ভাসমান পেয়ারা হাট
দাম না পেয়ে হতাশ চাষিরা
'তেলের দাম বাড়তি, সবতার (সকল পণ্যের) দাম বাড়তি! মানে (মানুষ) পেয়ারা খাইবে কী দিয়া? ভাত খাইবে না পেয়ারা খাইবে? পেয়ারার দাম কম কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে ব্যবসায়ী খোকন হালদার ভিমরুলীর ভাসমান পেয়ারা হাটে ট্রলারের উপর ভাসতে ভাসতে এমন কথা বলেছিলেন। যদি কম দামে পেয়ারা বাজারে বিক্রি না করেন তবে ক্রেতারা পেয়ারা কিনতে আগ্রহী হবে না তেমনটাই তার ভাবনা।
দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী ভাসমান পেয়ারার হাট জমজমাট হয়ে উঠেছে। কিন্তু পেয়ারা চাষিরা পেয়ারার নায্য দাম না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন। গত বছরের তুলনায় এবার অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। অন্যদিকে জ্বালনি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে চাষিদের কাছ থেকে বেশি দাম দিয়ে পেয়ারা কিনতে নারাজ আড়তদার ও ব্যাপারীরা। তাই বাধ্য হয়েই চাষিরা লোকসান দিয়েই বিক্রি করছেন পেয়ারা।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিসহ দেশে বিভিন্ন পণ্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব কৃষি খাতে পড়তে শুরু করেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
গত কয়েক বছরের থেকে সবচেয়ে কম দামে পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে এ বছর। এর কারণ হিসেবে অনেক চাষি ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছে, গত বছর পেয়ারার এক মণের দাম ছিল ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা যা, এ বছর ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। দেশে বিভিন্ন পণ্যের ঊর্ধ্বগতি ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রায় প্রভাব পড়ায় অনেক ক্রেতারা পেয়ারা কিনছেন না। চাষিদের বক্তব্য- ‘পেয়ারা খাবে না, ভাত খাবে?’
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের ভিমরুলি, খাজুরা, ডুমুরিয়া ও বৈরামপুর গ্রাম এবং নবগ্রাম ইউনিয়নের জগদীশপুর, বৈহার, মীরকাঠি ও কাপড়কাঠি গ্রামেই মূলত পেয়ারার ফলন বেশি হয়। তবে পেয়ারার বড় হাট হয় প্রতিদিন ভিমরুলির খালেই। সদর উপজেলায় এ বছর ৫৩০ হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হয়েছে।
শুক্রবার (১২ আগস্ট) ঝালকাঠি জেলার কীর্ত্তিপাশায় শতদশ কাঠি, ভিমরুলি ও ডুমিরিয়া পেয়ারার ভাসমান হাটে সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত পেয়ারার জমজমাট বেচা-কেনা চলে। অন্যদিকে সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় এই অঞ্চলে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পর্যটকের ভিড় বাড়ে।
এসময় কথা হয় আড়তদার (পেয়ারা ব্যবসায়ী) রথিন হালদারের সঙ্গে। এসময় তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘এবছর আমরা বেশি দামে পেয়ারা কিনতে পারছি না। দেশে সবকিছুর দাম বৃদ্ধি। এ ছাড়া আবহওয়া খারাপ ছিল। রোদ বেশি হওয়ায় পেয়ারা আকারে ছোট হয়েছে। তাই বাজারে দাম কম পাওয়া যাচ্ছে। সেই অনুযায়ী পেয়ারা চাষিদের দাম দেওয়া হচ্ছে।’
খোকন হালদার নামে এক ব্যবসায়ী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘পেয়ারা চাষিরা সকালে গাছ থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করে এই ভিমরুলী ভাসমান হাটে নিয়ে আসে। আর আমরা এখানে ট্রলার নিয়ে অপেক্ষা করি। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বাজার জমজমাট থাকে। তবে এ বাজারে সব পেয়ারা পাইকারি বিক্রি হয়। খুচরা পেয়ারা পাওয়া যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘চাষিদের কাছ থেকে পেয়ারা ওজন দিয়ে কেনা হয়। আজকের বাজারে পেয়ারার মণ ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চলে। পেয়ারার আকার ও কাঁচা-পাকা নির্ধারণ করে দাম যাচাই করা হয়।
খুলনা থেকে আসা পেয়ারা ব্যবসায়ী মন্টু মিয়া ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমরা এই বাজার পেয়ারা কিনতে ট্রলার নিয়ে আসি। সেখানে বর্তমান বাজারে তেলের দাম বাড়ছে। এ ছাড়া ট্রলারে লোক আছে যাদের বেতন দিয়ে চালাতে হয়। আমার ট্রলারে সাতজন কর্মচারী আছে যাদের একজনের বেতন ৫০০ টাকা করে। দুই বেলার খাওয়া। এ ছাড়া সব মিলিয়ে আমার ট্রলারে প্রতিদিন ১২ হাজার টাকা খরচ আছে। সব কিছু মিলিয়ে ব্যবসা নিয়ে ঘরে ওঠা বড় দায়। তাই চাষিদের ভালো দাম দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই পেয়ার নিয়ে আমরা আবার খুচরা খুচরা বিভিন্ন দোকানে বিক্রির জন্য দেব। তারাও এই দিয়ে ব্যবসা করবে। অন্যদিকে ক্রেতারা বেশি দাম দিয়ে এখন পেয়ারা কিনতে চায় না। কারণ বাজারে সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি।’
তবে এই বাজার দিয়ে ঢাকা, ফেনী, শরীয়তপুর, মাওয়া ঘাট, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পাথরঘাটা, কুয়াকাটাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পেয়ারা যায় বলে জানান তিনি।
ভিরুলীর পেয়ারা চাষি তরুণ হালদার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘মুই এবার ২ বিঘা জমিত পেয়ারা চাষ করেছি। ফলন মোটা-মুটি পাইছি। কিন্তু বাজারে পেয়ারার ভালো দাম পাই না। এই দুই বিঘা জমিতে পেয়ারা চাষ করতে খরচ হইছে ৩০ হাজার টাকার মতো। তয় এবার সব মিলাই ৫০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হতে পারে।’ তবে এই দুই বিঘা জমির পেয়ারার ফলন আর দাম বেশি হতো তাহলে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মতো বিক্রি হতো বলে জানান তিনি।
প্রায় শত বছর পূর্বে ঝালকাঠির কীর্ত্তিপাশায় শতদশকাঠি, ভিমরুলি ও ডুমিরিয়া এবং পার্শ্ববর্তী পিরোজপুর উপজেলার নেছারাবাদের (স্বরুপকারী) আটঘর ও কুড়িয়ানা গ্রাম জুড়ে গড়ে ওঠে পেয়ারা বাগান। মৌসুমের মাস জুড়ে ভাসমান এই পেয়ারার হাটে বেড়েছে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা। ক্রেতা বিক্রেতার ও পাইকারদের কোলাহলে এখন মুখর ভিমরুলির ভাসমান পেয়ারার হাট।
এসএন