একটি খামারে সব
গতকাল ৬২ বছরে পা দিলো দেশের ও দশের প্রধান কৃষিভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। দুটি আধুনিক সমন্বিত কৃষি খামারে তাদের মাঠ সফর জানালো কী তাদের ভুবন ও অবদান বিশ্বে? লিখেছেন ও ছবি তুলেছেন রাকিবুল হাসান
দেশের ফসলি জমিতে বিভিন্ন ধরনের কল-কারাখানা, অফিস, আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে দিনে, দিনে। প্রতিনিয়ত কমছে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ। অথচ জনসংখ্যা দিনে, দিনে বেড়ে চলেছে। তাদের খাদ্যচাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় ‘সমন্বিত কৃষি খামার’ গুরত্বপূর্ণ সমাধান। এ হলো এমন এক ব্যবস্থা-যেখানে একই সঙ্গে ফসল, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী ও মাছ উৎপাদন সম্ভব। ফলে মানুষের খাদ্য, পুষ্টি, জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান সম্ভব। এমন সমন্বিত কৃষি খামার তৈরি করে স্বনির্ভর উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন লাখ, লাখ বেকার ও যুবক। বিভিন্ন প্রান্তে কিছু সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে উঠেছে। এমনই একটি হলো শেরপুর সদর উপজেলার রৌহা ইউনিয়নের ‘মা-বাবার দোয়া ফ্রুট গার্ডেন নার্সারি অ্যান্ড অ্যাগ্রো ফার্ম’।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যাকোয়াকালচার’র মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারের ছাত্র, ছাত্রী তাদের মাঠ গবেষণায় খামারটিতে কাজ করেছেন। প্রায় ৮০০ একরের বিরাট একটি সমন্বিত কৃষি খামার। ঘুরে দেখালেন ম্যানেজার আবু সাইদ। জানালেন, ‘একই সঙ্গে আমাদের খামারে উৎপাদিত হচ্ছে-মাছ, হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি। বাগানে মাল্টা, কমলা, আঙুর, ড্রাগন, লটকন, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, কুল ও সৌদি খেজুর, অ্যাভোকাডো (মেক্সিকোর একটি ফুলজাতীয় ফল), সফেদা, মালবেরি, ত্বীন, আলু বোখারা, ভিয়েতনামের নারিকেল, কিউই, আনার, থাই সরিষাসহ মোট ২শ ৭১টি জাতের ফলের চাষ হচ্ছে। রয়েছে হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগল ও নানা জাতের কবুতর। সবচেয়ে বেশী চাষ করি মাল্টা। আমাদের উৎপাদন বিক্রি করে বছরে প্রায় ১৩ কোটি টাকা আয় হয়। ’
গবেষণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তারা এরপর গিয়েছেন ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার একটি সমন্বিত কৃষি ফার্মে। সেখানে পুকুরে মাছে, পাড়ে চাষ করা হচ্ছে নানা ধরনের সবজি। রয়েছে ঢেঁড়শ, লাউ, পেঁপে, বাঙ্গি, ডাটা, কলা প্রভৃতি। অ্যাকোয়াকালচার মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারের মোবিন হোসেন সোহান বলেছেন, ‘আমরা বেশিরভাগই অনার্স শেষে সরকারী চাকুরির পেছনে ছুটে বেড়াই। কৃষিতে কারিগরী জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে যদি এমন একটি সমন্বিত কৃষি খামার গড়তে পারি, যেমন নিজেরা সফল হতে পারব, তেমনি অন্যের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারব। আমিও স্বপ্ন দেখি একদিন সমন্বিত কৃষি খামারের মালিক হব।’ তার বন্ধু নুসাইফা আহসান জানয়েছেন, ‘আজ এই সমন্বিত খামারটি দেখার পর মনের মধ্যে আমার নতুন স্বপ্নের উদয় হলো। চেষ্টা করব, এমন একটি খামারে বিষমুক্ত মাছ, সবজি ও মাংস উৎপাদনের। দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় অংশ নেব।’
তাদের ‘মাঠ সফর’-এ ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক ড. এম এ সালাম, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক, হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, বাকৃবি’র প্রভাষক মোহাম্মদ মাহমুদুল, মো. তরিকুল ইসলাম, উম্মে ওয়াহিদা রহমান এবং শান্তা ইসলাম। ছিলেন পিএইচডির ছাত্র বলরাম মহলদার। অধ্যাপক ড. এম এ সালাম বলেন, ‘সমন্বিত মৎস্য ও কৃষিভিত্তিক খামারগুলো সম্পর্কে তাত্বিককভাবে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে পড়াই কিন্তু ব্যবহারিকভাবে আমরা তাদের আধুনিক খামারের যে বিকাশ ঘটেছে, সেগুলো সবসময় দেখাতে নিয়ে যেতে পারি না নানা কারণে। মাঠে এসে শিক্ষার্থীদের এভাবে কাজ করাতে পারলে তাদের শিক্ষার পরিপূর্ণতা আসে।’ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক জানিয়েছেন, ‘আমাদের মাস্টার্সের ছাত্র, ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার একেবারেই শেষ প্রান্তে। বেশিরভাগই এখন বিভিন্ন ধরণের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের অনেকেই স্বপ্ন দেখে, উদ্যোক্তা হবে। সমন্বিত মৎস্যচাষ ও কৃষিভিত্তিক প্রযুক্তি এখন আকৃষ্ট করছে। শহর থেকে গ্রামে এসে আমাদের ছেলে, মেয়েদের অনেকে গড়ে তুলছে বিশ্বমানের সমন্বিত খামার। বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি সৃষ্টি করছে শত মানুষের কর্মসংস্থান। আধুনিক সমন্বিত খামার দুটিতে শিক্ষার্থীদের সফরের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে অনেককে উদ্যোক্তা হতে অনুপ্রাণিত করবে।’
ওএফএস।