পাটের বাম্পার ফলন হলেও অনাবৃষ্টিতে লোকসানের আশঙ্কা
জয়পুরহাটে এবার চলতি মৌসুমে পাটের বাম্পার ফলন হলেও তীব্র দাবদাহ ও পানির অভাবে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক। তাপপ্রবাহে জমিতেই মরে যাচ্ছে পাট। পাটের আঁশ শুকিয়ে যাচ্ছে। সময়ে চাহিদা মতো বৃষ্টিপাত না হলে পাটের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্ক করছেন এ জেলার কৃষকরা।
আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণে পা রাখলেও জেলায় এবার কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি না হওয়ায় চাষিরা হতাশ। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে জেলার অধিকাংশ খাল-বিলগুলো পানিতে ভরপুর থাকত, সেখানে এখন অধিকাংশ খাল-বিল রয়েছে শুকনো। জেলার বিভিন্ন স্থানে যেটুকু বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং কোনো কোনো জলাশয়ে যেটুকু পানি রয়েছে, তা খুবই অপ্রতুল পাট পচানোর জন্য।
এদিকে চাষিদের অনেকেই বৃষ্টির আশায় পাট কেটে জমির পাশে, কেউবা রাস্তার পাশে, খাল-বিল বা ডোবার পাশে স্তুপ করে রেখেছেন। যারা তাপপ্রবাহ থেকে পাট রক্ষা করতে কেটেছেন, তারা পানির অভাবে জমিতে খড় ও আর্বজনা দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। এদের মধ্যে অনেকে আবার খাল-বিল বা জলাশয় এর অল্প পানিতেই পাটের উপর মাটি ও ভারী কিছু দিয়ে পাট পচানোর চেষ্টা করছেন।
আবার কেউ কেউ ডোবা কিংবা জলাশয়ে পাট জাগ দিয়ে পচানোর জন্য শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে পানি দিতে দেখা গেছে। আবার কেউ গাড়িতে করে পানি এলাকায় নিয়ে গিয়ে জাগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। চাষিরা শ্যালো মেশিনে সেচ দিয়ে রোপা-আমন লাগানোর জন্য পাট কেটে ফেলছেন। পানি না থাকায় রোদে এসব কাঁচা পাট নষ্ট হওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলায় দেশি ও তোষা পাট চাষের জন্য ৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৭৬ টন। কিন্তু সেখানে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৪৫ হেক্টর জমিতে বেশি পাট চাষ করেছেন কৃষকরা।
গত বছর পাটের ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা এ বছর পাট চাষের দিকে বেশি ঝুঁকেছেন। এরই মধ্যে এপ্রিলের শেষের দিক থেকে কয়েক দফায় বৃষ্টি হওয়ায় চাষিরা বিভিন্ন ফসল ঘরে তোলার সঙ্গে সঙ্গে জমিতে পাট বপন করেন। কিন্তু নিচু এলাকায় অল্প পানির দেখা মিললেও উঁচু অঞ্চলে রয়েছে পানির সংকট। পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে এ সমস্যা দূর হবে।
জয়পুরহাট সদর গংগাদাসপুর গ্রামের কৃষক লোকমান হোসেন, একই গ্রামের একরামুল হক, পাঁচবিবি উপজেলার কড়িয়া গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ও আছিরউদ্দিন, কালাই উপজেলার মোলামগাড়ি গ্রামের সানোয়ার হোসেন, ক্ষেতলাল উপজেলার আক্কেলপুর উপজেলার নান্নু মিয়াসহ একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের।
তারা জানান, প্রথম দিকে সংকটের কারণে বেশি দামে সার কিনতে হয়েছিল তাদের। এখন পানির অভাবে পাট জাগ দিতে সমস্যা থাকায় মাঠ থেকে দূরে যেখানে পানি আছে সেখানে পাট নিয়ে জাগ দিতে হচ্ছে। এতে তাদের শ্রমিক ও পরিবহনের অতিরিক্ত খরচ গুণতে হচ্ছে। এক বিঘা জমিতে পাট চাষে খরচ প্রায় ১৬ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় গড় ফলন ১০ মণ। প্রতি মণ পাটের বর্তমান বাজার দর আড়াই হাজার থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা। এ দামে পাট বিক্রি করলে তারা খুব বেশি লাভবান হবেন না।
পাঁচবিবি উপজেলার বীর নগার গ্রামের রফিক মিয়া, সদর উপজেলার আদর্শপাড়া গ্রামের এনামুল হক ,আক্কেলপুর উপজেলার কানুপুর গ্রামের শহিদুলসহ বেশ কয়েকজন কৃষকদের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, বর্ষা মৌসুমেও গ্রীষ্মের দাবদাহ। কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি না হওয়ার মাঠের পাট মাঠেই পুড়ছে। এ অবস্থায় পাট কাটার সময় হলেও পাট জাগ দেওয়ার অসুবিধার কথা ভেবে পাট কাটতে পারছি না। অনেকে পাট কেটেও পানির অভাবে জাগ দিতে না পেরে জমিতে স্তুপ করে রেখেছেন।
অনেক কৃষক পুকুর বা ছোট জলাশয়ে সেচ দিয়ে পানির ব্যবস্থা করলেও তাদের গুণতে হচ্ছে বাড়তি খরচ। নিশ্চিত লাভ জেনেও প্রকৃতির বিরূপ আচরণে কৃষকের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় এখনও প্রচুর পাট ক্ষেতেই রয়ে গেছে। প্রচণ্ড দাবদাহে জমিতে পাটগাছের উপরের পাতা, কাণ্ড ও গোড়া মরতে শুরু করেছে।
জয়পুরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক কৃষিবিদ শহীদুল ইসলাম জানান, ‘পাট চাষিরা তাদের জমির পাট কাটতে শুরু করেছে। এখন বড় সমস্যা পাট পচানোর পানির অভাব। পানির অভাবে চাষিরা ভালভাবে পাট পচাতে পারছেন না। আমরা চাষিদের কম ব্যয়ে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচানোর পরামর্শ দিচ্ছি। এ পদ্ধতিতে পাট পচালে পাটের আঁশের মানও ভালো হয়। ভালো মানের পাট উৎপাদন করতে পারলে দামও ভালো পাওয়া যাবে। এতে তারা লাভবান হবেন। প্রবাহমান পানিতে পাটের জাগ ও মাটি চাপা না দিয়ে জাগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
চলতি মৌসুমে জেলায় এবার পাটের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে। এবার ৩ হাজার ৪৯৫ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। ফলে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা এ বছর ৩৪৫ হেক্টর জমিতে বেশি আবাদ হয়েছে।
শহীদুল ইসলাম বলেন, আবহাওয়া অনুকূল থাকায় এবার পাটের আবাদ ভালো হয়েছে ও পাটের অবস্থাও ভালো। অনাবৃষ্টি হলেও পাটের উৎপাদন ব্যাহত হবে না। তবে অতিবৃষ্টি হলে চাষিদের জন্য আরও সুবিধা হতো। আমরা কৃষি দপ্তর থেকে খবর পেয়েছি দুই-তিন দিনের মধ্যে বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি হলে এ সমস্যা থাকবে না।
এসএন