বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি
সারাবিশ্ব গত দুই বছরব্যাপী করোনা সংকট থেকে বের হয়ে এসে যখন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিল, তখনই শুরু হয়ে গেল রুশ-ইউক্রেন অনাকাংক্ষিত যুদ্ধ। বৈশ্বিক এই সংকটের কারণে আমাদের মতো দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা বেশ কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি আমদানি ও রপ্তানির সার্বিক মূল্যে ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতির হাত ধরে চলতি হিসেবে ঘাটতি বেড়ে চলছে। খুব স্বাভাবিক নিয়মেই দেশীয় মুদ্রার মানের ওপর চাপ পড়তে শুরু করছে।
বাজেটে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি অনেকটাই বহিঃবিশ্বের পরিস্থিতির কারণে হচ্ছে। আভ্যন্তরীণ পদক্ষেপ নিয়ে এটিকে কমানো খুব একটা সহজ হবে না। তবে চেষ্টা করতে হবে মূল্যস্ফীতি কিভাবে কমানো যায়। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে কোভিডের কারণে দারিদ্র সীমার নিচে লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাড়াতে লাগবে এবং এটির আওতায় আরও বেশি সংখ্যক লোককে আনতে লাগবে। আরও বেশি সংখ্যক লোককে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
স্বাস্থ্যখাত ও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়াতে লাগবে। এগুলি যেন সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার হয়।এই যে বরাদ্দকৃত অর্থ, সেটির জন্য দিক নির্দেশনা থাকতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে, আমাদের দেশের আয় বৈষম্য ক্রমেই বেড়ে গিয়েছে। আয় বৈষম্য কিভাবে কমানো যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য যা করণীয়, সেটি হতে হবে ব্যবসা বাণিজ্যে পরিবেশ সৃষ্টি করা। এখানে যে সিন্ডিকেট ব্যবস্থা আছে সেই ব্যবস্থা আরও বেশি উন্নত করতে হবে এবং সুশাসনের দিকে আরও বেশি অগ্রসর হওয়া লাগবে। এগুলি না থাকলে শুধু কর্ম করে বেসরকারি খাতে শুধু বিনিয়োগ বাড়ে না। বিনিয়োগ বাড়িয়ে আমাদের আরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশের অনেক মানুষই কাজ পায়না, তাদের কর্মসংস্থান ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের ব্যয় এবং আয়ের মাত্রা কম। আমাদের আয়ের মাত্রা বাড়ানো লাগবে। সেটির জন্য যারা কর দেওয়ার যোগ্যতা রাখে, সেটি ইনকামট্যাক্স এবং ভ্যাটের ক্ষেত্রে, অথচ কর দেয় না অথবা রিটার্ন দেয় না, তাদেরকে করের আওতায় আনতে হবে।
দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি মনিটরিং পলিসি তথা মুদ্রানীতি যদি তার সম্পূরক ভূমিকাটি পালন করতে পারে, তবেই কেবল বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবলিা করে বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন প্রাণসঞ্চার ঘটতে পারে। টাকার অবমূল্যায়নের চাপ ঠেকাতে যে কৌশল কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতোদিন অনুসরণ করছে কিন্তু এরও একটি সীমা আছে। গোটা বিশ্বের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকই ডলারের বিপরীতে নিজস্ব মুদ্রার কমবেশি অবমূল্যায়ন করছে। এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার বৈদেশিক নিয়মিতভাবে প্রয়োজনবোধে ভ্যালুয়েশন করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেটিকে স্বাগত জানাতেই হবে। পাশাপাশি আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। যে কোনো মূ্ল্যেই ডলারের যথেচ্ছা ব্যবহার বা উল্টাপাল্টা ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সব ধরণের বিলাসী পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের সময় এসেছে। আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে করণীয় আছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমদানি শিল্পের প্রসারকে উৎসাহিত করার এখনও প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে দ্রুত বদলে যাওয়া বিশ্ববাণিজ্যের এই সংকটকালে কথাটি আরও বেশি প্রযোজ্য। এজন্যে এনবিআর বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বিলাসী পণ্যের মার্জিন আরও বাড়িয়ে দিতে হবে।
বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে ঠিক করা হয়, তখন কাজের মান ঠিক থাকে না। কাজ না করেই চেক লেখা হয়। আর্থিক ইউটিলাইজেশন দেখানোর জন্য। সেজন্য সময়মতো কাজ করতে হবে। যাতে করে এই প্রকল্পগুলি থেকে আমরা কাঙ্ক্ষিত সুফল পেতে পারি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা