মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে সিন্ডিকেট কার স্বার্থে?
গত ১৫ মে দৈনিক আমাদের সময় ‘মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার-হাজার কোটি টাকার বিনিময়ে সিন্ডিকেট’ শিরোনামের একটি সংবাদ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় যে, একটি সিন্ডিকেটের অপতৎপরতায় মালিয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণ ঝুলে গেছে। এর মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর জন্য নির্ধারিত একমাত্র প্রতিষ্ঠান বেস্টিনেটকে। মূলত ১০টি বাংলাদেশি এজেন্সির সিন্ডিকেট ছিল সেটি। আগের সেই সিন্ডিকেটের মতো এবারও সিন্ডিকেট গঠনের পেছনে কাজ করছে মালয়েশিয়ায় বাসরত আমিন নামের এক বাংলাদেশি।
প্রকাশিত ওই সংবাদটি মূলত ভাইরাল হওয়া একটি অডিও রেকর্ডের ভিত্তিতে করা হয়েছে যেখানে সিন্ডিকেটের একজন মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের বিষয়টি অন্য একজনকে টেলিফোনে বর্ণনা করছিলেন। ২৫টি লাইসেন্সধারী এজেন্টকে নিয়ে গঠিত ওই সিন্ডিকেটকে নাকি এজন্য হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। বাংলাদেশের হাজারের অধিক এজেন্সির মধ্যে মাত্র ২৫ এজেন্সির সিন্ডিকেটের সদস্যরাই মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য বায়রার পক্ষ থেকে এই পদক্ষেপকে নিন্দা জানানো হয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সম্পৃক্ততার কথা ওই কথোপকথনে প্রকাশ করার পেছনে কি কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে? হয়তো ইতোমধ্যে বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মালয়েশিয়ায় আমাদের কর্মী প্রেরণের নানা জটিলতার কথা জানতে হলে একটু পেছনে ফিরতে হবে। ১৯৮৯ সাল থেকে নিয়মিতভাবে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণ করা হলেও প্রায়শই তা হোঁচট খেতে থাকে। কর্মীদের শোষণ, প্রতারণা ও বিভিন্নভাবে হয়রানির কারণে মালয়েশিয়া সরকার বেশ কয়েকবারই বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। প্রথম নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, দ্বিতীয়বার ২০০১ সালে, তৃতীয়বার ২০০৯ সালে এবং শেষটি ২০১৮ সালে (যা এখনও অব্যাহত)। ২০০৯ সালে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রেক্ষিতে দুদেশের মধ্যে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে ‘জিটুজি’ পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগসংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় এবং বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়া শুরু করে। ওই প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম অভিবাসন ব্যয়ে (সর্বসাকুল্যে ৩৫,০০০ টাকারও কম) আমাদের কর্মীরা মালয়েশিয়া যেতে সক্ষম হয়েছিল। আমাদের স্বার্থান্বেষী মহল এতোটাই শক্তিশালী যে একটি ভালো উদ্যোগকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করা হলো। ২০১৬ সালে ওই স্মারকটি বাতিল করে ‘জিটুজি প্লাস’ নামে নতুন একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে মাত্র ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির একটি সিন্ডিকেটকে বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণের একচ্ছত্র সুবিধা প্রদান করা হয়। বাকি এক হাজারের বেশি বায়রা সদস্যকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত রাখা হয়। সেদিন ওই সিন্ডিকেটটির মূল নায়কও ছিল উল্লেখিত আমিন নামের বাংলাদেশি। দুর্ভাগ্যবশত ২০১৮ সালের মে মাসে ডা. মাহাথিরের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ায় সরকারের পরিবর্তন হলে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অসদাচরণের ব্যাপক অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞাটি নেমে আসে।
হয়তো অনেকেরই মনে আছে, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে মালয়েশিয়ার নতুন সরকারের মানবসম্পদ মন্ত্রী এম কুলাসেগারন বলেছিলেন, ‘আমরা জিটুজি প্লাস চাই না। যে কোনো ব্যবস্থাই হতে হবে সরকার থেকে সরকার।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘জিটুজি চলাকালীন কোনো মাথাব্যথা ছিল না এবং আমরা সেদিকেই ফিরে যেতে চাই।’ তখন আরও উল্লেখ করা হয়েছিল যে, আমিনের নেতৃত্বে একটি সংগঠিত সিন্ডিকেট জিটুজি প্লাস সিস্টেম পরিচালনার দায়িত্বে ছিল এবং মাত্র দুবছরের ওই সিন্ডিকেট দরিদ্র কর্মীদের থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত হাতিয়ে নেয়। দুদেশের সরকারের সম্মতি ছাড়া ওই সিন্ডিকেটটি যে এ ধরনের অপকর্ম করতে পারেনি তা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। দরিদ্র কর্মীদের শোষণ করার ওই ব্যবস্থাকে বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ কোনো পথে যে সিন্ডিকেটটির হাঁটতে হয়নি তা শুধু তারাই জানে।
আমরা মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি লক্ষ্য করি যখন ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর কুয়ালালামপুরে দুদেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। আমাদের স্মরণে আছে যে সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষরের দুদিন পর অর্থাৎ ২১ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে এসে আমাদের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময় বলেছিলেন, স্বাক্ষরিত ওই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী আমাদের কর্মীদের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ডাটাবেস থেকে নির্বাচন করে পাঠানো হবে এবং অভিবাসন ব্যয় একজন শ্রমিকের ২/৩ মাসের বেতনের (ন্যুনতম মাসিক বেতন প্রায় ২৪,০০০ টাকা) বেশি হবে না। তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন যে, কর্মীদের বিমান ভাড়া (ঢাকা-কুয়ালালামপুর) ও মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর সব খরচ নিয়োগকর্তারা বহন করবেন। তবে একজন কর্মীকে ডাটাবেস থেকে নির্বাচনের পর তার বাড়ি বা কর্মস্থল থেকে ঢাকায় আসার জন্য যাতায়াতসহ থাকা ও খাওয়ার খরচ, পাসপোর্ট ফি, বিএমইটি ফি, কল্যাণ বোর্ডের সদস্য ফি, চিকিৎসা ফি বহন করা ছাড়াও এজেন্সিগুলোকে সরকার নির্ধারিত পরিষেবা চার্জ বা কমিশন (যদিও তখন নির্ধারণ করা হয়নি) দিতে হবে। সেদিন তিনি আরও ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তারা ওই প্রক্রিয়ায় কাকেও কোনো সিন্ডিকেট বা গ্রুপিং করতে দেবেন না। না বললেই নয় যে, মন্ত্রীর সেদিনের বক্তব্য আমাদের কর্মীদের যেমন আশ্বস্ত করেছিল, তেমনি আশ্বস্ত করেছিল এক্ষেত্রে সেবা প্রদানকারী বায়রার সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে।
মাননীয় মন্ত্রীর ওই বক্তব্য ছাড়া সমঝোতা স্মারকে উল্লেখিত অন্যান্য অনেক তথ্যই, বিশেষ করে কর্মী প্রেরণে বায়রা সদস্যদের ভূমিকা, সবার অজানাই রয়ে যায়। যেহেতু ইচ্ছুক কর্মীদের বিএমইটির ডাটাবেস থেকে বাছাই করে পাঠানো হবে, তাহলে কোন পরিষেবার জন্য এজেন্সিকে চার্জ বা কমিশন দিতে হবে? তারা কি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মালয়েশিয়া পাঠানোর উদ্দেশে কর্মীদের সংগ্রহ করে ডাটাবেসে নাম অন্তর্ভুক্তির পর তাদেরকেই মালয়েশিয়ায় পাঠাবে এবং পরবর্তীতে সে বাবদ পরিষেবা চার্জ নেবে? নাকি তাদের কাজ হবে মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে চাহিদাপত্র সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া, যার বিপরীতে ডাটাবেস থেকে কর্মী নির্বাচন করে মালয়েশিয়ায় প্রেরণ করা হবে? যদি তাই হয়, তাহলে তাদের চাহিদাপত্র অনুযায়ী কর্মী পাঠানো হলে তারা অবশ্যই সরকার কর্তৃক নির্ধারিত পরিষেবা চার্জ বা কমিশন পাওয়ার দাবি রাখে। এছাড়া পরিষেবা চার্জ পাওয়ার অন্য কোনো উপায় আছে কি? আমাদের বিশ্বাস সমঝোতা স্মারকে এ ধরনের গোপনীয় কিছু নেই যা কর্মীদের উপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে বা নিয়োগ প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
এখন আমাদের কানে আসছে যে মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক দরিদ্র কর্মীদের রক্ত চোষার উদ্দেশে গুটিকয়েক এজেন্সির স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে আবার সিন্ডিকেট তৈরি হচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস, এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা শক্তিশালী না হলে এটি তৈরি করার কথা ভাবতো না। বাংলাদেশেই হোক বা মালয়েশিয়ায়, এই সিন্ডিকেটের, তাদের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি অনুযায়ী, দুদেশের সংশ্লিষ্টদের সম্মত করানোর জন্য যথাযথ সংশ্রয় (নেটওয়ার্ক) রয়েছে বলেই মনে হয়। দুঃখজনক হলো, দরিদ্র বিদেশগামী কর্মীদের স্বার্থের কথা কেউ ভাবেন না। তাহলে কি কর্মী ও রিক্রুটিং এজেন্সির স্বার্থ রক্ষায় অভিবাসী-বান্ধব নিয়োগ ব্যবস্থার স্বপ্ন কোনোদিনই বাস্তবায়িত হবে না?
একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক, যে কোনো ক্ষেত্রের উন্নয়নসাধন, জনকল্যাণমুখীকরণ এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব বর্তায় সেই দেশের নেতৃত্বের উপর। আমরা জানি, ইতোমধ্যেই ডা. মাহাথির মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে বিদায় নিয়েছেন। মালয়েশিয়ার বর্তমান সরকার পূর্বেকার নীতি থেকে সরে আসতেই পারে। তবে আমরা সেই সরে আসাকে কি গ্রহণ করবো যদি তা আমাদের কর্মীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তাদের জন্য অনুচিত হয়? এর উত্তর কিন্তু আমাদের অংশেই রয়েছে। যা কিছুই শোনা যাক না কেন, আমাদেরকে সিদ্ধান্তে অটল থেকে সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদেরকে, মন্ত্রী মহোদয় যেমনটি বলেছিলেন, কর্মী-বান্ধব নিয়োগ প্রক্রিয়াকেই বাস্তবায়ন করতে হবে- দেশের অর্থনীতির স্বার্থে, কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ রাখা এবং তাদের পরিবারগুলোর জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনার স্বার্থে।
আমরা খুবই আশাবাদী হয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর দিনের অপেক্ষা করছি। আমরা আমাদের সরকারের উপর আমাদের আস্থা ও বিশ্বাসকে অটুট রাখতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীর কথাই বাস্তবায়িত হবে- কোনো সিন্ডিকেট থাকবে না এবং কর্মী নেওয়া হবে বিএমইটি’র ডাটাবেস থেকেই। প্রকৃতপক্ষে, আমরা একটি কর্মী-বান্ধব, শোষণমুক্ত এবং আরও মানবিক নিয়োগ ব্যবস্থার বাস্তবায়ন দেখতে চাই যা মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক আমাদের কর্মীদের স্বার্থের পাশাপাশি পরিষেবা প্রদানকারী বায়রার সদস্যদের স্বার্থকেও রক্ষা করবে। ইতোমধ্যে বর্তমান নিষেধাজ্ঞা আরোপের চার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এদিকে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির বেশ উন্নতিও ঘটেছে। আমাদের প্রত্যাশা, অতি শিগগিরই আমাদের কর্মীরা একটি সুরক্ষিত ব্যবস্থায় নির্বিঘ্নে মালয়েশিয়া যেতে সক্ষম হবেন।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত
আরএ/