‘গেলবার হাওর ডুবায় নিঃস্ব অইগেসলাম, এবার সোনার ধান পেলাম’
সীমান্ত ঘেঁষা জেলা সুনামগঞ্জ, এ জেলাকে বলা হয় হাওরের রাজধানী। প্রতিবছর জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ হাওরের বোরো ধান উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। বোরো ফসল দিয়েই সারা বছরের স্বপ্ন বুনেন তারা। কিন্তু সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড়ি ঢলের আঘাতে প্রায় প্রতিবারই তলিয়ে যায় সেই স্বপ্ন। তবে এবার দেখা দিল একেবারেই বিপরীত চিত্র।
এ বছর বৈশাখ মাসের শুরু থেকেই সুনামগঞ্জে ছিল ‘গাঁ-পোড়া’ রোদ। তীব্র দাবদাহ ও গরম হাওরের সবুজ ধানকে দ্রুত পাকিয়ে সোনালি ধানের সমারোহ করে তোলায় স্বস্তি ফিরল কৃষকের মনে। গরম আর কাঠফাটা রোদে কৃষকের শ্রমে-ঘামে ফলানো সোনার ফসল গোলায় তুলতে পেরে কিষান-কিষানির চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে আনন্দের ছোঁয়া। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় হাওরে দ্রুত কাটা হচ্ছে বোরো ধান। এ পর্যন্ত সুনামগঞ্জ হাওরের ৯৩ শতাংশ ধান কেটে ঘরে তুলেছেন কৃষকরা।
তবে গত ২৩ এপ্রিল আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী সুনামগঞ্জে কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রপাতে জেলার ছাতক উপজেলা, দোয়ারাবাজার উপজেলা ও তাহিরপুরসহ ৩ উপজেলায় ধান কাটতে গিয়ে ৬ কৃষকের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে হাওর এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করে। তবে ২৩ এপ্রিলের পর থেকে এখন পর্যন্ত সুনামগঞ্জে দিনে তেমন বড় কোনো ঝড়-বৃষ্টি না হওয়ায় সেই আতঙ্ক কেটে গেছে। এখন আনন্দের সঙ্গে ধান কেটে ঘরে তুলছেন কৃষকরা।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কানলার হাওরপাড়ের কৃষক শফিকুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, গত বছর এই দিনে আমার চোখের পানি হাওরে মিলেছিল। নদীর পানির চাপে আমাদের হাওরের বাঁধ ভেঙে সব ধান তলিয়ে গেছিল। রোজার মাস ছিল, না খেয়ে রোজা রেখেছি। এমনকি ঈদেও বাচ্চাদের কিছু দিতে পারিনি। সারা বছর খুব কষ্টে কেটেছে। গেলবার হাওর ডুবায় আমি নিঃস্ব অইগেসলাম, এবার সোনার ধানের দেখা পেলাম। এবার আল্লাহর দয়ায় ভালো রোদ হয়ে ধান জমিতেই পেকেছে। খুব ভালো ফলন হয়েছে, বিবি-বাচ্চাদের নিয়ে এ বছর ভালো কাটাতে পারব।
হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর। চাষ হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৯৫ হেক্টর বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দাবি, এবার বোরো ধান কাটতে সুনামগঞ্জ জেলায় শ্রমিকের কোনো সংকট হয়নি। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৭০০ কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন ধান কেটেছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ফলন পাওয়ার আশা প্রকাশ করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
তাহিরপুর উপজেলার কৃষক আব্দুল মালিক মিয়া ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমি গত ২০ বছরের মধ্যে এমন ফলন পাইনি। উপর ওয়ালা ২০ বছর পর এবারই ধানের বাম্পার ফলন দিয়েছে। এই ধান বিক্রি করে এবার আমার ঋণ দেব।
শান্তিগঞ্জ উপজেলার ডেকার হাওরের কৃষক হাফিজ আহমেদ বলেন, মাইকিং ও বিভিন্ন মাধ্যমে কয়েকদিন শুনেছিলাম টানা বৃষ্টিপাত শুরু হবে। খুব চিন্তায় ছিলাম যদি বন্যা হয়ে যায় অথবা আর রোদ না উঠে তাহলে আমার সব ধান নষ্ট হবে। কিন্তু টানা বৃষ্টিপাত হয়নি, হাওরের ধান শুকানোর মতো যে রোদ ছিল তাতে আমাদের হয়েছে। তাই রোদ থাকতে থাকতে ধান কেটে শুকিয়ে দ্রুত ঘরে তোলার চেষ্টা করছি।
জেলায় বোরো ধানের এবার বাম্পার ফলন হয়েছে জানিয়ে সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ সোম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, হাওরের ৯৩ ভাগের চেয়ে বেশি ধান কাটা হয়ে গেছে। এবার ধান কাটতে শ্রমিকের কোনো সংকট হয়নি। কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন গতবারের চেয়ে অনেক অনেক বেশি কাজ করেছে। কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন কৃষকের জন্য এবার আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে সুনামগঞ্জে বৃষ্টি আর নদীর পানি বাড়লেও কৃষকের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। তবে শতভাগ ধান ঘরে তুলতে আরও ৪-৫ দিন সময় লাগবে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জানান, কোনো প্রকার দুর্যোগ ছাড়াই হাওরের কৃষকদের ধানের গোলায় সোনালি ধান উঠছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দ্রুত ধান কেটে ঘরে তুলতে কৃষকদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
এসজি