবেন পায়রা বন্দরে। পদ্মার চরগুলোতে গড়ে উঠবে নতুন নতুন রিসোর্ট ও পরিকল্পিত ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র। সরকারও এরই মধ্যে নানা পরিকল্পনা নিচ্ছে পদ্মা পারের পুরো এলাকাকে উন্নত করার লক্ষ্যে। শোনা যাচ্ছে, পদ্মার চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, বিমান বন্দরসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা ভাবছে সরকার। পদ্মা সেতুর কাছেই দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী গড়ে উঠছে। এখানে থাকবে আধুনিক আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব সুযোগ-সুবিধা। পদ্মা সেতুর আশপাশে গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটবে। খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালীতে শিপ-বিল্ডিং শিল্পের বিকাশ ঘটবে। মোংলা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, মোংলা ইপিজেড, পায়রা বন্দর, রূপপুর প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা গেলে এসব প্রকল্পে বিপুল কর্মসংস্থান ঘটবে। একটি গবেষণায় বলা হচ্ছে যে পদ্মা সেতু চালু হবার পর বছরে প্রায় বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ১.০৪ শতাংশের কর্মসংস্থান হবে। আরও সহজ করে বলা যায় আগামি পাঁচ বছরে দশ লাখ অর্থাৎ বছরে দুই লাখ মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে। দশ বছর পর এই সংখ্যা তিন গুন হয়ে যাবে।
সার্বিকভাবে এই সেতু আমাদের জাতীয় জিডিপিতে ১.২৬ শতাংশ প্রতি বছর যোগ করবে। আঞ্চলিক জিডিপিতে যোগ হবে ২.৫ শতাংশ। রেল চালু হলে জাতীয় জিডিপিতে যোগ হবে আরও ১ শতাংশ। প্রতি বছর দক্ষিণ বাংলায় দারিদ্র্য কমবে ১.০৪ শতাংশের মতো। জাতীয় পর্যায়ে তা কমবে ০.৮৪ শতাংশ। উত্তরবঙ্গে যেমন বঙ্গবন্ধু সেতুর কারণে মঙ্গা আর এখন দৃশ্যমান নয়, তেমনি পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণবঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার অতিদারিদ্র্যের হারও কমবে। সেখানকার ছিন্নমূল মানুষকে তখন আর ঢাকা বা অন্য নগর পানে কষ্টের জীবন বেছে নিতে হবে না। নিজের পরিবেশেই নিজের জীবন সংগ্রামে স্বস্তি খুঁজে পাবে বিপর্যস্ত এই দুঃখী মানুষেরা।
নিঃসন্দেহে পদ্মা সেতু আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথনকশায় এক নতুন আশা-সঞ্চারি মাইলফলক। তাই আমাদের স্বপ্নের মিনার-এই স্থাপনাকে নিয়ে আমাদের উচ্ছাস যেন কেবল উদ্বোধনের দিনেই (অর্থাৎ ২৫ জুনেই) সীমাবদ্ধ না থাকে। সরকারের দিক থেকে তো উদযাপন থাকবেই। বৃহত্তর জনসাধারণও যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই উদযাপনে অংশীদার হতে পারেন তা নিশ্চিত করা গেলে ভালো হয়।
লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর